প্রেরণা আর তুহিনের সুখের সংসার। তুহিন সরকারি অফিসে উচ্চপদে কর্মরত।পর্ণা এখন গৃহবধূ। যখন বিয়ে হয় তখন পর্ণা একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করত। কনসিভ করার পর চাকরিটা ছেড়ে দেয়। তুতান ওদের একমাত্র সন্তান। তুতান একটু বড় হওয়ার পর তুহিন পর্ণাকে চাকরিতে জয়েন করার পরামর্শ দেয় কিন্তু ছেলেকে সময় দিতে পারবে না বলে আর জয়েন করেনি।
ছেলেকে নিজের মনের মতো করে মানুষ করতে চায় পর্ণা তাই সবকিছু ছেড়ে শুধু ছেলেকে নিয়েই থাকে।ছেলেও মায়ের খুব বাধ্য।
তুতান এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। ছোটো থেকেই তুতান পড়াশোনাতে ভালো। স্কুলের শিক্ষকরাও ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যেমন আচার-ব্যবহারে, তেমনি পড়াশোনাতে ----- ও যে এবার স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে সে ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত।
পর্ণার ইচ্ছে ছেলে আই.আই.টি.তে পড়ুক। তাই দিন-রাত এক করে চলছে প্রস্তুতি। তুতানের সব ব্যাপারে তীক্ষ্ণ নজর পর্ণার। তুতান যে ওর গর্ব। সবাই যখন বলে --- " হীরের টুকরো ছেলে তোমার" অথবা "আজকের দিনে এমন ছেলে পাওয়া যায় না" তখন গর্বে ওর বুকটা ভরে যায়। মনে মনে ভাবে, এর জন্য কম কষ্ট করতে হয়নি। শুধুমাত্র চাকরি নয়, নিজের শখ-আহ্লাদটুকুও বিসর্জন দিতে হয়েছে। আই.আই.টি.টা পেয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত।তারপর নিজের মত করে সময় কাটাবে পর্ণা।
পর্ণাদের পাশের ফ্ল্যাটে বিলাসবাবুরা এসেছেন বছর দুয়েক আগে।ওঁর স্ত্রী প্রজ্ঞার সাথে মাঝে মধ্যে কথা হয় পর্ণার। আসলে ওদের সময় খুবই কম। দুজনেই আই.টি.সেক্টরে কাজ করে।সকালে বেরিয়ে ফেরে সেই রাত্রে। ওদেরও এক ছেলে --- রিমিল। রিমিলও এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে।ও তুতানের স্কুলেই ভর্তি হয়েছে। তুতানের কাছেই শুনেছে রিমিলও নাকি আই.আই.টি.র প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভাবলেই হাসি পায় পর্ণার। এই ছেলে পাবে আই.আই.টি.? পড়াশোনার বালাই নেই। সারাদিন ফুটবল নিয়ে মেতে রয়েছে। বাবা-মা বেরিয়ে যায় আর টিভিতে শুরু হয় ছেলের ফুটবল খেলা দেখা। মাঝে মাঝে টিভির আওয়াজ পায় তো পর্ণা।
সেদিন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল তুহিন আর পর্ণা। সামনের মাঠে রিমিলকে ফুটবল খেলতে দেখে পর্ণা বলে ------
----- রিমিলকে দেখেছো। সামনেই উচ্চমাধ্যমিক জয়েন্ট। পড়াশোনা নেই সারাদিন শুধু ফুটবল খেলা।ঝড় জল যাই হোক না কেন মাঠে ফুটবল পেটা চাই-ই চাই। মাধ্যমিকে যে রেজাল্ট করেছে তা তুতানের ধারে কাছেও আসবে না। আমি তো তুতানকে বলে দিয়েছি ওর সাথে মিশতে না।ওর বাবা-মা কেন যে কিছু বলে না কে জানে।
---- দ্যাখো, হয়তো ও ওদের কথা শোনেই না।
---- তার জন্য সময় দিতে হয় ছেলেকে। শুধু টাকার পেছনে দৌড়োলে হয় না।
----- ছাড়ো ওদের কথা। তুতানের প্রস্তুতি কেমন চলছে তাই বলো। আশা একটাই, তুমি যেভাবে আদা জল খেয়ে লেগেছো তাতে ওর ভালো রেজাল্ট হবেই।
---- সেইরকমই তো আশা করছি। দেখা যাক কি হয়।
পরীক্ষার আর মাস দুয়েক বাকি। তুতানের ব্যবহারে বড় পরিবর্তন দেখছে পর্ণা। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে না। কথা কমই বলতো, এখন যেন তা আরও কমে গেছে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে অন্যমনস্কভাবে। প্রথমে ভেবেছিল সামনে পরীক্ষা - চাপ বাড়ছে তাই হয়তো এরকম করছে। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল ততই ওর ব্যাবহার অস্বাভাবিক ঠেকে পর্ণার কাছে।
ডাক্তার-ওষুধ করেও অবস্থার বিশেষ উন্নতি হল না। তুহিন -পর্ণা দুজনেই চিন্তিত হয়ে পড়ে। এক ডাক্তারবাবুর পরামর্শে ওরা তুতানকে নিয়ে যায় সাইকোলজিস্টের কাছে। তুতানের সাথে কথা বলে উনি বলেন যে, তুতান ডিপ্রেশানে ভুগছে। ওর চাপ কমাতে হবে। দিশেহারা হয়ে পড়ে পর্ণা। অবশেষে ওই বছরটা ড্রপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পড়াশোনা থেকে তুতানকে একদম সরিয়ে দেয়। আগেতো ছেলেটা সুস্থ হোক। ডাক্তারবাবুর পরামর্শে রোজ বিকেলে খেলার মাঠে তুতানকে পাঠায় পর্ণা। ছোটোবেলায় খুব ছবি আঁকতে ভালোবাসতো তুতান। পড়াশোনার চাপে তা বন্ধ হয়ে যায়। প্রেরণা আবারও ওর হাতে তুলে দেয় রং তুলি। রিমিলও এখন মাঝেমধ্যে এসে তুতানের সাথে গল্প করে যায়।
একদিন রিমিল আর প্রজ্ঞা মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়। রিমিল পর্ণার হাতে মিষ্টি দিয়ে পা ছুঁলে পর্ণা জিজ্ঞেস করে --- কীসের মিষ্টি রে বাবা।
প্রজ্ঞা বলে ----- আই.আই.টি.তে ওর হয়েছে। তাই তোমার আশীর্বাদ নিতে এসেছে।
নিজের ভুলটা বুঝতে পারে পর্ণা। এতোটা চাপ না দিলে হয়তো আজ তুতানের এতোদিনের পরিশ্রম সার্থক হত।