স্বপ্নাকে সবাই বলে সে নাকি আর পাঁচটা মানুষের মতো সুস্থ না, মানসিক দিক থেকে তার বেশ কিছু সমস্যা আছে। প্রথমে রে রে করে তেড়ে গেলেও, এখন সে নিজেও তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে একটু একটু করে। তবে আসুন স্বপ্নার সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিই, কেন একটা চনমনে প্রাঞ্জল মেয়ে ধীরে ধীরে অন্ধকারের অতল গভীরে হারিয়ে গেল।
ছোটোবেলায় ওই বয়স ওজন বছর সাতেক হবে চোখের সামনে নিজের দাদুকে ট্রেনে কাটা পড়তে দেখে সে। বাড়ির সবাই মিলে যখন হাওড়া স্টেশনে গেল বুক ভরা আশা নিয়ে ভাইজাকে গিয়ে তারা খুব.. মজা করবে, সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা অপূর্ব স্থানে আনন্দে হারিয়ে যাবে; তখনও তারা জানত না তাদের জন্য ঠিক কী অপেক্ষা করছে। যথারীতি তারা ট্রেনে উঠে পড়ল, সপ্না তো ট্রেনে উঠেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল তার প্রথম ট্রেন ভ্রমণ বলে কথা। ট্রেন কিছুটা যাবার পর থেমে গেল হয়ত সঠিক সিগন্যাল এর অপেক্ষা করছিল। এইদিকে ট্রেনে বসেই স্বপ্না তার দাদুর সাথে বল খেলছিল, হঠাৎই বলটা ছিটকে পড়ল পাশের লাইন এ। তখন দাদু বলল- 'দিদিভাই আর তো বল খেলা যাবে না, তোমাকে ভাইজাকে নতুন একটা বল কিনে দেব তারপর দুটিতে মিলে খেলব'। তা শুনে স্বপ্নার সে কী কান্না না না আমার ওই বলটাই চাই আমাকে ওটাই এনে দাও না দাদাই। নাতনির কান্না দেখে আর সে থাকতে পারল না বলল আচ্ছা তবে এনে দিচ্ছি। স্বপ্নার মা বলল- 'না বাবা থাক কোথায় ট্রেন টা ছেড়ে দেবে তাছাড়া যদি ওই লাইন এ কোন ট্রেন চলে আসে! আপনাকে যেতে হবে অতুল যাচ্ছে'।
না গো মা দিদিভাই আমাকে যেতে বলেছে আমি এই যাব এই আসব। কিন্তু সেই যে স্বপ্নার দাদু গেল আর এল না এল খন্ড। কথায় বলে নিয়তি খন্ডাবে কার সাধ্য.. দাদু তো বলটা হাতে নিয়ে আসতেই যাচ্ছিল এমন সময় পা গেল লাইন এ আটকে অনেক চেষ্টা করেও তা আর ছাড়াতে পারল না! শুধু বলটি স্বপ্নার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল এই নাও দিদিভাই।
– দাদাই ও দাদাই, দাদাই তুমি উঠে এসো না..
-এই তো দিদিভাই যাই।
চোখের সামনে নিউ দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস টুকরো টুকরো করে দিল স্বপ্নের দাদাই কে, শুধু দাদুর গলা দিয়ে শোনা গেল দিদিভাই….। চোখে সামনে এই দৃশ্য খুব প্রভাব ফেলে তার মনে ও মস্তিষ্কে। তারপর বেশ কয়েক মাস স্বপ্না ফ্যাল ফ্যাল করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে, কারোর সাথে কোন কথা বলে.. কোন কথার উত্তর দেয়না যেন এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা আছে তার আশেপাশে। অনেক লোকের মধ্যেও সে একা। তাকে আর কখনোই ট্রেনে চাপানো সম্ভব হয়নি। সে যখন একটু বড় হলো তখন বাড়ির সবাই তাকে বলতে লাগল বোঝাতে লাগল দাদাই এর মৃত্যুর জন্য সেই দায়ি। সে যদি ওইদিন জেদ না করত দাদাই আজ জীবিত থাকত। এই সব কথা তার বুকে তিড়ের ফলার মতো বিঁধত, 'দাদাই এর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ি! হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই দায়ি' এই চিন্তা আর যন্ত্রণা তার মনকে কুঁড়ে কঁড়ে খেত। সে একাকী বলে থাকলে তার মনে হতো কে যেন ফিস ফিস করে তার কানে এসে বলছে– 'দিদিভাই বল খেলবে না!'
