জামাইষষ্টি :: রঞ্জিত দে



       কেষ্টপুরের খালের ধারে ঝুপড়িতে সাজো সাজো রব। আজ জামাইষষ্টি নতুন জামাই আসবে। 

           গুনধরের একটাই মেয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিশি বোতল লোহালক্বর পুরোনো খবরের কাগজ ফেরি করে বেড়ায় গুনধর তারপর সেগুলো বড় একটা বস্তায় ভরে কাঁধে ঝুলিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে বস্তা ভরে গেলে তারপর সেগুলো পুরোনো লোহালক্বর খবরের কাগজ কেনাবেচার দোকানে গিয়ে বিক্রি করে বাড়ি ফেরে গুনধর। এছাড়া রথের মেলা দুর্গা পুজো বা কোনো বড় পরব থাকলে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে চপ তেলেভাজা বিক্রি করে দুপয়সা কামায়। বউ মঙ্গলা লোকের বাড়িতে কাজ করে। দুজনের আয়ে ওদের সংসারটা কোনোরকমে চলে যায়। একমাত্র মেয়ে মিতু যখন ছিল তখন সেও মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করত।,আর এখন তো ওর বিয়ে হয়ে হয়ে গেছে মাত্র কয়েকটা মাস আগে আর আজ জামাইষষ্টি, কিছুক্ষণ পরেই মেয়ে জামাই চলে আসবে। বউয়ের চাপে তাড়াতাড়ি করে বাজারের একটা ব্যাগ নিয়ে বাজারে বেরিয়ে পড়ে গুনধর।নতুন জামাই বলে কথা একটু আপ্যায়ন তো করতেই হবে আর একমাত্র মেয়ের জামাই। 

              সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তায় জল জমে সে এক একাকার কান্ড। আকাশটা পুরো কালো হয়ে রয়েছে, মিতু শেষ বাড়ির কাজ সেরে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ির পথে। বাগুইহাটিতে এক বাড়িতে কাজ করতো মিতু,সেই বাড়িতে একটা ছোট অনুষ্ঠান ছিল বলে মিতুর বেরোতে দেরি হয়ে যায়,আকাশ তখন কালো মেঘে ছেয়ে রয়েছে কিন্তু বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে বলে তখনই বেরিয়ে পড়ে মিতু,ভেবেছিল বৃষ্টি পড়ার আগেই বাড়ি পৌছে যাবে।বাগুইহাটি থেকে কেষ্টপুর হাঁটা পথে মিনিট কুড়ি পঁচিশ লাগে।মিতু হেঁটে যেতে যেতে মাঝপথেই হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমে যায়, তখন মিতু দৌড়ে গিয়ে সামনের একটা বন্ধ গুমটি দোকানের ছাউনির তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।ওখানে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টি পড়ছে বলে, কিন্তু বৃষ্টি তো কমেই না উল্টে আরো বেড়ে যায়। 

            সেলিম রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিল ভাড়া খাটতে। কয়েকটা প্যাসেঞ্জার তুলে যখন ভাড়া খাটছিল তখনই আকাশটা কালো হয়ে গেছে। প্যাসেঞ্জারদের জায়গায় জায়গায় নামিয়ে ও যখন খালি রিকশা নিয়ে বাগুইহাটি রিকশা স্ট্যান্ডে ফিরছিল, তখনই হঠাৎ করে খুব জোরে বৃষ্টি নেমে পড়ে। কোনোরকমে রিকশাটা একটা বন্ধ গুমটি দোকানের সামনে রেখেই দৌড়ে দোকানের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়, এমনিতেই বেশ ভিজে গেছে সেলিম আর দমকা হাওয়াও দিচ্ছে খুব, কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর বৃষ্টি সামান্য ধরে এসেছে বটে কিন্তু তাও বেশ জোরেই পড়ছে ,সেলিম কি আর করে বৃষ্টি কমার জন্যে দোকানের তলাতেই অপেক্ষা করতে থাকে। 

