বেলাশেষে : সহেলী মল্লিক



"বেলাশেষে কেউ কারোর না,বেলাশেষে সবাই একা"-- বারান্দায় চেয়ারে বসে আল্ত দোল খেতে খেতে কথাটা ভাবতে থাকে ৬৫ বছরের এক ভদ্রমহিলা । এই তো কদিন আগেও তার কাছে নিজের জন্য একটুও সময় ছিল না, সকাল থেকে উঠে দৌড়ঝাঁপ করতে হতো আর  এখন তার হাতে অফুরন্ত সময়। আর নেই কোনো খেয়ে দেয়ে স্কুল যাবার তাড়া, আর মাথায় নেই কোনো চাপ, নেই আর কাউকে হিসেব দেবার পালা, এখন শুধু বিশ্রাম আর বিশ্রাম, ৪০ বছরের শিক্ষকতার জীবন অবশেষে শেষ হলো। এই তো সেদিন তাকে সম্বর্ধনা দিয়ে স্কুল থেকে চিরতরে বিদায় জানালো হলো। সত্যি বলতে ওই দিন স্কুল ছাড়তে শর্মিলা দেবীর ঠিক যতটা কষ্ট হয়েছিল তার কাছে, এ জীবনে তিনি আরো যা যা কষ্ট পেয়ে এসেছেন তা সবই তুচ্ছ । তিনি আবারো ভাবতে লাগলেন--"এ জীবনে যাকে আঁকড়ে ধরেছি সেই আমাকে দিনের শেষে একা করে দিয়েছে,তাই একাকীত্ব কে আর আমার ভয় করে না।"


    সেই ছোট্টবেলায় প্রথম ভয় পেয়েছিলাম যেদিন একটা লড়ি এক নিমেষে চূড়মাড় করে দিল আমাদের হাসিখুশি পরিবার টা কে। তারপর থেকে মা,বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার বদলে একটা ছবি কে  প্রণাম করতে হতো আর্শিবাদ নেবার জন্য। মিঠু দি কোন সকালে রান্না করে দিয়ে যেত একা একা খাবার খেতে হতো রেডি হতে হতো স্কুলে যাবার জন্য। মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর বদলে ছবি কে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে হতো। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যেত কেউ মুছিয়ে দিত না। এইভাবেই আমার দিন কাটত একা।।


মাসখানেক পরে আমার কাকু কাকিমার আমার প্রতি দয়া হলো আমাকে নিয়ে গেল তাদের সাথে গ্রামের বাড়িতে। আমি একটু খুশি হয়েছিলাম এই একাকী জীবন থেকে একটু শান্তি পাবো এই ভেবে। কিন্তু না খুড়তুতো দাদা দিদির কাছে আমি নাকি হিংসুটি। আমি এসেছি তাদের পড়াশোনার টাকায় ভাগ বসাতে তাই তারা আমার থেকে দূরে দূরেই থাকতো । আমি একা একাই থেকে গেলাম। তারপর একদিন কাকু কাকিমার কথা শুনে বুঝতে পারলাম আমায় তারা ভালোবেসে কাছে টেনে নেননি , কাছে টেনে নিয়েছে আমার বাবার সম্পত্তি দখল করার জন্য। একটু মুচকি হেসে দরজার আড়াল থেকে সরে এলাম, মনে মনে ঠিক করলাম আর এখানে নয়। পরেরদিন কাকু কে বললাম--'কাকু আমি আর.এম বডিং স্কুলে যেতে চাই। বাবা তো ওখানেই পড়েছিল তাই বাবার ইচ্ছে ছিল আমিও...... কথা টা শেষ করতে পারিনি, দু চোখে তখন বারিধারা। একবার চোখ গেল কাকিমার মুখের দিকে মুখ তখন প্রসন্নে ভরা।।


এবার আমার নতুন ঠিকানা বডিং স্কুল। এতজনের মাঝেও আমি যেন আবার একা বেলাশেষে কেউ আপন না যে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। একা একা আমার দিন কাটতে লাগল। তারপর একদিন স্কুলে মাতৃদিবস পালন হচ্ছিল আমি মাকে  আমার কাছে না পাওয়া নিয়ে আমার যে এক মস্ত নিঃসঙ্গতা তাই নিয়ে একটা  কবিতা বলেছিলাম। আমার কবিতা সকলের মন কে কতটা স্পর্শ করেছিল জানা নেই তবে সেইদিন থেকে আমি আর এক মাকে পেয়েছিলাম আমার কাছে আমার পাশে । তিনি আমাদের স্কুলের হেড দিদিমণি ছিলেন আদর করে আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। আমার সব রকম খেয়াল রাখতেন একদম মায়ের মতো আমি আবারো মাতৃস্নেহ পেলাম। এইভাবে আমি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে রাজ্যের মধ্যে প্রথম হয়ে কলেজে পড়তে এলাম। আমার কাকু কাকিমার আর আমাকে নিয়ে ভাববার সময় নেই এখন বাবার ২ কোটি টাকার সম্পত্তি দিয়ে কি কি করবে এই ভাবতেই তারা ব্যস্ত ।।


