জীবন খাতার প্রতি পাতায় : কল্পনা মিত্র


 

একুশ বছরের তরতাজা ছেলেটাকে হারিয়ে পুরোপুরি ভেঙ্গে পরেছে অরুনাভ। স্ত্রী সুচরিতার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সান্টুকে দাহ করে ফিরে আসার পর একটাও কথা কিংবা কান্না শুনতে না পেয়ে একটু চিন্তা হচ্ছিল মনে। শোকে কি পাষাণ হয়ে গেছে মানুষটা। ছোট শালী মেঝেতে একটা মাদুর বিছিয়ে "দিদি এখানে বোস "বলতেই সুচরিতা ক্লান্তভাবে সেখানে বসে পরেছিল। বৌদি এক গ্লাস দুধ এনে ওর ঠোঁটে  ছোঁয়াতে প্রথমে একটু চমকে উঠলেও বিনা প্রতিবাদে ঢকঢক করে দুধটা খেয়ে নিয়েছিল। আজ এই শোকের বাড়িতে আসা মানুষগুলো কি খেলো, কি করলো এসব দেখার কোনো উৎসাহ অরুনাভ অনুভব করেনি আর সুচরিতা তো নির্বিকার। বসে থাকতে থাকতে ওই মাদুরেই কখন যে চোখ বুঁজে,পাশ ফিরে শুয়ে পরেছিল সে অরুনাভ খেয়াল করেনি। কাঠের চেয়ারে বসে বসে আসলে তার নিজেরও তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব এসেছিল। সকাল থেকে এতো কেঁদেছে যে চোখ চেয়ে থাকতে পারছিল না। রাতে যে যার মতন জায়গা খুঁজে আলো নিভিয়ে শুয়ে পরতে অরুনাভ ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। ঘরের এককোণে একটা টেবিলে সান্টুর ছবি আর তার সামনে প্রদীপ জ্বলছে। সেদিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে অরুনাভ মাদুরে সুচরিতার পাশটিতে শুতেই -"আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনো "বলতে বলতে সুচরিতা ওর বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ছোট্ট শিশুকে মা যেমন বুকের মধ‍্যে জাপটে ধরে তেমন করে সুচরিতাকে বুকের মধ‍্যে জাপটে ধরে অরুনাভ বলতে লাগলো,-"সে যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে 'সু', তাকে কি করে ফিরিয়ে  আনবো বলো?সে যদি ফিরে আসে আমারও খুব আনন্দ হবে সেটা তো বোঝো....কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে আর বোধ হয় তাকে আমাদের কোলে ফিরিয়ে আনতে পারবো না।"


সবাই জানে সুচরিতার চাইতে অরুনাভ বারো বছরের বড় কিন্তু অরুনাভ জানে আসল ফারাক হলো সতেরো বছরের।  মায়ের মত‍্যুর বহু পরে দিদি  জামাইবাবু যখন দিল্লি থেকে কলকাতায় স্হায়ী বসবাসের জন‍্য বাসা ভাড়া  নিয়েছিল। তখন জামাইবাবু অরুনাভকে সংসারি করার ইচ্ছায় নিজেই  উপযাচক হয়ে দিদির নামে কোনো একটা খবরের কাগজের 'পাত্রীচাই' বিভাগে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে সুচরিতার বাবা যখন সেই বাড়ির সামনে পৌঁছেছিলেন তখন সন্ধ‍্যে হয়েছে সবে। দিদি ঘোমটা মাথায় গলবস্ত্র হয়ে ভাড়া বাড়ির লাগোয়া গ্রিল ঘেরা বারান্দার কোণে ঝোলানো তুলসীগাছে ধূপ আর প্রদীপ জ্বেলে প্রণাম করছিল। দিদির এই রূপ দেখে ভদ্রলোক অভিভূত হয়েছিলেন। প্রণাম সাড়া হলে দিদির পরিচয় শুনে বলেছিলেন,-"কলকাতার মানুষ সম্পর্কে আমার যে ভুল ধারণা ছিল তা আমার ভেঙ্গে দিলে মা। মফস্বলের মানুষ আমি যে মুহূর্তে তোমাকে এই রূপে দেখেছি সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটা যদি সঠিক ঠিকানা হয় তাহলে এখানেই আমার কন্যাকে সম্প্রদান করবো। তুমি যেমন লক্ষ্মী প্রতিমার মতন আমার বড় মেয়েও তেমন।" তাঁর কথা শুনে দিদি হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সাদরে তাঁকে ঘরে এনে বসিয়েছিল। সুচরিতার বাবা বলেছিলেন,-"পাত্রের কোন কথা শুনতে চাইনা শুধু তোমার কথা বলো। ?" দিদির কাছে স্বল্প বৃত্তান্ত শুনে তিনি বলেছিলেন.

