ছেলে-বৌমা অফিসে। আয়া দিবানিদ্রায় কাবু। সদ্য বিপত্নীক শিবতোষবাবু উঁকি মেরে দেখলেন, তিন বছরের ছোট্ট নাতনি বাইরের ঘরে মাদুরের ওপর ছড়ানো পুতুলের সংসারে একলা বসে বসে বেবী পুতুলকে কোলে নিয়ে বকম্ বকম্ করছে। নিঃশব্দে নাতনির কাছে এসে বললেন,
-"দিদিভাই, বড্ড মাথা যন্ত্রণা করছে।"
--"এসে চুপটি করে আমার কোলে মাথা দিয়ে একটু শোও দেখি।" নাতনি পাকা গিন্নির মতন উত্তর দিল।
তার ছোট্ট কোলে আলতো করে নিজের মাথা ছুঁইয়ে মাদুরে শুয়ে পরলেন তিনি। এইভাবে নাতনির আদেশ পালন করতেই সে তার ছোট্ট ছোট্ট কচি হাত দাদুর কপালে বোলাতে লাগলো আর আধো আধো স্বরে বলতে লাগলো,-"সারাদিন দুষ্টমি করো,মার কথা একটু শোনোনা। রোদে ঘুরে ঘুরে লাফা-ঝাঁপা খেলাধুলা না করলে চলে না? এখন মাথা যন্ত্রণা করছে বলে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পরলে! দুষ্টু ছেলে। এখন চোখ বুঁজে একটু শোও দেখি মাথায় হাত বুলিয়ে দি।" শিবতোষ বাবুর চোখের কোল জলে ভরে উঠলো। তিনি জানেন,গিন্নি নাতনিকে পুতুল খেলায় সঙ্গ দেওয়ার সময় মাঝে মাঝেই পুতুলকে কোলে তুলে এই ভাবে শাসন করতেন। নাতনির মুখে সেই ভাষা শুনে শিবতোষবাবুর বুকটা খা খাঁ করে উঠলো। শিশুকালে মায়ের আদরে, মায়ের শাসনে ; যৌবনে সংসারী হওয়ার পর স্ত্রীর সাহচর্যে জীবন কাটিয়ে আজ সঙ্গীনী হারানোর একাকিত্বময় বার্ধক্য বেলায় ছোট্ট নাতনির কন্ঠের মিষ্টি মধুর ভাষন যেন তাঁকে হারিয়ে যাওয়া কোনো এক সুখস্মৃতিকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা করে তুললো। সমস্ত শরীরে যেন কোনো এককালে সেই হারিয়ে ফেলা মমতায় ভরা স্নেহের স্পর্শ অনুভব করলেন। মনের গভীরে হয়তো এতোকাল সেই স্পর্শ ফিরে পাওয়ার বাসনা ছিল কিন্তু বাস্তবে এসকল ফিরে পাওয়া অসম্ভব,অনিচ্ছা সত্বেও এই পরম সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। আজ সেই প্রাপ্তির আনন্দে আত্মহারা বৃদ্ধ শিবতোষবাবু চোখের কোলে জল নিয়ে ব্যগ্রভাবে কপালে রাখা নাতনির ছোট্ট হাতটা চেপে ধরে বললেন,
-"তোর ছেলেকে চিনতে পেরেছিস মা?"