তারপর যখন স্কুলে পড়ে ওই দ্বাদশ শ্রেণি, তখন একদিন স্বপ্না প্রতিদিনের মতোই বিকেলে একটু হাঁটা হাঁটি করতে বেরিয়েছে.. এমন সময় তার প্রিয় টম জামা ধরে বারবার টানছিল ঠিক কী যেন দেখাতে চাইছে। স্বপ্না গিয়ে দেখে রাস্তার এক পাশে লুটিয়ে পড়ে আছে তারই স্কুলের বন্ধু নীশা, চারিদিকে কত রক্ত! স্বপ্না আবার চুপ, আবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে একদৃষ্টে! ঠিক যতক্ষণ না পর্যন্ত একটা বিশাল দানবের ন্যায় বারো চাকার লড়িটি একটা বিকট আওয়াজ করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। স্বপ্না রাস্তার পাশেই বসে পড়ল টম ও গিয়ে স্বপ্নার কোলে নিজের জায়গা করে নিল। স্বপ্না বসে বসে ভাবছে আমি ওই যে নীশা কে একটা ধাক্কা দিলাম তখনই কী নীশা… না! বলে হাত টা ছিটকে দিতেই ছোট্ট টম রাস্তায়, টম উঠে আসার আগেই সব শেষ স্বপ্না দেখে রাস্তায় একটা সাদা লোমশ ছোট্ট কুকুর ছানা কেমন যেন দলা পেকে লাল চাদরে ঘুমিয়ে আছে। শুধু ঘুমিয়ে না চিরঘুমিয়ে আছে। স্বপ্না ততক্ষণ ওখানেই বসে রইল যতক্ষণ না তার বাবা তাকে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। একদিনে পরপর কাছের দুজনের মৃত্যুতে স্বপ্না আবারও পাথর হয়ে গেল, তার চোখ থেকে এক ফোঁটাও জল পড়ল না চোখ যেন স্থির হয়ে গেল। সায়েন্স এর মেধাবী ছাত্রী স্বপ্না যে কীনা ছিল গোটা স্কুলের উজ্জ্বল ভবিষ্যত সেই এখন আপাদমস্তক অন্ধকারে ডুবে আছে। স্বপ্না আর হাসে না, খায় না এমনকী ঘুমায় না দিবরাত্রী পড়ে পড়েই চলে আর বলে– 'নীশা বলেছিল ও এইবারে প্রথম হয়ে দেখাবে, আমাকে নীশা কে হারাতে হবে।' 'ক্লাসে শুধু একজনই ফার্স্ট হতে পারে সেটা স্বপ্না চৌধুরী আর অন্য কেউ না'। 'আহা স্বপ্না কে হারাবে ওত সোজা, না আমাকে আরও আরও পড়তে হবে'। বিকেল হলেই টমে র গলার চেন টা কে ধরে বলে– 'চল.. টম, আমরা একটু বেড়িয়ে আসি নীশা র কতটা পড়া হলো দেখি চল।'
স্বপ্না বোঝে না বুঝতেও চায়না টম নীশা আর বেঁচে নেই, আর চাইলেও তাদের কাছে যাওয়া সম্ভব না।
Dr. ROY স্বপ্না র চিকিৎসা করে ওকে অনেকটা সুস্থ করে তোলে আগের মতো আর ভুল বকে না, নিজের পড়াশোনা নিয়েই থাকে। স্বপ্না নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ডাক্তার হবার স্বপ্ন। উচ্চমাধ্যমিক ও NEET Exam এ Rank করে। ওই যে ভগবান বুদ্ধি দিয়েছিলেন দুহাত ভরে আর সুখ ও ভাগ্য! না থাক।
ডাক্তার তো হলো স্বপ্না কিন্তু ডাক্তারি করা বেশিদিন হলো না, কয়েক বছর যেতে না যেতে তার ডাক্তারি করার স্বপ্ন ও চিরতরে ভেঙে গেল কী না ওই সে নাকি সুস্থ নয়। এইরকম ডাক্তার থাকলে হসপিটাল এর নাম খারাপ হবে তাছাড়া patient দের জীবন মরণ এর প্রশ্ন যেখানে অগত্যা আর কী..
স্বপ্না অন্যমনস্ক হতে পারে কিন্তু সে patient দের কোন ক্ষতি করতে পারে না এটা আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি। আমি জানি স্বপ্না ঠিক কতটা নিখুঁত ভাবে রোগীদের সাথে কথা বলে তাদের সমস্যা জানার চেষ্টা করত। যে স্বপ্না একটু একটু করে আলোর দিকে এগিয়ে আসছিল তাকে সবাই মিলে আবার অন্ধকারে ঠেলে দিল, স্বপ্না আরও গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যেতে লাগল।
স্বপ্না কে এখন কেউ ওই ব্যাপারে প্রশ্ন করলে সে বলে--'সবাই বলে আমি নাকি মানসিক রোগী তাই হবে হয়ত, তবে জানো আমি শুধু আমার দাদাই এর ডাক শুনতে পাই এই কদিন দিদিভাই…'
'ওই দেখ ট্রেন আসছে দাদাই ও দাদাই.. দাদাই উঠে এসোনা দাদাই না….'