          বৃষ্টি সামান্য একটু কমেছে কিন্তু থামার কোনো লক্ষন নেই। মিতু ভাবছে কি করবে, বৃষ্টির ছাঁটে শরীরের পোশাক পুরো ভিজে গেছে এমনিতেই অনেক পুরোনো শালোয়ার কামিজ, আর ব্যবহার করতে করতে সেটাও বেশ পাতলা হয়ে গেছে আর ভিজে গিয়ে এমনভাবে শরীরে লেপটে গেছে যে মিতু কোনোরকমে দুহাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে, পাশে লোক দাঁড়িয়ে আছে, ভেবে আরো লজ্জা লাগে মিতুর।তাই কিছুটা ভেবে ঠিক করে পুরো যখন ভিজেই গেছে তখন শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই,ভাবা মাত্রই দোকানের তলা থেকে বেরিয়ে হাঁটা মারে মিতু,রাস্তার সামনের দিকে বেশ খানিকটা জল জমে গেছে, মিতু সাবধানে পা ফেলে এগোতে থাকে, হঠাৎ করে পা টা পিছলে একটা গর্তে পড়ে যায়,সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে জমা জলে পড়ে চিৎকার করে ওঠে মিতু,জলকাদায় পুরো মাখামাখি হয়ে গেছে শরীরটা। হঠাৎ কেউ একজন কেউ ওকে টেনে তোলে, কোনোরকমে গর্ত থেকে পা বার করে মিতু কিন্তু হাঁটতে আর পারেনা, লোকটা বলে- মনে হয় আপনার পায়ে খুব লেগেছে আপনি যাবেন কি করে, কোথায় থাকেন আপনি,

-- আমি কেষ্টপুরের খালের ধারে ঝুপড়ি বস্তিতে থাকি --যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে মিতু বলে। ব্যথায় ওর চোখ থেকে জল বেরিয়ে গেছে সেটা বোঝার উপায় নেই কারণ ওর চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিলে একাকার হয়ে গেছে তখন,লোকটি বলে আপনি মনে হয় আর হাঁটতে পারবেন না, চলুন আমার রিকশা আছে ওতে উঠিয়ে আপনাকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দিই।মিতুর হাঁটার কোনো উপায় নেই পা টা গর্তে পড়ে মচকে গেছে,তাই অনিচ্ছা সত্বেও এই অবস্থার কথা ভেবে মাথা নেড়ে সায় দেয়। লোকটি তখন ওকে কোনোরকমে ধরে রিকশায় তোলে, তারপর আস্তে আস্তে প্যাডেল করে এগোতে থাকে, মিতু রিকশায় বসে দুদিকে দুটো হাত দিয়ে ধরে রাখে।আর একটা পা দিয়ে আরেকটা পা চেপে রাখে খুব যন্ত্রনা হচ্ছে ওর ওই পায়ে। 

    রিকশা চালাতে চালাতে লোকটি বলে-- আমাকে বলে দেবেন কোথায় নামাতে হবে, 

--- ঠিক আছে, মিতু বলে, তারপর ভাবে লোকটাও তো পুরো ভিজে গেছে তার ওপর বৃষ্টি পুরোপুরি কমেনি, মিতু বলে -আপনি তো পুরো ভিজে গেছেন আমার জন্যে আপনার তো অনেক অসুবিধা হচ্ছে, 

--- না না আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না এভাবেই আমাকে রোজ রিকশা চালিয়ে খেতে হয়, আজ প্যাসেঞ্জার নেই একদম তাই আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আবার বাগুইহাটিতে ফিরে রিকশা জমা করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবো। লোকটি বলে, 

--- কি নাম আপনার,আপনার বাড়ি কতদূর? 

-- আমার নাম সেলিম আমি থাকি সেই মানিকতলার খালপার বস্তিতে,

--- সেকি সেতো বেশ দুর, 

--তাতে কি হয়েছে আমাকে তো রোজ এখানে আসতে হয়,বাগুইহাটিতে আমার এক বন্ধু থাকে সে এখানেই রিকশা চালায় ওই আমাকে এখানে একটা রিকশা ঠিক করে দিয়েছে, ওই দিয়ে কোনোরকমে চলে যায় আমার পরিবারের, 

---- কে আছে আপনার পরিবারে? 