-"তুমি বহুদিন প্রবাসে থেকেও বাঙলার এই ঐতিহ্যকে বহাল রেখেছো তাতে আমি মুগ্ধ। পাত্র সম্পর্কে আমার আর কিছু জানার বা শোনার আগ্রহ নেই।" সুচরিতার থেকে বারো বছরের তফাৎ তায় শ‍্যামবর্ণ অরুনাভকে দেখে সুচরিতার পরিবারে ঘোর আপত্তির ঝড়  উঠেছিল, কিন্তু সমস্ত বাদানুবাদকে নস‍্যাৎ করে সুচরিতার বাবা শেষ পযর্ন্ত তাঁর কথা রেখেছিলেন। বরবেশে বিবাহ বাসরে অরুনাভ সত‍্যি সত‍্যি কুন্ঠিত হয়েছিল। অল্পবয়সী,সুদর্শনা,গৌরাঙ্গী মেয়েটার পাশে শ‍্যামবর্ণের নিজেকে খুব বেমানান মনে হয়েছিল। সান্টুর জন্মের পর নিজের বয়সের কথা ভেবে দ্বিতীয় সন্তানের কথা ভুল করেও মনে আনেনি কখনও। তখন কি আর জানতো এই একমাত্র সন্তানটি পথ দুর্ঘটনায় এমনি করে তাদের নিঃস্ব করে অসময়ে চলে যাবে! সে ক্রন্দনরত সুচরিতাকে বুকের মধ‍্যে আঁকড়ে ধরে মনে মনে বললো "সু এমনই তোমার কপাল যে আমি স্বামী হয়েও তোমার অনুরোধ রক্ষা করতে পারবো না।"