আবার বলল– 'ওই নীশা কী বলছে ও নাকি first হবে হ্যাঁ আমিই হবো..' ওই নীশা আমাকে মারতে আসছে
বলছে স্বপ্না শুধুমাত্র প্রথম হবি বলে এইভাবে আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলি। না না নীশা বিশ্বাস কর আমি তোকে মেরে ফেলতে চাইনি আমি তো তোকে শুধু একটু ধাক্কা দিয়েছি, আমি তোকে মারতে চাইনি নীশা।
না স্বপ্না তুই আমাকে মেরে ফেলেছিস আমার কাছ থেকে আমার বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছিস।
না.. না.. আমি কিছু করিনি। এই টম তুই কিছু বল
এ.. কী! টম তোর গোটা গায়ে ওটা লাল লাল কী? রক্ত! (দিদি তুমি আমাকে ঠেলে দিলে?)
না টম না আমি তোকে ঠেলতে চাই নি আমি তোদের কাউকে মারতে চাইনি। নীশা একদম আমার কাছে আসবি না একদম না, টম আমার থেকে দূরে যা ও.. রক্ত কত রক্ত আমি আর দেখতে পারছি না। আমার এই দুহাতে শুধু রক্ত আর রক্ত লেগে আছে। হাত ধুলেও কিছুতেই যাচ্ছে না, যা.. যা..রক্ত যা..।
'না আমাকে স্নান করে হসপিটাল এ যেতে হবে'। এই বলে স্নান সেরে একটা ব্যাগ নিয়ে ডাইনিং এর সমবায় বসে একা একাই বলতে থাকে– 'আপনি ঔষুধ খাচ্ছেন না ঠিক করে এইভাবে চললে কী করে হবে? কি আপনার জিব টা দেখি অ্যা.. করুন অ্যা good, এরপর থেকে কিন্তু কোন বেনিয়ম না সময় মতো ঔষুধ খাবেন'। নেক্সট.. 'এই কি রামুকাকা মুন্নির বুঝি আবার জ্বর হয়েছে? ও..হো কী যে করি.. এই তুমি কিন্তু মুন্নির যত্ন নাওনা একদম, যত্ন নেবে তো ভালো করে'। মুন্নি তুমি কিন্তু ঠিক ঠিক করে ঔষুধ খাবে, আর ডিম দুধ খেতে হবে রোজ। কেননা দুধ না খেলে.. হবে না ভালো ছেলে। না আমাকে আবার round এ যেতে হবে nurse patients দের ফাইল টা দাও জলদি করো। কী সব ঠিক তো? কেমন বোধ হচ্ছে এখন? দাদু তোমার বুকের চাপ লাগা টা কী একটু কমেছে না একই আছে?
এইভাবে কিছুক্ষন চলে তারপর হঠাত যেনো হন্ত দত্ত হয়ে এসে বলে– 'ও.. মা খেতে দাও আজ হসপিটাল এ অনেক চাপ ছিল'। এই কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলতে থাকা মা একটু পায়ের গতি ফিরে পায়। চোখের জল মুছতে মুছতে বলে– 'আই মা বস আমি দিচ্ছি'। বাবার চশমা তখনও ঝাপসা, কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। চোখের নোনা জল ঝাপসা করে তুলেছে চশমার কাঁচ।
এইভাবেই প্রতিটি দিন কাটতে থাকে স্বপ্নার, তার মায়ের আর বাবার। একটা মেধাবী ছাত্রী, একটা পাশ করা দরদী ডাক্তার আজ নিজের মন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। স্বপ্না স্কিৎজোফ্রেনিয়া তে আক্রান্ত, সে সব হ্যালোসিনেশন করতে থাকে, একা একা কথা বলে চিৎকার করে। এই কেঁদে ওঠে আবার পরক্ষণেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠৈ। দাদাই নিশা টম এই এদের মধ্যেই তার জীবনটা গোল গোল লাট্টুর মতো ঘুড়তে থাকে, আমি জানিনা কোনোদিন এই লাট্টু তার গতি কম করে শান্ত হবে কীনা? আমি জানিনা!
আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে আমি এত কথা জানলাম কীভাবে? আমার সাথে স্বপ্নার ঠিক কী সম্পর্ক? আমি হলাম স্বপ্নার- আপনার আপনাদের প্রত্যেকের শুভাকাঙ্ক্ষী। আমায় আপনাদের প্রত্যেকের একটা কথা মাথায় রাখা উচিত, মানসিক রোগ কোন ব্যঙ্গ বিদ্রুপ এর বিষয় নয়। মানসিক রোগ যে কতটা মারাত্মক ও যন্ত্রনাদায়ক হতে পারে, কীভাবে একটা প্রাণবন্ত মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে স্বপ্না তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। আসুন আমরা সবাই একত্রে চেষ্টা করি তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে, তাদের কথা মন দিয়ে একটু শুনতে তাদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে।
মনের রং হোক না যতই ফ্যাকাশে
ক্ষতি কী আর আছে!
যদি কাঁধে ভরসা র
হাতটি থাকে,
অন্ধকার দূরে গিয়ে
আলো ঠিকই আসবে কাছে।