তারার খোঁজে : কল্পনা মিত্র


 

ফুরফুরে মনে পথ চলতে চলতে স্বচ্ছ নীল আকাশের  বুকে কলঙ্কের প্রলেপ আঁকা ধবধবে সাদা চাঁদটাকে দেখছিল সজল। চাঁদটা যেন তার সাথে সাথে চলছে! অদূরে একটা তারা দেখে ছেলেবেলার মতন আরও একটা তারা দেখার জন‍্য মনটা হঠাৎ কেন জানে না ব‍্যাকুল হয়ে উঠলো। বাবা-মা আর নেই। বাবা মায়ের পর দাদার স্থান! কথাটা কেন যে সেদিন মনে হয়নি। বিয়ের পর নিজের সুখের জন‍্য দাদা-বৌদির সাথে সামান্য তুচ্ছ কারণে অশান্তি করে বৌ নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল সে। আজ এই বয়সে ছেলেবেলার সুখস্মৃতির সাথে সাথে  সহোদরের জন‍্য মনটা ভীষণভাবে ব‍্যাকুল হয়ে উঠলো। ছেলেবেলায় মনের জগৎটা এক্কেবারে আলাদা রকমের ছিল, মা ঠাকুমা যা শেখাতেন বা বলতেন তাই মাথার মধ‍্যে গেঁথে যেত।এছাড়া সমবয়সী বন্ধুদের অনেকের অবস্থাই ছিল একই গতে বাঁধা। আসলে প্রায় সকলেরই ছেলেবেলাটা কাটে মা, ঠাকুমা,পিসি,মাসীদের সঙ্গে, ফলে অন্দরমহলের প্রভাবেই শিশুরা প্রভাবিত হয়। মনে পরছে তাঁদের অন্ধবিশ্বাসকে ঘিরে থাকা নানান রকম ঘটনা। তারই মধ‍্যে আজ সহসা ছেলেবেলায় দাদার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেই সময় তাদের দু'ভাইকে একত্রে দেখে অনেকেই বলতো 'যেন,রাম-লক্ষ্মণ দুটি ভাই।' ছেলেবেলায় এইরকমই যখন দুই ভাই আকাশে  একটা তারা দেখতো তখন পরষ্পর পরষ্পরকে প্রশ্ন করতো -"তোমার আমার কয় চোখ?" আকাশে আরো একটা তারা খুঁজতে খুঁজতে দুজনে দুজনকে উত্তর দিত,-"চার চোখ।"

বয়স বাড়ার সাথে সাথে একে একে লেখা পড়ার গণ্ডি পেরোতে পেরোতে অনেক জ্ঞান বেড়েছে। সেই সমস্ত জ্ঞান আর যুক্তির কাছে কুসংস্কারগুলো ধামাচাপা পরে গিয়েছিল। আজ কি করে যে আবার সজলের মন জুড়ে সেই যুক্তিহীন সংস্কার আসন পেতে বসলো! পথ চলতে চলতে নিজেকেই প্রশ্ন করলো সে।