 রাতের পরে দিন আসে দিনের পরে রাত,সময়ের সাথে সাথে বেদনার গাঢ়ত্ব ম্লান থেকে ম্লানতর হয়। কিন্তু কদিন আগেও ঘর আলো করা,কতো শতো বাস্তব স্বপ্ন নিয়ে মন জুড়ে থাকা সন্তানের কন্ঠস্বর,পদধ্বনি মা-বাবার মনের আনাচে কানাচে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। বাস্তবে যে তা আর সম্ভব নয় একথা মন না চাইলেও বাস্তব সময়ের সাথে সাথে সেকথা মেনে নিতে হয়। সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য  তা বলতে পারবো না, অরুনাভ এই দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে কিছুদিনের জন‍্য কর্মস্থল থেকে কলকাতায় নিজের পরিবারের কাছে এসেছিল। ছুটি শেষ হওয়ার মুখে সে সুচরিতাকে তার কর্মস্থলে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে সুচরিতা ছেলের স্পর্শ মাখা এই সংসার ছেড়ে যেতে কিছুতেই রাজি হলোনা, সুতরাং অরুনাভর আর কর্মস্থলে ফেরা হলোনা। সুচরিতার প্রশ্নে ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে অরুনাভ উত্তর দিল,-"যার ভবিষ্যতের কথা ভেবে...যাকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার উদ্দ‍্যেশ‍্যে আমাদের অর্থের প্রয়োজন ছিল আজ সে আর নেই। কি হবে তোমাকে এখানে একলা রেখে শুধুমাত্র চাকরি বাঁচানোর জন‍্য বম্বে ফিরে যাওয়ার! তাছাড়া কাপড়ের দোকানে কাপড় বেচার দোকানদারের কপালে বয়সকালে পেনসান পাওয়ারও সম্ভাবনা  নেই..ভাবছি এখানেই যা হোক কিছু করবো। মাথা গোঁজার বাড়ি তো আছেই, আমাদের দুজনার পেট চলার মতন টাকা জোগাড়ের কোনো উপায় কিছু না কিছু একটা হয়েই যাবে। যদি আর কিছুই না হয় আমার বিদেশে শিক্ষিতা মা-বাবার দৌলতে ভালোই ইংরাজি ভাষার চর্চা করেছি। বাড়িতেই সেই ভাষা শেখানোর কোচিন খুলবো না হয়। সুচরিতা জানালো সেও একটা বাচ্ছাদের স্কুল খুলতে চায়। সেইমত বাড়ির একতলায় একটা কিন্ডারগার্টেন খোলা হল আর অরুনাভ দোতলার একটা ঘরে স্পোকেন ইংলিশের কোচিন খুলে ফেললো। তারা স্বামী-স্ত্রী দুইনেই ছোট্ট ছোট্ট ছাত্রছাত্রীর মধ‍্যে সান্টুর ছেলেবেলাকে খুঁজে পেলো আর স্পোকেন ইংলিশ শিখতে আসা ছেলে মেয়েদের মধ‍্যে সদ‍্য হারানো ছেলের সেই বয়সের ভাব ভঙ্গিমা খুঁজে পেলো। শিশু আর তাদের অভিভাবকদের নিয়ে গড়ে ওঠা নতুন জীবনযাত্রার মধ‍্যে ধীরে ধীরে কিছুটা হলেও ম্লান হল তাদের পুত্রশোকের যন্ত্রণা। বাস্তব বড়ই কঠিন। জীবন যাপনের জন‍্য প্রয়োজন অর্থের..স্হানীয় কিছু পরিবার তাঁদের ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের এখানে পাঠান। তাদের সুস্ঠভাবে গড়ে তোলার জন‍্য স্কুলে কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা,আয়া,কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। আশেপাশে আরও উন্নতমানের কিণ্ডারগার্টেন গড়ে ওঠার ফলে সুচরিতাকে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি পরতে হলো। কিন্তু ব‍্যাপারটা ব‍্যয়সাপেক্ষ। আয়ের চাইতে ব‍্যয়ের পরিমাণ বেশী হতে থাকায় বছর দশেকের মধ‍্যে স্কুল বন্ধ করতে হলো। অরুনাভর ক্ষেত্রেও তাই হলো..এখন চারিদিকে আধুনিক ধরনের স্পোকেন ইংলিশের সেন্টারের হাতছানি তার এক কামরার  কোচিনকে দুর্বলতম করে দিয়েছে। জীবন রক্ষার জন‍্য  তাদের সামান‍্য পুঁজির অর্থ শূণ্যের ঘরে পৌঁছেছে। দুজনে বহু পরামর্শ করে একতলার স্কুল বন্ধ করে ভাড়াটে বসালো। অরুনাভ বাড়িটা পেয়েছিল মামাবাড়ির তরফ থেকে। পঙ্গু মাকে দীর্ঘদিন অক্লেশে দেখাশোনা করার পুরষ্কার হিসেবে।

 

 অরুনাভর জীবনের সত্তর বছর পার হয়ে গেল।সুচরিতার তিপ্পান্ন। এখন আর তাদের মধ‍্যে সান্টুর অনুপস্থিতি বিষাদের ছায়া ফেলেনা। কখনও কখনও স্মৃতিচারণ করে মাত্র। ছোটবোন আর দিদি-জামাইবাবু এক এক করে পরম শান্তির দেশে যাত্রা করেছেন। দিদির এক ছেলে পুলকেশ আর মেয়ে শ্রুতি। দুজনেই সংসারী। ভাগ্নে পুলকেশ আসে মাঝে মাঝে। শ্রুতি ফোনের মাধ‍্যমে খোঁজখবর নেয়। জন্মসূত্রে বিদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া দাদা ভারতবর্ষে বেড়াতে এলেও কলকাতায় আসা বা থাকার কথা কল্পনাতেই আনতে পারেননা। তাঁর সন্তানরা হয়তো তাদের পিতৃকুলের কাউকেই আজ পযর্ন্ত চেনে না।  

 

