জানিনা কেন এসব কথা ভীড় করে আসছে কলমের ডগায়।
গতকাল অকারণে সেই দুপুর থেকে শুয়ে রইলাম। শত ডাকেও ঘুম ভাঙেনি...একটা তন্দ্রা, মন, শরীর একটা অদ্ভুত আবেগে জড়ানো।
সব থেকেও যেন কেউ নেই...কিসব যে দেখছি সেই আধো ঘুমে। কোথায় যেন আটকা পড়েছি আমরা দুজন....বেরোনোর রাস্তা নেই। সব ফোনগুলো ও হারিয়ে গেছে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই।
তোমাকে খুঁজছিলাম পাগলের মতো...আমি জানি তুমি কোথায় আছো তবুও দেখতে পাচ্ছিনা!
একটা মোবাইল ফোন বারবার বেজে চলেছে কিন্তু কোথায় খুঁজে পাচ্ছিনা তো?
অনেক পরে ঘোর কাটলো। দেখলাম নিজের বিছানাতেই শুয়ে আছি।
আর আমার ফোনটা বহুবার বাজতে বাজতস সাইলেন্ট হয়ে গেছে।
চোখে মুখে জল দিয়ে এসে চুপটি করে বসলাম। কেন এমন হলো?
আমি কি তবে শেষ হয়ে আসছি? একটু একটু করে ফুরিয়ে আসছি?
এই কি তবে শেষ লেখা আমার?
কোন অশনি সংকেত এসব?
হঠাৎ পিছনে ফিরে দেখলাম...কোনো দায়বদ্ধতা নেই তো?
উত্তর পেলাম, নাহ...কিচ্ছুটি নেই।
সংসার, পরিজন সব যে যার মতো আপন রথের রশির টানে, তাহলে আর কীসের পিছুটান?
তাই মনে হলো"তাহাদের কথা"।
একটু ফিরে তাকাই? বলার আর না বলার মাঝে একটু জিরোই?
কে আর মনে রাখে তাদের?
আজ কলমে এঁকে রেখে দিলাম সেইসব অকিঞ্চিতকর অতি সাধারণ মনের মানুষদের। চিরশান্তি পাক তাদের আত্মারা।
দেখা তো হবেই কোথাও না কোথাও... কাল পেরিয়ে।
ঘাসে ঘাসে ঘ্রাণ চাপা ছিল সেইসব আত্মার।
দিই না একটু সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে ওই ভাঙা দেওয়ালটার দ্বারে।
তাই সেইসব প্রায় ভুলে যাওয়া সব স্মৃতি নিয়ে বসলাম, উজার করে রেখে দিয়ে গেলাম আজ।
এত শব্দ লিখেছি এতদিন...এদেরই বা বাদ রাখি কেন আজ?
আমাদের বাড়িতে একজন ধোপা ছিল। নাম ছিল তার টুনটুন।
ক্ষীন মনে পড়ে সে সাধারণত টানটান করা একটা রঙচটা নীল রঙের পাঞ্জাবি আর হাঁটু অবধি ধুতি পড়ে আসতো।
পিঠে এইসান একটা সাদা বোঁচকা।
সেই বাহাত্তর তিয়াত্তর সালের কথা বলছি।
আজ হটাৎ মনে হলো যেটুকু আমার স্মরণে আছে সব লিখে রেখে যাই। যে হারে সবার স্মৃতিভ্রষ্ট হচ্ছে কে জানে কাল আর মনে থাকবে কিনা?
আবছায়া মনে পড়লেও মনে পড়ে সে আমার জন্য লাবেঞ্জুস নিয়ে আসতো।
আসলে দাদু আমায় অনেক ভালোবাসতো।
দাদু টুনটুনকেও খুব ভালোবাসতেন। নাম করা ডাক্তার ছিলেন তিনি। বিনা পয়সায় সবার চিকিৎসা করতেন।
তাই বোধ হয় দাদুর প্রতি একটা অন্যরকম সমীহ ছিল সবার।
দাদু আর ঠাম্মি পূজোর সময় পাড়ার সব গরিব বাচ্চা-বয়স্কদের ডেকে
খিচুড়ি, ভাজা, চাটনি, মিষ্টি খাইয়ে কিছু জামাকাপড় তাদের হাতে তুলে দিতেন।
কি যে খুশি হতো তারা...