কলেজে আমার বেশ ভালোই দিন কাটতো। সেখানে  আমার অনেক বন্ধু হয়েছিল তার মধ্যে অমল ছিল আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সঙ্গী। অমলের সাথে কিভাবে যে এক একটা গোটা দিন কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। আমি অমল কে যে কবে এতটা ভালোবেসে ফেলেছিলাম বুঝতেই পারিনি। অমল কে  একদিন নিয়ে গেলাম দিদিমণি র কাছে যিনি এখন আমার সব। আজও মনে আছে দিদিমণি অমলের হাত ধরে বলেছিলেন --" এই মেয়েটার ত্রি ভুবনে কেউ নেই ওকে একটু দেখে রেখো বাবা।" অমল সেদিন বুক ফুলিয়ে বলেছিল আমি খেয়াল রাখবো শর্মির। সত্যিই খেয়াল রেখেছিল বটে! দেখতে দেখতে কলেজের  তিনটি ইয়ার এর রেজাল্ট এ সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে  গোল্ড মেডেলিস্ট হলো অমল। আমিও খুব খুশি তার সাফল্যে কারণ অমল জানে ওর এই সাফল্যের জন্য আমি কতটা স্যাকরিফায়িস করেছি। অমলের দিকে এগিয়ে গেলাম কিন্তু অমল যেন না দেখতে পাবার ভান করে এড়িয়ে গেল। আমি ডাকলাম- অমল, অমল। না অমল চলে গেল। তারপর অমল আমার সাথে আর কোনরকম যোগাযোগ করেনি। আমি এবার ভর্তি হলাম মাস্টার্স এ। তিনকূলে কেউ না থামায় হোস্টেলে আমার জায়গা হয়ে যেত। কিন্তু অমল... কোথায়?  ও ঠিক আছে তো? ওর কোনো বিপদ হলো না তো? সারাদিন এই সব ভাবতাম।


দিনটি ছিল ৩রা মার্চ যেদিন ভগবান দায়িত্ব নিয়ে আমার কফিন এ শেষ পেরেক টা মেরেছিল, আমাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। একটা গলিতে সেদিন হঠাত অমলের সাথে দেখা! অমল তুমি কোথায় চলে গেসলে আমি তোমাকে কতবার ফোন করেছি তোমার কোন ধারণা আছে অমল? শর্মি আমার পথ ছাড়া আমাকে যেতে হবে।

-- অমল তুমি আমাকে ভালোবাসো না?

- না না ভালোবাসি না। আমাকে কি একটুখানিও শান্তি দেবে না  তুমি? কেন বিরক্ত করছো পথ ছাড়ো শর্মি।

-- তবে তুমি যে বলতে আমায় ভালোবাসো, মিথ্যে বলতে?

- হ্যাঁ হ্যাঁ মিথ্যে বলতাম। তোমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় না করলে গোল্ড মেডেলিস্ট হতাম কি করে। তাছাড়া আমার বয়ে গেছে তোমার মতো চালচুলো হীন একটা মেয়ে কে ভালোবাসতে।

-- অমল ! আমি তোমার জন্য কি করেনি অমল। আমার তৈরি করা সমস্ত নোটস্ আমি তোমাকে দিয়েছি, ইচ্ছে করে সব প্রশ্নের উত্তর দিতাম না পরীক্ষায় পাছে তোমার থেকে বেশি নাম্বার পেয়ে যাই আর তুমি! ছি! ছি!  অমল 

- কেন শর্মি তার বিনিময়ে  আমি তোমার জীবনের  তিন তিনটি বছর কে আনন্দে ভরিয়ে তুলেছি এটাই কি কম বলো? এখন পথ ছাড়ো।

-- না অমল যেও না,যেও না অমল।


অমল চলে গেল। আমি একা রাস্তায় বসে বসে কাঁদছি এমন সময় ফোন ধরে জানতে পারলাম দিদিমণি আর বেঁচে নেই একটু আগেই মারা গেছেন। কতক্ষণ ওইখানে বসে ছিলাম মনে নেই তারপর কে একজন আমাকে ধরে হোস্টেলে দিয়ে গেছিল। একই দিনে আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ দুটোকে হারিয়ে ফেললাম। আবারো আমি একা.....


