কত রাত চলে গেছে :: অপর্ণা নাথ



মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। কালো করে আছে নেড়া পাতা ঝরা গাছগুলো। ওখানে এসে চুপটি করে বসে আছে কোকিল। সাথী হারা হয়ে। কেতকী দেখছে। তার খুব খারাপ লাগছে ‌। ভাবছে তার মতো সেও বোধহয় এমনভাবেই বঞ্চিত। প্রবাল বলেছিলো এমনি এক পূর্ণিমার রাতে। ঘাড়ে মাথায় শত চুম্বনে ভরে দিয়েছিল।  ফুরাতে চাইছিল না সে রাত। বলেছিল-"আমি দুবাই থেকে থেকে এসেই তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবো। একটা কাজ না করে নিয়ে গেলে তেমন সম্মান পাবে না। বাড়িতে একা লাগবে তোমার।" সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারেনি কেতকী।

 

কোকিল কেমন কহু কুহু ডাক ছাড়ে। ও কি তার সঙ্গীকে দেখেছে? না তার মতো বিরহের ব্যথা ধরে না রাখতে পেরে কাঁদছে। সাত পাঁচ ভাবছে কেতকী। মনে পড়ে যাচ্ছে তার ছেলেবেলার বান্ধবীর কথা। তারা দুজন মিলে কোকিল কুহু কুহু ডাকলেই কোকিলের মতো ডাকতো। ভীষণ ভালো লাগতো তাদের। দোল পূর্ণিমার রাতে তারা কি মজায় না করতো। সময়ের সাথে সেসব হারিয়ে গেছে।


আজ ও ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে দোল পূর্ণিমা বলে। ছেলেটা হোমে থাকে। একজন অবিবাহিত মেয়ের সন্তান সমাজ সংসার মেনে নেবে না। কত বার গেছে প্রবালের মা বাবার কাছে। একটু যেন ছেলেটার স্বীকৃতি দেয়। চিঠির পর চিঠি পাঠিয়েছে প্রবালের কাছে। উত্তর আসেনি। পূর্ণিমার রাত হলেই তাই ছাদে চলে আসে কেতকী। এভাবে চলে যায় রাত। চাঁদের হাসি থাকে অম্লান। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভোর হয়ে যায়। চাঁদ তখনো হাসে। কোকিল গাছ ছেড়ে চলে যায় সে জানতেও পারে না।


ঘরের কাজ করার জন্য কেতকীর মা বাইরে বেরিয়ে আসে। ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁট দেয়। মুখে সদ্য ফোটা সকালে মেয়েকে তিরস্কার করে-" বলি কাব্যিক ভাব গেল। না এখনো বাকি আছে? এসে কি কাজ কর্ম করতে হবে না ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে পেটের ভাত জুটে যাবে।" মায়ের তিরস্কার শোনা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। এছাড়া তো উপায় নেই।


পূর্ণিমার রাত হলেই কেতকী ছাদে চলে যায়। একা একাই কত কথা বলে। এভাবে কত রাত চলে গেছে  তার ঠিক নেই। এখন কেতকী শুধু ছেলেকে কাছে পেতে চাই। শুধু বলে -"চাঁদ তুমি আমার ছেলেকে এনে দিতে পারো। ও কত বড় হয়েছে জানো?" কোন উত্তর পায় না চাঁদের কাছ থেকে। কেতকীর চুলে জট ধরেছে। চেহারায় তামাটে গড়ন এসেছে। দু'চোখে ঝাপসা দেখে। তবে পূর্ণিমার রাত তার কাছে আজও তেমন হয়েই আছে। সকাল দুপুর রাতে মানুষ যেভাবে খিদে বুঝতে পারে ঠিক তেমনি পূর্ণিমা রাত তার স্মৃতির পাতায়।


কেতকীর মা আসে এমনি কত রাতে তার পিছন পিছন। কারণ রাতে যদি কোন অশরীরী আত্মা তাকে কোনরকম শাস্তি দেয়‌। সেই ভেবে। দেখে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মেয়ে কখনো হাসে। কখনো কাঁদে। গাছের শাখে কোকিল বা কোন পাখি বসে থাকলে বলে-" যা না আমার প্রবালের কাছে। ওকে আসতে বল। কত রাত আর এভাবে কাটাবো। ওর ছেলেটা যে অমানুষ হয়ে গেল। কেতকীর মা নিরুপায়ের মতো শুধু অশ্রু বিসর্জন করে। এছাড়া যে আর কোন উপায় নেই। সমাজ সংসারে কেতকীর মতোই হয়তো আরো কত জনের এভাবেই কত রাত চলে যায়।

                  *সমাপ্ত*

Post a Comment

Previous Post Next Post