উদ্যোগ : সায়ন্তনী দাস ধর


 

        আলো ঝলমলে বাড়িটা আজ নিঝুম, নির্জন, একাকী, ঠিক তার মালকিন কমলিনীর মতই। 

" ও মা, আজ চিলি চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস রান্না কর..."

" মা, আজ কিন্তু বন্ধুরা সবাই আসবে সন্ধ্যেবেলায়। তোমার হাতের সেই বিশেষ চকোলেট কেক খাবে বলেছে ওরা..."

" মা, দেখ না, এই নতুন কুর্তিটার সাথে কোনটা মানাবে? আর গয়না কি পরব?"

" মা, আমার আঁকাগুলো একটু এঁকে দাও না গো..."

" কি করছ তখন থেকে রান্নাঘরে? আমার কাছে এসে একটু বোসো না, মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না মা..."

" মা, কতদিন তোমার গান শুনিনি! একটা গান শোনাও না..."

        উঃ! না ,না, কমলিনী এবার পাগল হয়ে যাবে ঠিক! এত একা তো কোনদিনও লাগেনি! একা তো সে সেই কত বছর আগে থেকেই! ভালবেসে অরিন্দমকে বিয়ে করেও সে সংসার টেকেনি। ছয় বছরের একরত্তি মেয়ে তিতাসকে নিয়ে তার একলা পথ চলার শুরু। চাকরি, মেয়ে, পড়াশোনা নিয়ে তাদের মা মেয়ের ছোট্ট সংসারে সে দম ফেলার অবকাশ পেত না। আর একাকীত্ব? তা যে একদমই  ছিল না,  একথা অস্বীকার করতে পারবে না কমলিনী। কিন্তু ঐ ছোট্ট মেয়ে- তার একান্ত আপনজন- তার জীবনকে ভরিয়ে রেখেছিল টইটম্বুর করে। ঐটুকু মেয়ে সবসময় খেয়াল রাখত, মা খেয়েছে তো... শরীর খারাপ হয়নি তো...মায়ের মন ভাল রাখার সমস্ত দায়িত্ব বুঝি তারই ছিল! কবে যেন তিতাস কমলিনীরই 'মা' হয়ে উঠেছিল! দুজনে ছিল একে অপরের পরিপূরক। 

          কিন্তু বাস্তবকে তো মেনে নিতেই হবে। সঠিক সময়ে তিতাসের বিয়ে দিল কমলিনী। গতকাল সব মিটেছে। আত্মীয়স্বজনেরাও ফিরে গিয়েছে নিজেদের বাড়িতে। শূন্য বাড়িতে আজ কমলিনী একাকী। বাড়িটা যেন গিলে খেতে আসছে তাকে! প্রতিটি ঘরের আনাচে-কানাচে তিতাসের স্মৃতি! তার ছেড়ে যাওয়া জামাকাপড়, জিনিসপত্র- প্রতিটিতে কমলিনী হাত বুলিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করে মেয়ের স্পর্শ। একসময় হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে। অনেকক্ষণ পর ধাতস্থ হয় কমলিনী। 

মনে মনে বলে, ' না, না, কাঁদব না, মেয়েটা আমার যেন ভাল থাকে, শান্তিতে সংসার করে!'

       কমলিনীর অতি ব্যস্ত জীবনটা যেন হঠাৎ থমকে গেছে। কোন কাজই যেন নেই আর! অখণ্ড  অবসর যে এত কঠিন হতে পারে, তা তো আগে কখনও ভাবেইনি সে! দিন দুয়েক পর অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে সে। না না , এভাবে অলস জীবন কিছুতেই কাটাতে পারবে না কমলিনী। এ বাড়িতে থাকতে পারছে না সে। কদিনের জন্য সে ঠিক করল কোথাও বেড়াতে যাবে। কিন্তু একা! ভেবেই একটু দমে গেল সে। না না, আজ থেকে তো প্রকৃত একাই সে। একা থাকার, বেড়াতে যাওয়ার, দিনযাপনের অভ্যেস করতে হবে বৈকি! 

           ইন্টারনেট দেখে উত্তর বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের হোমস্টে র সন্ধান পেল কমলিনী। সেখানেই কদিন নিরিবিলিতে নিজেকে খোঁজার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল সে।

" কমল-মা , কাল সকালে তোমাকে ঐ দূরের পাহাড়ে নিয়ে যাব। তোমাকে পাগলা ঝোরাও দেখাব।" হোমস্টে র মালিকের মেয়ে  মুংলি কলকল করে ওঠে। 

এ কদিনেই বড্ড ভালবেসে ফেলেছে সে কমলিনীকে! কমলিনীও কি এক মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছে মুংলির সাথে! এ গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর সাথেও মিষ্টি এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কমলিনীর। মুংলির হাত ধরে কমলিনী প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে। মুংলির সাথে কমলিনী আবিষ্কার করে পাহাড়ি গাম্ভীর্য, ঝর্ণার উচ্ছ্বলতা, গ্রামের মানুষগুলোর হাসিমুখে  রোজকার সংগ্রাম। ধীরে ধীরে কমলিনীর মনে জাগতে থাকে এক অন্যরকম ইচ্ছে। সে যদি এই সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারত! 

সে মুংলিকে ডাকে, " আমি যদি তোদের সাথে এখানেই থেকে যাই? তোদের জন্য যদি কিছু করতে পারি?"

মুংলি আনন্দে জড়িয়ে ধরে তার কমল-মাকে, "তুমি আমার মনের কথাটি বলেছ কমল-মা। আমার সাহসে কুলোচ্ছিল না একথাটি তোমায় বলার। আমাদের গ্রামে তো ইস্কুল নেই, পড়াশোনা করার জন্য  সেই পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হয়। তুমি যদি এ গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ভার নাও! বাবা মায়েরা কাজে বেরিয়ে গেলে ওরা খালি খেলে বেড়ায়।"

         নতুন উদ্যমে লেগে পড়ে কমলিনী। সঙ্গে থাকে মুংলি আর তার বাবা মা। গ্রামের লোকেরাও তাদের নতুন দিদিমণির পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা বোধ করে না। 

         কেটে গেছে বেশ কয়েক  বছর। পাহাড়ি গ্রামটিতে কমল-মায়ের ইস্কুল চলছে জোরকদমে। বিপদে আপদে গ্রামবাসীরা কমল-দিদিমণির কাছেই আসে। সরকারের নজরেও এসেছে এই শুভ উদ্যোগ। সাহায্য করছেন ওঁরাও। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় খুলে যাচ্ছে এক নব দিগন্ত।

Post a Comment

Previous Post Next Post