মানবিক : সঞ্জয় কুমার চ্যাটার্জী


    চা দোকানের কাপ প্লেট ধোয়া ছেলেটা নাম সেন্টু আজ বিকেলে আসে নি। শঙ্করদা বললো, "ঠিক মাঠে চলে গেছে। কত করে বলেছি মন দিয়ে কাজ কর । সংসারে মায়ের দুটো পয়সা হবে। তা নয়। ফুটবল খেলায় ওর মন। কাল আসুক আর আসতে হবে না বলে দেবো"। খুবই গরীব । পড়াশুনা করার খরচ জোগাড় করতে পারে না বলে ওর মা অনেক বলে কয়ে চা দোকানে কাজে ঢুকিয়েছে।

   শঙ্করদা লোকটি খুব কড়া। সবাই বলে এর কাছে কাজ করা কঠিন কাজ। পরের দিন আসতেই যথারীতি বাক্যবান। সেন্টু কোন কথা না বলে নিজের কাজে মন দিল।

   সেন্টু নাকি ফুটবল খেলে ভালো। কিন্তু হিসেবে একটু কাঁচা। একদিন এক খদ্দেরের কাছে কম টাকা নেওয়ায় শঙ্করদা অত্যন্ত রেগে গেল। মার খেল ছেলেটা। কাঁদলো অনেকক্ষণ। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। পরে আবার স্বাভাবিক।

   মাঝে মাঝেই মাঠে চলে যায়। এবার কামাই করা একটু বেড়ে গিয়েছিল। আবার বকা ঝকাও চলে।কাজও চলে। এভাবেই চলছিল। 

   বেশ কদিন শঙ্করদার খুব জ্বর। ওষুধ দোকানে বলে ওষুধ খাচ্ছিল । জ্বর ছাড়লো না। উপরন্তু বাড়তে লাগলো। কিছুতেই উঠতে পারছিল না। ডাক্তারবাবুর পরামর্শে ভর্তি করা হল। পরে টেস্টে ধরা পড়লো ম্যালিগন্যান্ট মেলেরিয়া। অবস্থা খারাপ পর্যায়ে যাওয়ায় ডাক্তারবাবুরা প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছেন। সেন্টু কিছুতেই শঙ্করদার কাছ ছাড়ে নি। বসে থাকতো তার বেডের পাশে।

   সে বাইরে যাবার নাম করে যে গনেশ ঠাকুরের মন্দির আছে, সেখানে গিয়ে কী যেন করত। ফিরে এসে ঠাকুরের ফুল শঙ্করদার মাথায় ঠেকাতো। যমে মানুষে টানাটানির চললো কয়েকদিন। তার মধ্যে শঙ্করদা জিতলো। বেশ কিছুদিন পর ভালো হয়ে উঠলো। 

    যখন শঙ্করদা অনেকটা স্বাভাবিক তখন আবার শুরু হলো চায়ের দোকান। সেন্টু তার কাজ করে । আবার বিকেলে চলে যায় ফুটবল মাঠে। একদিন সারাদিন সেন্টু দোকানে এলো না। আবার রাগারাগি, ধমক এবং পরে সেই চা, ঘুগনি , টোস্ট দেওয়া, থালা প্লেট ধোয়ার কাজ করে যেতে লাগলো। আমি যখন যেতাম কিছু না কিছু পড়া আমার থেকে জানতো । ভালো লাগতো । আমিও গেলেই জিজ্ঞেস করতাম তোর কী খবর বল ? আবার কবে মাঠে যাবি ? পড়াশুনা করছিস তো ? ইত্যাদি।

    একদিন একটা চিঠি আমাকে দিয়ে বললো পড়ে একটু বুঝিয়ে দাও। আমি পড়ে দেখলাম জেলায় যে অনুর্দ্ধ ঊনিশ ফুটবোলারদের খেলা হয়েছিল। তার থেকে সেন্টু সেরা নির্বাচিত হয়েছে এবং আগামী মাসের ১২ তারিখে কলকাতায় কোচিং -এর জন্য যেতে বলা হয়েছে। খাওয়া ,থাকা সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে পশ্চিমবঙ্গ ফুটবল অ্যাকাডেমী । আমার মনটা ভরে গেল।

   আমি পড়ে বাংলায় তরজমা করে যখন বুঝাচ্ছিলাম, দেখলাম অপার নিস্তব্ধতা শঙ্কর দার মুখে, চোখের ভাষায় যেন বিষন্নতা। 

    আমি জিগ্গেস করলাম কবে তুই এসব করলি ? সেন্টু বলল ," আমি তো সবদিন মাঠে যেতে পারতাম না। তাই প্রথম এগারোর মধ্যে ছিলাম না। একদিন স্টপার শুভদা না আসায় আমাকে জোর করে নামতে বলে । আমি কোন দিন ওই জায়গায় খেলি নি । ভয়ের মধ্যেই নেমে পড়লাম। ফাষ্ট হাফে আমরা একগোলে পিছিয়ে ছিলাম। সেকেন্ড হাফে আমার জেদ চেপে গেল। জিততেই হবে । শট পাশের মধ্যে দিয়ে বল এগিয়ে নিয়ে সেকেন্ড বার এম করে মারলাম । বল ঢুকে গেল গোলে । আমাকে সবাই মাথায় তুলে নিল। আবার খেলা শুরু হলো । হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। এমন সময় আমাদের মনা বল নিয়ে প্রায় গোলের কাছে পৌঁছে গেল । তখন ওদের ব্যাক ফাউল করলো। রেফারির পেনাল্টি বাঁশি বাজলো। আবার আমার ডাক। মারলাম লেফ্ট অ্যঙ্গেলে। ঢুকে গেল গোলে। কয়েক মিনিটের মধ্যে খেলা শেষ। আমাকে জড়িয়ে ধরলো সবাই। জার্সি খুললো কেউ কেউ। আনন্দে মেতে উঠলো আমাদের দল। আর কিছু তো আমি জানি না।"

    আগের দিন কলকাতা যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগে সেন্টু পৌঁছে প্রনাম করলো শঙ্করদাকে । শঙ্করদা মুখ চোখ দেখে মনে হলো আগের রাতে ঘুমায় নি । জড়িয়ে ধরলো সেন্টুকে । কাঁদতে লাগলো বাচ্চা ছেলের মত। সকলে বুঝালো । শঙ্করদা পাঁচ হাজার টাকা , দুটো নতুন জামা প্যান্ট সেন্টুর হাতে দিল । বলল," অনেক বকেছি ,মেরেছি । কিছু মনে রাখিস না। অনেক বড়ো হয়ে তুই আমাকে মোহনবাগান মাঠটা একবার দেখাবি। "

   ট্রেন ছাড়লো সেন্টু নির্বাক হয়ে দেখতে লাগলো ছেড়ে যাওয়া শঙ্করদা সহ সকলকে। সবাই যাকে হৃদয়হীন বলে ভাবতো তার মধ্যে এতবড়ো মন আছে কেউ জানতো না। সেই শঙ্করদার চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়লো।

Post a Comment

Previous Post Next Post