কথা রাখেনি : অপর্ণা নাথ


 

      বিশ্বাসের বুকে আঘাত হেনেছিল রোহিত। অনেক না বলা কথা আজ গুমড়ে গুমড়ে উঠছে সুলেখার মনে। বিশ্বাস যদি অপরাধ হতো তাহলে ও কখনোই বিশ্বাস করতো না। কারণ ও সেই কোন্ ছোটবেলায় মা-বাবার সংসার ছেড়ে তার হাত ধরে তাদের বাড়িতে এসেছে। ছোট মেয়ে ছিল সুলেখা। কোনরকমে নাইনে উঠেছে বাবার দৌলতে। এক কথায় পড়াশোনায় ভালো না। রোহিত তো ভালো। ভালোকে কে না ভালোবাসে। সেও বেসেছে। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে সংসার পাতা। প্রথমে বাড়ির লোক মানেনি। সুলেখার বাবা বলেছেন-"বিয়ে যখন হয়েই গেছে জলার মাঠের ধান চাষের ভুঁইটা ওদের নামে রেজিষ্ট্রি করে দেবো।"

         সত্যিই দিয়েছিলেন। কারণ সুলেখার প্রতি অত্যেচার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। সুলেখা রোহিতকে বলে,-"আমার বাবার জমিতে তুমি কেন তোমার নাম ঢোকাবে? ওটি হচ্ছে না। আমার জমি।"

        যাক প্রথম প্রথম দু'জনের মধ্যে প্রগাঢ় প্রেমের বন্যা। রোহিত হেসে বলে,-"ঠিক আছে তোমার বাবা তোমার নামেই লিখে দেবেন। তাহলেই হলো। 

        সুলেখার বাবা বিনোদ বিহারী লিখে দিলেন। এরপর সুলেখার ওপর চাপ অন্যভাবে আসতে থাকে। খালি গায়ে চলে এসেছো তোমার বাবার কাছে সোনার গহনা দাবি করো ইত্যাদি ইত্যাদি। ওদের কাছে হেরে যান বিনোদবিহারী। কারণ সবার সাথে সবার মিল হয় না। সামান্য চাকুরীজীবি মানুষ। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবু ধার দেনা করে মেয়ের গলার হার বানিয়ে দেন। কানে ছিল রিং। বছর বছর নতুন পোশাক আর নিমন্ত্রণ হয় তীথি পরবে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সন্তান হয়। তার খরচ সব এসে পড়ে বিনোদ বিহারীর ঘাড়ে। মন্দ লাগে না। নাতিটা দেখার মতো হয়েছে।

         ওদিকে রোহিত তখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য একটা খরচ আছে। শহরের মেসে থাকে, মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। এভাবে মহাবিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বাড়িতে ব্যবসা আরম্ভ করে। কোনো কাজ ছোট মনে করে না। তবে যে কাজে হাত দেয় সেটাই যেন ডুবতে থাকে। বাবার দেওয়া পুঁজি শেষ হয়ে যায়। এবার সুলেখাকে বলে,-"তোমার হারটা আমাকে দাও, আমি ব্যবসায় খাটিয়ে পরে তোমাকে ফেরত দিয়ে দেবো।"

-"কিভাবে?"

-"বন্ধক রেখে টাকা নেবো, বিক্রি করে দেবো না।"

-"ঠিক আছে।"

      সুলেখা সরল মনে দিয়ে দেয়। কত বছর চলে যায় কিন্তু হার আর ফেরত দেয়নি। এরপর তার জমিটাও তলায় তলায় বন্ধক দিয়ে দেয়। ফসলের টাকা চাইলে বলে,-"পরে দেবো"। দিন দিন সুলেখার কেমন যেন সন্দেহ হয়। রোহিতের মতিগতি ভালো লাগে না। এরপর জানতে পারে সে জমি বন্ধক রেখেছে।

       সুলেখা মাটিতে বসে পড়ে। বাবার দেওয়া কোনো জিনিসই ওরা রাখতে পারলো না। কোন কথা না বলে ও সোজা চলে যায় তাদের বাগান বাড়িতে। ওখানে গিয়ে সেই যে দরজা দিলো আর খুললো না সুলেখা। একটা চিঠিতে অসুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা-"তুমি ভালোবাসার মর্যাদা তো দূরের কথা বিশ্বাসের কথাও রাখোনি।"

     সুলেখার নিথর দেহে চিঠিটা উড়তে লাগলো।

                         *সমাপ্ত*

Post a Comment

Previous Post Next Post