তখন স্বরূপ নগরে থাকি। পড়ন্ত বিকেলে, ডাকবাংলোর ব্যালকনিতে বসে বৃষ্টি ধোয়া বাগানের প্রাকৃতিক শোভা দেখেছি। হঠাৎ ডাক পিয়নের চিঠি এলো, চিঠি খুলে দেখি, বিভাস পাঠিয়েছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে ওর কাছে। ওখানে নাকি ভূত প্রেতের আড্ডা। বিভাস আমার বন্ধু, বনবিভাগ চাকরি করে। এখন আছে জলপাইগুড়ির অরণ্যে। নির্জন অরণ্যের কোন একটি জায়গায় কোয়ার্টারে থাকে।
ব্যাগপত্র গুছিয়ে পরের দিন তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম। স্টেশনে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেল। স্টেশনের বাইরে একটি অটো ধরে প্রায় দু কিলোমিটার গিয়ে পৌঁছালাম বিভাসের কোয়ার্টারে। বিভাস তখন কোয়ার্টারে ছিল না। দেখলাম তালা মারা। আশেপাশে হালকা জঙ্গল। নির্জন অরণ্যই বলা চলে। পাখিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃক্ষরাজি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। আস্তে আস্তে ঘন অন্ধকার নিবিড় হয়ে আসছে। একটু পরেই বিভাস এলো। হাতে ব্যাগ এবং টর্চ। কিছু দরকারি প্রয়োজনে বাজারে গিয়েছিল।আমাকে দেখেও ভীষণ খুশি। দুজনে কুশল বিনয়ের পর, ঘরে ঢুকলাম।
পাশাপাশি দুটি বেডরুম। বেডরুম দুটির জানালা বাইরের জঙ্গলের দিকে। দিনের বেলায় জঙ্গলের পাখি, গাছ, ফুল ফল দেখতে ভালই লাগে। এখানে কোথা থেকে যে ভূত প্রেত এলো বুঝতে পারলাম না। একটু পরে এক কাপ চা খাবার পর, বিভাসের কাছে সব শুনতে চাইলাম। ও আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে বলতে লাগলো।জানালা খুলে আমাকে দেখালো একটি শেওড়া গাছ, এই গাছ বহু প্রাচীন। এই গাছে নাকি প্রেতাত্মারা থাকে। রাত যখন গভীর হয় ,শব্দেরা চোখ বুজে, মানুষের কোলাহল থেমে যায়, ঠিক তখনই এখানে প্রেতাত্মার নিশিকান্না শোনা যায়।
আমি বললাম-"বিভাস এটা তোর মনের ভুল। শিক্ষিত হয়েছিস অথচ এখনো এগুলো বিশ্বাস করিস। ভূত, শাকচুন্নি এগুলো আগে মানুষ বিশ্বাস করত এখন কেউ করে না।"
বিভাস বলল-"বেশ তাহলে আজকের রাতটা জেগে কাটা ।দেখবি ঠিক যখন দু-থেকে তিনটে বাজে, বাইরের ওই শেওড়া গাছে, শুনতে পাবি প্রেতাত্মার কান্না।"
--আচ্ছা ঠিক আছে।
আমি আর ঘুমাতে পারলাম না। শুধু ভাবতে লাগলাম, এটা কি সম্ভব? ভূত-পেত কি এখনো পৃথিবীতে আছে। আবার ভাবি, এই যে এত এত ভৌতিক গল্প সবই কি মিথ্যে? যুগ যুগ ধরে শুনে আসছি ভূতের গল্প। এর একটিও কি সত্য নয়। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করতে লাগলো। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রেন বাঁশির শব্দ। এই নিশ্চুপ পরিবেশে আমি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছি রূপকথার দেশে।
হঠাৎ শুনতে পেলাম জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। বিভাস আমাকে তারা দিয়ে বলল "এই ওঠ। শুনতে পাচ্ছিস?"