ইতিমধ্যে বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি ঘটেছে,নতুন নতুন আবিষ্কার আর তার ব‍্যবহারের ঘনঘটায় মানুষের জীবনযাত্রায় বহু বদল ঘটেছে।হাতে হাতে মোবাইল ঘরের একমাত্র অবলম্বন  ল‍্যাণ্ডফোনের একাধিপত‍্যকে অনেকটাই ম্লান করেছে। লোন নেওয়ার সুবিধা হওয়ার ফলে বহু একান্নবর্তী পরিবার থেকে বেড়িয়ে এসে বেশ কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ফ্ল‍্যাট আর গাড়ি কিনে নিজস্ব চাহিদা মেটাচ্ছে। কেউবা পৈতৃক বাড়ি ভেঙ্গে ফ্ল‍্যাটবাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করছেন। ফলে প্রমোটরের সংখ‍্যা বেড়েছে। প্রোমোটিংএর ব‍্যবসা হু হু করে বেড়ে উঠেছে। অরুনাভ নিজের সত্তরোত্তর জীবনে নিজের পরিবারেই এইসব স্বার্থান্বেষী মানুষদের দেখেছে। বয়সে অনেক ছোট স্ত্রী সুচরিতাকে নিয়ে তার চিন্তা হয়। আজ নয় কাল বয়সের ভারে তাকে নুয়ে পরতেই হবে আর তার যদি মৃত‍্যু ঘটে তাহলে এই মেয়েটার কি হবে....পাড়ার কিংবা বেপাড়ার প্রমোটারদের নজর পরবে এই বাড়িতে। বিধবা সুচরিতা একলা কি করে এইসব বিপদ সামলাবে.....! কি হবে ওর তখন! অরুনাভর মনে শান্তি নেই। মেয়েটাকে জীবনে সুখী করতে পারলো না। চাকরী ক্ষেত্রে পেনসনের সুবিধা নেই বুঝে সে ছেলের অসময় মৃত‍্যুতে শোকার্ত স্ত্রীর পাশে থাকার জন‍্য ভেবেচিন্তে সেই চাকরীটা ছেড়েছিল। কিন্তু নিজের এই বয়সে স্ত্রীর ভবিষ্যতের চিন্তা তাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।


  মায়ের একাকিত্বময় অসহায় দিনগুলোর কথা খুব মনে পরে অরুনাভর। সেই দিনগুলোতে অভিভাবকের মতন একমাএ সে ছিল মায়ের পাশটিতে। স্ত্রীর জীবনে এমন দিন আসুক এমনটি সে কল্পনাতেও আনতে চায় না। তার বাবা-মায়ের যুগে বিয়ের পণ হিসেবে বাবা ইংল‍্যাণ্ডে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। বাবার সাথে মাও সে সুযোগ পেয়েছিলেন। বিদেশে বসবাসকালে বড়দা,আর দিদির ওখানেই জন্ম হয়। সেইখান থেকে পরাধীন ভারতবর্ষে আবার যখন তাঁরা ফেরেন তখন কর্মসূত্রে বাবার পোষ্টিং হয় বার্মাতে। অরুনাভর জন্মস্থান বার্মা। তারপর বাংলায় শ্বশুরবাড়িতে ফিরলে ছোট্ট অরুনাভ দেখেছিল সেকালের সংস্কারান্ধ সমাজে 'কালাপানি' পেরোনোর অপরাধে তার মাকে কতোটা লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছিল। সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে তার শিক্ষিতা মা বাবার কর্মস্থলে কলকাতার বাসায় এসে উঠেছিলেন। বাবার সহযোগিতায় মা স্বদেশের জন‍্য বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনেও ব্রতী হয়েছিলেন। তার সেই মায়ের এমন কি কপাল দোষ ছিল যা অরুনাভ আজও বুঝে উঠতে পারেনি। হয়তোবা ভাগ‍্যের পরিহাস ছিল। দিদির বিয়ের পর পর আচমকা একদিন মা জ্ঞানহারা হয়ে পরে যান,তারপরেই মায়ের বামঅঙ্গ পঙ্গু হয় তখন অরুনাভ ম‍্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দাদা বিলাতে বিধবা মাসীর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছিল। মায়ের আকস্মিক দুর্ঘটনায় অরুনাভর আর পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেকালে চিকিৎসা পদ্ধতি কি ছিল মনে পরেনা তবে আজকালকার  পদ্ধতিতে হয়তো এই রোগ নিরাময় হয়। মা ছিলেন সুমুখশ্রীযুক্ত কিন্তু তাঁর গায়ের রঙ ছিল শ‍্যামবর্ণ। ছেলেবেলায় দেশের বাড়িতে থাকার সময় ঠাকুমার মুখে প্রায়শই একথা সে শুনেছিল যে শুধুমাত্র পণের বিনিময় তার সুদর্শন বাবা শ‍্যামবর্ণা এই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিলেন। এই কথা যে কতোটা সত‍্যি তার প্রমাণ দিয়েছিলেন বাবা স্বয়ং।বাবাকে কর্মসূত্রে প্রায়ই  এদিকে ওদিকে যেতে হতো ফিরে এলে বাবা বেশ ক'টাদিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতেন। মা পঙ্গু হওয়ার পর কাজের নানান অজুহাতে বাবা বাড়ি ফেরা বন্ধ করলেন। কখনও কিছুক্ষণের জন‍্য এলে অরুনাভর হাতে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে যেতেন। অরুনাভর পক্ষে মায়ের কোনোরকম চিকিৎসা করা সম্ভব ছিলো না। দিদির শ্বশুরবাড়ি ছিল সুদূর দিল্লিতে। নতুন বিয়ের পর দিদি দিল্লিতে শ্বশুরঘর করতে গিয়েছিল। সেকালে বাড়িতে ফোন থাকাটা সহজ ব‍্যপার ছিল না। কোনো খবর পাঠাতে হলে টেলিগ্রাম কিংবা লোকমুখে সংবাদ পাঠাতে হতো। নবযুবক অরুনাভ সময় আর সুযোগের অভাবে  দিদিকে সঠিক সময় মায়ের অসুস্থতার খবর পাঠাতে পারেনি। যখন দিদি খবর পেয়েছিল তখন দিদির কোলে ছোট্ট পলু অর্থাৎ পুলকেশ। তার বছরখানেক পর দ্বিতীয় সন্তান শ্রুতির জন্ম হয়। সে সময় আজকালকার মতন প্লেনে করে যাওয়া আসা করা তেমন সহজসাধ‍্য ছিল না। তাই  সেই চৌদ্দ বছরের মধ‍্যে ঘোর সংসারী দিদি ট্রেনে চেপে মাত্র এক আধবার মাকে দেখতে এসেছিল। অরুনাভর পঙ্গু মা চৌদ্দ বছর জীবিত  ছিলেন। 