সংস্কারাচ্ছন্ন আবেগতাড়িত মনে উর্ধ্বগগনে দ্বিতীয় তারা খুঁজতে খুঁজতে অসমতল পথে বার বার হোঁচট খেলো সজল, সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বার পিতৃবিয়োগের আশংকায়  মনটা অস্থির হয়ে উঠলো। মাথার ওপর দিয়ে পথ হারা কোনো পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বাসার খোঁজে উড়ে গেল...কিংবা হয়তো নিজের বাসার সন্ধান পেয়েছে তাই মহানন্দে দ্বিগবিদিগজ্ঞাণশূণ‍্য  ভাবে উড়ে যাচ্ছে তার বাসার  দিকে। নাকি, কোন অশুভ রাত জাগা পাখি!! আবার সংস্কারের আবেগে আকাশ পানে চাইলো সে। চাঁদটা এখন পথের পাশের তাল গাছের ওপরে একটু একটু করে যেন দূর আড়ালে সরে যাচ্ছে।  পায়ের তলায় ঝাঁট দিয়ে  জমিয়ে রাখা শুকনো পাতার ঢিপি। মচ্ মচ্ শব্দে সেই পাতা মাড়িয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললো সজল। আবার আকাশ...! ঘন নীল আকাশ আর ঝকঝকে চাঁদ। একটা মোটরবাইক আচমকা তীব্র আলোর ঝিলিক দিয়ে দ্রুত গতিতে পাকা রাস্তা দিয়ে উল্টো দিকে চলে গেল।  চাঁদকে আর সহ‍্য হচ্ছেনা সজলের! সে দ্রুতপায়ে রাস্তার ধারের অশ্বত্থ গাছটার তলায় এসে দাঁড়ালো। ' আচ্ছা মন বা জীবন কেন পথের মতন আঁকা বাঁকা আর দুর্বল প্রকৃতির হয়? তাল গাছের মতন একবার এদিকে  একবার ওদিকে দোলে? এই মহীরুহর মতন ঘাড় সোজা রেখে স্থির থাকেনা কেন? মনের মধ‍্যে এই সব প্রশ্নের উত্তর হাতরে বেড়ালো সে।যুক্তিহীন সংস্কার আর কুসংস্কারের প্রভাব কাটিয়ে  পুরোপুরি বাস্তব আর বিজ্ঞানের ওপর যে আস্থা ছিল তাকে ছেড়ে কেন যে আবার সংস্কার তাকে হাতছানি দিচ্ছে! বেশ ছিল সংস্কারহীন মন। আসলে আজই কলকাতায় তার একমাত্র ছেলের বিয়ে পাকা করে শ্বশুর বাড়ি এসেছিল শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনা করতে। স্ত্রীর আব্দার তার বাবা গুরুজণ সুতরাং ছেলের বিয়েতে বরকর্তার দায়িত্ব তাঁকেই দিতে হবে। শ্বশুর মশাই বাড়ি ছিলেন না।  কলকাতায় ফেরার ট্রেনটা ঠিক সময় ধরার জন‍্য ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর স্ত্রীকে সেই আলোচনার দায়িত্ব দিয়ে আর কটাদিনের জন‍্য তাকে বাপের বাড়িতে  থাকার অনুমতি দিয়ে বেড়িয়ে এসেছিল সে। 


ছেলেও তারই মতন শেষ পযর্ন্ত নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছে এই তৃপ্তিতে তার মনটা বেশ খুশী খুশী ছিল। আজকাল শরীর আর স্বাস্থ্যের জন‍্য নিয়মিত দিনে দুইবেলা আধা ঘন্টা করে হাঁটে। তাই আজ সে হাঁটাপথে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। ভেবেছিল আজ সেই হাঁটার রুটিনটা এই ভাবেই সাড়বে।  ছেলের পছন্দের  মেয়েটির সাথেই বিয়েটা পাকা করেছে সজল আর তার স্ত্রী। ভালোবাসার মানুষকে জীবন সঙ্গিনী করতে পারার  আনন্দ আর অভিজ্ঞতা দুইই সজল নিজের জীবনে পেয়েছে।  সুতরাং বিয়ের পর ছেলেও নিঃসন্দেহে এমনই আনন্দ পাবে এই কথা ভাবতে ভাবতে   স্বচ্ছ আকাশে কলঙ্ক বুকে মাখা চাঁদটার পাশের একটা তারার দিকে তার চোখ পরেছিল। ত‍ৎক্ষণাৎ সে দাঁড়িয়ে পরে আকাশে আর একটা তারা খুঁজতে থাকে। মনের মধ‍্যে নিজের বিয়ের পর দাদার সাথে করা তার আচরণ যে কতোটা অযৌক্তিক ছিল সেদিন তা বোধগম্য হয়নি অথচ এইমুহূর্তে সেই অন‍্যায় আচরণ করার পাপবোধ তাকে সেই ফেলে আসা ছেলেবেলার কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে তুললো।  সজল পেছন ফিরে ফেলে আসা তালগাছের কাছে ফিরে  চললো। 'ভাগ‍্যি মনটা শুধু ভবিষ্যৎমুখী নয়। বর্তমান  আর আগামী ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে মাঝে মাঝেই ফেলে আসা পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। 


সেই 'আরো একটা তারা' খোঁজার ধকল আর সজল টানতে পারছে না। সেই বিয়ের পর থেকে বৌয়ের আব্দার রাখতে রাখতে ক্লান্ত সে। আর অন‍্যায়ের পক্ষপাতিত্ব নয়, এখনি শ্বশুড়বাড়ি গিয়ে  বৌটাকে সঙ্গে করে দাদার কাছে যেতে হবে। মাথার ওপর দাদা থাকতে শ্বশুড় মশাইকে বরকর্তা করার কোনো যুক্তি আর সে মানবে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post