শারদীয়া। :: তপন মাইতি


 

প্রিয় সুমি 

ভোরবেলা ধানের শীষ দুলে দুলে পড়ে অ-আ-ক-খ।আকাশের ব্যাগে বর্ণপরিচয়,সহজপাঠ, ধারাপাত। শিউলী তলায় লুকোচুরি রোদ-বৃষ্টি-ঝড়। সবুজ সজীব বাগানে হীরে চুন্নি জহরত আর শিশির-দুর্বার প্রেম ভালোবাসার গল্প। মহালয়ার ভোরে দাদুর হাতে চড় থাপ্পর খাওয়া ভাঙা রেডিও তে সেই চেনা বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মনে পড়ে….এখন টিভির সামনে প্রিয় মানুষের পাশে গোল হয়ে বসার জো নেই। দু বছর যা হচ্ছে ! আমি ডলি তিতাস পচা গুয়া টিকি পাঁচু চমতকারী চলে যেতাম,মঈন আলির দিঘি। ডোঙায় চড়ে লাল-নীল-সাদা পদ্ম শাপলা তুলে আনতাম। পুজো হবে, চারদিক খুশির খবর, ঘরে ফেরার তাড়া, আনন্দের ঢল, ঢাঁই কুড়াক্কুড়াক্কুর গিড্ডামটর…কাঁই না না…।একটা আলাদা ভাল লাগা, একটু অন্যরকম অনুভূতি,ঠাকুর বলতে দুক্রোশ পায়ে হাঁটা বাংলা মোড়ের বাজারের উপর ওঠা ঠাকুর। আমাদের যাওয়া আসার রাস্তায় মাড়া পড়ে যেত। প্রতিমার পটুদার কখন কী করছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আমি মায়ের কাছে বলতাম। মা কবে মায়ের চোখ আঁকা হবে?ভালো করে মুখ দেখব কবে মা? মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন ‘এত অস্থির হতে নেই বাবা…ধৈর্য্য ধর।’ধৈর্য্য কী মা?মা কী সব বলতেন মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত কানে ঢুকত না। পঞ্চমীর দিন কলকাতা থেকে মেনকা পিসি আসে। চাকুরিয়া পরিবার। অন্তরা আপ্পু বরিশাল থেকে আসে ষষ্ঠীতে। ব্যবসায়ী পরিবার। আমাদের জন্য যে যা পারে নিয়ে আসে।মরা হাজা ছেলেটা মানে আমার একটু আদর আবদার আপ্যায়ন বেশি।আড়ালে আবডালে ডেকে অনেকে অনেক কিছুই দেয়…এগুলোয় বেজায় রাগ করত আমার মা বাবা। ভাঁজ করে গোছানো নতুন জামাকাপড় গুলো বের বলে ‘এ বছর বড় হাত খালি, এই তো আমফান, ইয়াশ দেখলি!তার উপর করোনা পেনডামিক পরিস্থিতি!এ বছর এই গেঞ্জিতে সন্তুষ্ট হ বাবা…পাশের বাড়ি রেবি কাকিমা এ ওর কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে জোগাড় করেছি, মায়ের এক সাগর চোখের জল হাত দিয়ে মুছে দিয়ে বললাম ‘কাঁদছ কেন মা !আমি তো আছি !’ মহাষ্টমীর দিন বড় পুজো।মায়ের উপহাস,নিরামিষ রান্না,পুষ্পাঞ্জলী,রাতে সন্ধ্যারতি,ধুনুচি নাচ….

কালা হাবা বোবা স্টিফেন কাকুর বৌ বেচারার জনম ভর অভাব অনটন। তার হাতে কত কিছু গুঁজে দিতে দেখেছি মাকে। অল্পভাষী কাকিমা কান্না করে বলতেন ‘তোমার মতো মানুষ হয় না… দেখ একদিন না একদিন ঠিক দিন ফিরবে দেখে নিও।’



এদিকে বেজে ওঠে পুজোর গান, কাশবনের গায়ে লাগে হাওয়া,চারদিক ছুটির গন্ধ,শহরে থিম পুজোয় অজস্র ভিড়ে প্যাণ্ডেল বন্ধ। মায়ের কোন ভাই নেই আর আমার কোন বোন নেই। দাদা শিল্পী মানুষ। পুজোর মাসে দারুণ ব্যাস্ত। জ্ঞান পড়া অবধি দেখেছি আমার মায়ের যাওয়া নেই কোথাও! সংসার সামলানোই তিনি একাই একা দশভুজা। দিন রাত প্যারালাইসিস শাশুমা আর ডায়াবেটিস শ্বশুর মশাই করেই গেল। পুজোর চারদিন মানে প্রচুর ঠাকুর দেখা, হইহুল্লোড়, প্রচুর অনুষ্ঠান, রাতজাগা ঘুম, প্রচুর খাওয়া দাওয়া,গাল গপ্প আড্ডা…আরও অনেক কিছু হল তবে সামাজিক দূরত্ব মেনে। বিজয়ার দিন ঘর পুকুরের কাতলা মাছের কালিয়া, ধোকা,মাংস হল না ইয়াশের প্রভাবে।কেউ বলতে পারল না ‘তোর মা যা কালিয়াটা বাগায় না…।’তবে ঘুগনি পরেটা পায়েশ হল।কারুর হাতে পাতে একটুও কিছু পড়ে রইল না। বাবা মাকে বলল ‘হ্যাঁরে তপুর মা বিজয়ার পর মায়ের ভাসান হবে। তারপর আর ঝামেলা ঝক্কি পোহাতে হবে না রে…!’

মায়ের দুচোখে দুটো নদী পদ্মা আর গঙ্গার একরাশ দুঃখ…

আর করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা


ইতি তোমার তপু 



1 Comments

Previous Post Next Post