----- বাবা আছে, মা'ও আছে তবে মায়ের শরীর খুব খারাপ বিছানায় শুয়েই থাকে, বাবা ওখানে একটা সাইকেল ভ্যান চালাতো আগে এখন আর পারে না বয়স হয়ে গেছে বলে তাই আমি রিকশা চালিয়ে সংসার টানি কোনোরকমে, 

---আমার বাড়ি এসে গেছে এবারে একটু সাইড করে দিন রিকশা, ওই যে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে ও আমার মা, ওখানেই দাঁড়ান, 

মিতুর মা মিতুকে রিকশা থেকে খুঁড়িয়ে নামতে দেখে দৌড়ে আসে, 

---কি হয়েছে রে মিতু,পায়ে লাগলো কি করে মিতুর মা বলে, 

মিতু সমস্ত ঘটনা খুলে বলে মাকে আর বলে এই লোকটা না থাকলে খুব বিপদে পড়ে যেতাম মা, সেটা শুনে মা ওকে ধরে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়, মিতু পিছন ফিরে বলে আপনিও আসুন আমাদের ঘরে,ওর মা'ও তখন বলে হ্যাঁ বাবা তুমিও এসো আমাদের ঘরে, এত কষ্ট করেছো আমার মেয়ের জন্যে আর তুমি না থাকলে মেয়েটা যে কি করতো ভাবতেই ভয় লাগছে তাছাড়া তোমার জামাকাপড় তো পুরো ভিজে গেছে একটু বসলে কিছুটা শুকিয়ে যাবে আর আমি একটু লাল চা করছি তাতে তোমার শীত শীত ভাব অনেকটা কেটে যাবে আর আমাদের ঘরে লাল চা হয় দুধের তো অনেক দাম তাই কেনার ক্ষমতা নেই বাবা। 

সেলিম মা মেয়ের কথা ফেলতে পারে না। ওদের পিছু পিছু ওদের ঘরে ঢুকে যায়। 

       আলাপ পর্ব শেষে চা খেতে খেতে ওদের মা মেয়ের সাথে অনেক কথা হয় সেলিমের,মিতুর মা মিতুকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানায় সেলিমকে। তারপর সেলিম আদাব জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রিকশা চালিয়ে এগিয়ে যায় বাগুইহাটির দিকে। 

          একদিন দুপুরে রিকশা স্ট্যান্ডে রিকশার উপর বসেছিল সেলিম, একটু আগে ভাড়া খেটে এসেছে,, হঠাৎ একটা মেয়ে মানুষের গলা শুনতে পায়-- কেমন আছেন,সেলিম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মিতু, সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠে, 

--- কি ব্যপার আপনি এখানে?পা ঠিক হয়ে গেছে আপনার? 

---- হ্যাঁ চুন হলুদ দিয়ে রেখেছিলাম এখন পুরো ঠিক হয়ে গেছে, আর ওই যে সামনের সাদা বাড়িটা দেখছেন ওই বাড়িতেই আমি কাজ করি এখন দোকানে গিয়েছিলাম ওদের কয়েকটা জিনিস কিনতে, মিতু বলে, 

--- ও তাই নাকি খুব ভালো মাঝে মাঝে তাহলে দেখা হয়ে যাবে, সেলিম বলে

---- আজ কি করবেন বিকেলবেলায়, আমার তখন ছুটি হবে,

---- ওই, প্যাসেঞ্জার থাকলে ভাড়া খাটবো নইলে এখানেই থাকবো, 

--- আজ আমি কাজ থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়াবো, আসবেন নাকি, মিতু বলে, 

--- তাহলে আজ বিকেলে আর কোনো ভাড়া খাটবোনা,আমি যাবো, 

---- তাহলে আসুন দেখা হবে, বলে সেলিমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে যায় মিতু। 

       এরপর থেকে প্রায়ই ওদের দেখা হয়,দেখতে দেখতে ওদের মধ্যে বেশ প্রেমও হয়ে যায়,বেশ কিছুদিন কাটে এইভাবে।মিতু  সেলিমকে ছাড়া ভাবতে পারে না আর সেলিমও তাই,তারপর অনেক জল গড়ায়, মিতুর বাড়ি থেকে বিয়ের কথা উঠলে মিতু জানিয়ে দেয় ও সেলিমকে ভালোবাসে, মা তখন বলে ওরা তো অন্য ধর্মের মানুষ, ওদের বাড়িতে তোকে মেনে নেবে? 