সুচরিতার কাছে অরুনাভ একদিন নিজের মনের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করাতে অনেক পরামর্শের পর ওরা দুজনে বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক হয় বাড়ি বিক্রির টাকা ব‍্যাঙ্কে ফিক্সড করে রেখে তার সুদে তাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে।  সেই মতো কাজ হলো। সান্টুর বাস্তব স্মৃতি মাখা ঘর দোর ছেড়ে তার স্মৃতি মাখা কিছু বস্তু বুকে আগলে তারা এসে উঠলো ভাড়া করা ছোট্ট সীমাবদ্ধ বাড়িটাতে। পুলকেশের সাহায‍্যে ভারী ভারী কিছু জিনিসপত্র স্থানান্তরিত করা হলেও বহু জিনিসপত্র জলের দরে বিক্রি বা দান বা ফেলে দিতে হল।।দুজনে নতুন করে ঘর গোছানো, পর্দা লাগানো নিয়ে মেতে রইলো কিছুদিন। সুদের টাকায় সংসার চালিয়েও কিছু বাঁচে। অরুনাভ আর সুচরিতা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে  যোগাযোগ করে প্রতিবছর ভারতবর্ষের  নানান জায়গায় বেড়াতে গেল। এই ভাবে কেটে গেল আরও কয়টা বছর। আশি ছুঁই ছুঁই অরুনাভ বুঝতে পারলো ঘর আর মন পরিবর্তনের সাথে সাথে মৃত‍্যুভয়টা তার কেটে গেছে। ষাট পেরোনো সুচরিতার চুলেও পাক ধরেছে। চোখে-মুখে বয়সের ছাপ পরেছে। এখন দুজনকেই পাশাপাশি মানান সই লাগছে। শেষেরবার বেড়াতে গিয়ে ট্রেন থেকে নেমে সুচরিতা বললো -"বয়স যে হয়েছে বেশ বুঝতে পারছি। কোমর আর পিঠের শিঁরদাড়াটাতে খিঁচ লাগছে।" অরুনাভর শরীরেও খিঁচ আসে মাঝে মাঝে...কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। স্ত্রীর মুখের হাসি দেখার জন‍্য সে সব কষ্ট সহ‍্য করতে পারে।সেবার বেড়িয়ে ফেরার পরও মাঝে মাঝেই সুচরিতার যণ্ত্রনা দেখা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত  ডাক্তারের কাছে  যেতে হলো। এরপর অর্থপেডিক্সের কাছে। আর্থালাইটিস ধরা পরলো। সেই বছর থেকে বেড়াতে যাওয়া বন্ধ করতে হলো। উল্টোদিকে ডাক্তারের খরচ বাড়লো। ইতিমধ্যে খবর এলো আকস্মিক সেলিব্রাল এ‍্যাটাকে পুলকেশ মারা গেছে। দ্বিতীয়বার সন্তান  হারানোর বেদনায় দুজনার মন ক্ষতবিক্ষত হলো। এরই পরে ইংল‍্যান্ড থেকে হঠাৎ একদিন দাদা-বৌদির প্লেন ক্র‍্যাসের খবর পেলো।  