আমি কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম সেই কান্নার শব্দ। আমার শরীরের প্রতিটি লোম খাঁড়া হয়ে উঠল। কান্না শুনে মনে হল কোনএক মহিলার কান্না। এটা ঠিক কান্ন নয়, করুন সুরে সানাইয়ের সুর। এই কান্না আমি কোনদিন শুনিনি। বুকের ভেতরটা ধরাস ধরাস করে কেঁপে উঠলো। আমার ভয় করতে লাগলো। ভয় পেলে চলবে না। বুকের ভিতর সাহস সঞ্চয় করে, বিভাস কে বললাম-"টর্চ দে, আমার সঙ্গে আয়।"
আমি আগে আগে বিভাস পিছে পিছে, গেলাম শেওড়া গাছের তলায়। টর্চ জ্বেলে দেখি কেউ নেই। অথচ কান্নার শব্দ ঠিক এখান থেকেই আসছিল। আশেপাশে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। তাহলে কান্নার শব্দ কার? ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম এই নিশি কান্নার কথা।
পরের দিন আবার শুয়ে শুয়ে ,এই নিশি কন্নার কথাই ভাবছি। ভাবতে ভাবতে আমার মনটা শিউরে উঠতে লাগলো। হেরে গেলে চলবে না। বিভাস কে না জানিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে পড়লাম একা। শেওড়া গাছের অদূরে একটি ঝোপের নিচে বসে পড়লাম। আমি জানি, যত ভূতের গল্প পড়েছি, সব গল্পের পিছনেই আছে মানুষের হাত। এখানেও হয়তো কোন মানুষের হাত থাকবে। কিন্তু কে? এটাই তো আবিষ্কারের প্রশ্ন। ভাবছি আর ভিতরে ভিতরে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে। তাকিয়ে আছি শেওড়া গাছের দিকে। হঠাৎ আমার পেছনে, কে যেন নিঃশ্বাস ফেলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ঘুরে দেখি, সাদা কাপড় পরিহিতা কোন এক রমণী। দেখা দিয়েই কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি টর্চ জ্বালতেই রমণী উধাও। বুকের ভিতরে ভূমিকম্প খেলে গেল। মানুষ যতই সাহসই হোক না কেন, সংকট কালেই পাওয়া যায় তার সাহসের পরিচয়। আমি টর্চ নিয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলাম কোথাও কেউ নেই। তাহলে কে এই রমণী?
একটু পরেই দেখি, আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে এসেছে বিভাস। ও আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল ঘরে। এবং বলল "এই কাজটা তুই ভালো করিস নি। আমাকে না জানিয়ে এই অচেনা জঙ্গলে একা গেলি কেন?"
আমি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু ভাবতে লাগলাম শুভ্র বসন পরিহিতা আমি কাকে দেখলাম? ভয় এবং সাহসের যুদ্ধে আমি বোধহয় হেরে যাচ্ছি। ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। ঘন্টাখানেক পরে আবার শুনতে পেলাম, সেই নিশিকান্না। দেয়ালে একটি টিকটিকি টিকটিক করে আমাকে বিদ্রুপ করতে লাগল। বলতে লাগলো " এই সাহস নিয়ে ভূত ধরতে এসেছো? তুমি একটি জোনাকিও ধরতে পারবেনা।"অপমানে সারা শরীর জ্বলতে লাগলো।
পরের দিন আবার আমি কান পেতে থাকলাম সেই নিশি কান্নার শব্দে। আবার আমি জঙ্গলে গেলাম। ঠিক আগের দিনের সেই ঝোপের কাছে । আজ পেছন ফিরে ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম এবং দেখতে পেলাম সেই শেওড়া গাছের ডালে বসে সেই শুভ্র বসন পরিহিতা কাঁদছে।
আমি কাছে যেতেই, খল খল করে হেসে উঠলো। তারপর গাছ থেকে নেমে আস্তে আস্তে ঘন-জঙ্গলের দিকে চলে যেতে লাগলো। আমি পিছন পিছন যেতে লাগলাম। হঠাৎ একটি তাল গাছে ধাক্কা খেলাম। সংজ্ঞা ফিরে তাকিয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই। শুধু দূরে একটি কাছে পেঁচা ডাকছে।
জলপাইগুড়ি থেকে বাড়ি ফিরেছি পাঁচ দিন হলো। কারও সঙ্গে কোন কথা বলছি না। মনের মধ্যে শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে নিশিকান্নার কথা। সেই শুভ্র বসনা রমনীর কথা। আমার শিক্ষা, যুক্তিবুদ্ধি সব যেন পরাজিত। কি একটা চিন্তা যেন মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
আজ গোধূলি বেলায় আবার ডাকবাংলোর ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। দেখলাম বাগানে অনেক ফুল ফুটেছে। প্রজাপতি উড়ছে, গোধূলির আলো এসে পড়েছে প্রজাপতির ডানায়। এই ডানায় তৈরি হয়েছে একটি রঙ আর আলোর রহস্য। বুঝলাম, পৃথিবীতে অনেক রহস্য আছে যার রহস্যভেদ কোনদিনই সম্ভব নয়। মনের আকাশে রহস্য হয়ে থাকলো সেদিনের সেই নিশি কান্নার ডাক।