---- মা আমি সেলিমের বাড়িতে গিয়ে ঘুরে এসেছি ওর বাবা মা খুব ভালো ওদের এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই, মিতু বলে, 

---- সেলিমকে একদিন ডাক ওর সাথে কথা বলি, তারপর ওদের বাড়িতে গিয়েও কথা বলে আসবো, মা বলে, 

--- ঠিক আছে মা, 

মিতু সেলিমকে বাড়িতে ডাকলে ও আসে তখন মিতুর মা জিজ্ঞেস করে বাবা তুমি কি আমার মেয়েকে ভালোবাসো? 

--- হ্যাঁ মাসিমা,

---- তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে? আমরা খুব গরিব বাবা, আমাদের চালচুলো নেই দেখছো তো? 

--- হ্যাঁ আমি মিতুকে বিয়ে করতে চাই মাসিমা, আর আপনি আপনাদের কথা বলছেন আমাদেরও তো একই অবস্থা, আপনার মেয়ে তো দেখে এসেছে সব, সেলিম বলে, 

---- তা বাবা তোমরা তো অন্য ধর্মের মানুষ, তোমাদের সমাজে আমার মেয়েকে মেনে নেবে? মিতুর মা বলে, 

--- মাসিমা সবার আগে আমরা মানুষ, আর গরিবের ধর্ম দেখলে পেট ভরবে না মাসিমা, আমার বাবা মা রাজি, ওরা মিতুকে মেনে নিয়েছে আর ওকে খুব ভালোবাসে আমার বাবা মা তাই তাদের কোনো আপত্তি নেই, আর আমি মিতুকে বলেছি যে তোমার যেমনভাবে ইচ্ছা তেমনভাবে থাকবে, তুমি তোমার পুজো করবে আমি আমার নামাজ আদায় করবো,আপনাদের যেকোনো অনুষ্ঠানে আমি থাকবো আমাদের যে কোনো অনুষ্ঠানে আপনারা থাকবেন,আসলে উপরওয়ালা তো একই কিন্তু আলাদা করে সবাই মানে যে যার মতো করে, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না মাসিমা। 

              তারপর একদিন বাগুইহাটিতে যে বাড়িতে মিতু কাজ করত তাদের পরামর্শে বিশেষ বিবাহ আইনে ওদের রেজিষ্ট্রি আর মালা বদল করে বিয়ে হয়ে যায় দুপক্ষের উপস্থিতিতে, তারপর মিতু চলে যায় শ্বশুরবাড়িতে।আজ জামাইষষ্টি।বরকে সাথে নিয়ে মিতু আসবে বাপের বাড়িতে। 

     বাজারে এসে প্রথমে মাংসের দোকানে যায় গুনধর,দাম দর করে একটা বেশ বড় খাসির মাথা নেয়, ওটা দিয়ে বেশ ঝোল ঝোল করে রান্না হবে, কিছু চুনোমাছ কিছু তরিতরকারি আর সামান্য ফল মিষ্টি কিনতেই টাকা শেষ, গুনধর ভাবে এই দিয়েই চালিয়ে নিতে হবে আজকের দিনটা কিছু তো করার উপায় নেই। 

          বাসে করে কেষ্টপুর বাজারে নেমে মিষ্টির দোকানে গিয়ে মিষ্টি কেনে সেলিম, পাশে শাড়ি পড়ে মিতুকে খুব সুন্দর লাগছে, তারপর হাঁটতে হা্টতে মিতুদের বাড়িতে পৌছে যায়, ওদের দেখে মিতুর মা বাবা দুজনেই বেরিয়ে আসে, মা একটু উলুধ্বনি করে মিতুকে জড়িয়ে ধরে বলে --  ওরে মিতু তোকে কি সুন্দর লাগছে আজকে আয় মা ঘরে, এসো জামাই, গুনধর জামাইকে বলে এসো বাবা ঘরে এসো, সেলিম একগাল হেসে ঘরে ঢোকে, আশপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে থাকে,,,,

Post a Comment

Previous Post Next Post