আজ এতবছর পরেও অমলের কথা মনে পড়তে দু চোখ জলে ভরে গেল ভদ্রমহিলার, অমল কে সে সত্যিই খুব ভালোবাসতো।


এরপর দেখতে দেখতে নিঃসঙ্গতার সাথে কেটে গেসল জীবনের আরো চার চারটি বছর। আমার জীবনে নতুন মানুষ রূপে এসেছিল নীলাভ। নীলাভ আমাকে খুব ভালোবাসত, খুব হাসিখুশি পরিবার আমাদের। আমি ঝাঁটিপাহাড়ি স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেলাম খুব খুব খুশি ছিলাম আমি। নীলাভ যে খুব একটা খুশি ছিল তা একদমই না তবে মেনে নিয়েছিল। তারপর আমাদের ঘর আলো করে এলো রাজ। আমরা দুজনেই খুব খুশি আমাদের ঘর এখন সম্পূর্ণ । রাজ এর বয়স যখন বছর দুয়েক তখন নীলাভ জেদ ধরল আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে। আমি কত করে নীলাভ কে বোঝাতে চেয়েছিলাম একইসাথে রাজ কে স্কুল কে ঠিকই সামলে নেবো। না নীলাভ তার জেদ  ছাড়লো না , আর আমিও আমার স্কুল ছাড়লাম না তাই আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। নীলাভ রাজ কেও আইনি মতে সাথে করে নিয়ে গেল, আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম নীলাভ কে বোঝাতে আমার বাবার ইচ্ছে ছিল আমি নিজের পায়ে দাঁড়াবো কি করে সেই ইচ্ছে কে আমি গলা টিপে মেরে ফেলি। বাবা নেই তাই বাবার ইচ্ছে কে কি করে ভুলে যাবো। স্বামী সন্তান থেকেও আমি একা...।


মাঝে মাঝে নীলাভ রাজ কে আমার কাছে নিয়ে আসতো সন্তান সুখ বলতে ওইটুকুই আমার প্রাপ্তি ছিল। তারপর একদিন একটা ফোন এল নীলাভ রাজ কে নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। বেশ সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত আর নীলাভ র কোনো ফোন আসেনি। তারপর থেকেই একরাশ নিঃসঙ্গতার , একাকীত্বের মাঝে আমার এক একটি দিবস এক একটি বেলা কাটে। যতক্ষন স্কুলে থাকতাম ততক্ষণ বেশ ভালো লাগতো তারপর বাড়ি ফিরলেই একাকীত্ব আমাকে নাগপাশের ন্যায় জাপটে ধরত। শত চেষ্টা করেও আমি তার থেকে মুক্তি পেতাম না। স্কুলে শিক্ষকতা করতে করতে কেটে গেছে বহু বছর। কি করে যে কেটেছে তা জানিনা বললে মিথ্যে বলা হবে। আমার এক একটি দিন কেটেছে নীলাভ র অপেক্ষায়, আমার ছেলের অপেক্ষায়।


ছেলেটাকে কেমন দেখতে হলো কে জানে। আচ্ছা আমি যেমন আমার মা কে আজও খুব কাছে চাই একই ভাবে রাজ ও কি আমায় কাছে চাইতো? নাকি আমি তার কাছে এক জেদি আত্মঅহংকারী, খুব খারাপ একটা মা যেমনটা আমাকে নীলাভ বলত। রাজ কি আমায় ভালোবাসে, আমায় কাছে চাই। না না আমায় চাই না সে যদি চাইতো তাহলে ঠিক একবার খোঁজ নিত।।


বিষন্ন মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারো ভাবতে থাকে সদ্য রিটাইয়ার প্রাপ্ত শিক্ষিকা-' এরপর থেকে এই একাকীত্বই আমার একমাত্র সঙ্গী।' ' বেলাশেষে কেউ কখনো পাশে থাকে নি আর থাকেও না, বেলাশেষে আমরা সবাই একা বড্ড একা।'


মা, বাবা ছিল পাশে আজীবন? না ছিল না। কাকু কাকিমা, দাদা- দিদি ছিল? না ছিল না। অমল যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম ছিল পাশে? না ছিল না ঠকিয়েছিল। দিদিমণি ও একা করে দিয়ে চলে গেল। নীলাভ ছিল পাশে? না ছিল না। নীলাভ তো চলে গেলই সাথে করে নিয়ে গেল আমার সাত রাজার ধন মাণিক কে। নীলাভ, রাজ কেউ কেউ পাশে ছিল না। বেলাশেষে কেউ কারোর পাশে থাকে না, থাকে শুধু একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা।। 


      বেলাশেষে আমরা সবাই বড়ো একা,

আমাদের নেই কোনও সঙ্গী ..

নিঃসঙ্গতায় ঘেরা আমাদের জীবন, 

হয়তো এই ছিল ভাগ্যে লেখা।।

Post a Comment

Previous Post Next Post