আসলে সেকালের সময়টাও ছিল একদম অন্যরকম।
প্রতিটা মানুষের একে অপরের প্রতি সম্মান, বিচার, সামাজিকতা সব ছিল একদম খাঁটি।
কি করে ভুলি সেইসব দিনগুলোর কথা। সেকালে একটা বলের দাম ছিল দশ পয়সা।
বারবার কেনার ক্ষমতা ছিলনা বলে বড়লোকের ছেলেরা কি গালিটাই না দিয়েছিল সেদিন...এখনো দগদগে ঘায়ের মত গায়ে লেগে আছে কথা গুলো।
যাক এই সময় সব মাফ করে দিতে হয়।
মনে পড়ে, অনেকদিন টুনটুনিকে দেখিনি বলে মায়ের আঁচলের তলায় গিয়ে বলেছিলাম... একটা কথা জিজ্ঞেস করবো মা? এসো কানে কানে বলি।
মা তো অবাক এইটুকু মেয়ের আবার কানে কানে বলার কি আছে?
~ টুনটুন কাকা তো অনেকদিন আসেনা।
মা ~ ওর তো শরীর খারাপ সোনা।
মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। বড়ো হয়ে আমি জানতে পারলাম টুনটুন কাকাকে নাকি ভুতে ধরেছিল।
তারপর বিভিন্ন পূজো আচ্ছা করে তাকে সুস্থ করে তোলা হয়েছে।
এর ই মধ্যে তিনমাস সে বোবা ছিল...যদিও শেষমেষ সে কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে।
চরণদাকে ও খুব মনে পড়ে। জুনিয়ার স্কুলের সামনে আলুকাবলি বানাতো।
কতদিন যে বিনা পয়সায় খেয়েছি তার ঠিক নেই।
কোথায় আছো তুমি চরণদা? কলকাতায় কি এখনো আলুকাবলি পাওয়া যায়?
শ্যামল কাকা, তুমি আমায় প্রথম মাছ চিনতে শিখিয়েছিলে....
আমার ছোট্ট ছোট্ট হাতে সেই বড়ো থলে দেখে তোমার কত মায়া লাগতো আজ ও আমার মনে আছে সেই দিনগুলোর কথা...
তুমি আমায় স্কুল থেকে আসার সময় জিলাপি খাওয়াতে,
মাছে পেট টিপে ভালো মন্দ বোঝাতে....
আজ তো তোমাদের সেই চালাঘর ভেঙে ফ্ল্যাট হয়ে গেছে... বড্ড উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট।
ধীরে ধীরে সবাই কিভাবে যেন হারিয়ে গেল। এ যে কি নিয়ম কে জানে।
আমাদের বাড়ির দোতলায় একটা বড়ো ঘর আছে সবাই বলতো হলঘর।
আমাদের যত আড্ডা ছিল সব সেই ঘরে। যে কোনো অনুষ্ঠানেই সবাই সেই ঘরেই গাদাগাদি করে শুতো।
সারারাত ধরে হাহা, হিহি, ফিসফিস চলতো।
আজ যে সে ঘর শূন্য.... কেউ আসেনা আর।
আর তুমি? তুমিও এভাবে চলে গেলে... বলে গেলেনা
এখন একটা সময় জীবন হয়ে যায় এলোমেলো। অকারণে ভুল বোঝাবুঝি, কেউ একে অপরকে মানিয়ে নিতে পারেনা। সেখানেই ভালোবাসার মৃত্যু...অবিশ্বাস আলতো পায়ে আসে।?
ওরা সবাই বেঁচে থাক, কোথাও কারো কারো জীবনে নিজের মতো করে সঙ্গোপনে।
আমি শুধু রাত জেগে রই...একাকীত্বের আগুনে, জ্যোতস্না ভেজা গানে.....যে কয়টা রাত এমন ভাবে বেঁচে থাকা যায় বেলাশেষে।