সবচাইতে কমবয়সে সবার থেকে আপনার পুত্রশোকের চাইতে এ শোক তেমন করে মনে দাগ কাটার মতন না হলেও অরুনাভ আর সুচরিতার মনের গভীরে তা স্পর্শ করলো। বয়সের ধর্মকে এই দুজনেরই এড়ানো সম্ভব নয় শুধু কে আগে সঙ্গী হারা হবে এই চিন্তা  দুজনকেই শঙ্কিত করলো। সুচরিতার বাবা মা বহু আগেই এই জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন,তার বড়দা অরুনাভকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতেন না তাই যোগাযোগ রাখতেন না। তাঁর ছেলে সৌরভ স্বার্থপর প্রকৃতির। ভালোবেসে বিয়ে করে একই বাড়িতে ভিন্ন সংসার পেতেছিল। বড়দার মৃত‍্যুর পর বৌদিকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছিল। পাাঁচ বছর হলো বৌদি বৃদ্ধাশ্রমেই মারা গেছেন। ছোড়দা চোখে কম দেখার কারণে বিয়ে করেননি। দাদা বৌদির সংসারের গলগ্রহ হয়ে ছিলেন। এই টুকুই সুখের কথা ছিল যে সৌরভের বিয়ের আগেই ডেঙ্গু জ্বরে হাসপাতালেই তিনি মারা যান। অরুনাভ জানতো তার বাবা বর্দ্ধমানে কোন এক বিধবা মহিলার পরিবারে থাকতেন। মায়ের মৃত‍্যুর বছর খানেক পরে সংবাদ পত্রে তাঁর জীবনাবসানের খবরটা তার চোখ এড়ায়নি। ভাগ্নি শ্রুতি এখন তাদের একমাত্র ভরসা। দিদি-জামাইবাবুর সুশিক্ষায় শিক্ষিত ধনী পরিবারের বড়বৌ হলেও  মেয়েটা নিরঅহংকারী আর ঘোর সংসারি। তার ছত্রছায়ায় আজও তাদের একান্নবর্তী পরিবারটা টিকে আছে।  পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত,ভদ্র আর চাকুরীজীবী। শ্রুতি সময় পেলেই অরুনাভ আর সুচরিতার খোঁজ খবর নেয়। মাঝে সাঝে দেখা সাক্ষাৎও করে যায়। এই গিন্নিবান্নি মেয়েটা সঠিক বয়সে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। দুজনেই এখন বিদেশে থাকে। অরুনাভ-সুচরিতার মন খারাপ হলে তারা শ্রুতিকে ফোন করে। অরুনাভ ভাবে আজকের দিনের এই ফোনালাপ কতোই না সহজসাধ‍্য অথচ মাকে নিয়ে টানাপোড়েনের সময় দিদিকে কোনো সংবাদ সে পাঠাতেই পারেনি। সুচরিতাকে বলে,-" সবাই যে যার মতন দায় দায়িত্ব সেড়ে পরম শান্তির দেশে চলে গেল আর আমি রয়ে গেলাম  এখনো.....আরোও কতো কিছু দেখবো আর সইবো বলে।" সুচরিতা বলে,-"আমারও তাই মনে হয়। ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আরও অনেক কিছু দেখাবেন বলে তার মধ‍্যে সুখ আর দুঃখ দুটোই আছে।"অরুনাভ সুচরিতার হাতে হাত রেখে হেসে বলে,-"আমার কথা ভাবো,বিরাশী বছরের বুড়ো আজও তরুণী ভার্যার সঙ্গে ঘর করছি। তাও দিদির গুণে এই তরুণী কে বৌ করে পেয়েছি! নিজের কোনই যোগ‍্যতাতে নয়।" সুচরিতা একটু আনমনে উত্তর দেয়,-"একবার ভাবোতো,তুমি চলে গেলে আমার কি হবে...টাকা পয়সা না হয় আছে কিন্তু সঙ্গী  তো থাকবে না।"অরুনাভ বলে,-"তুমি আগে গেলেও তো আমার একই দশা হবে 'সু'...।" 

-"নাঃ,তোমার ভাগ্নী তোমাকে  কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবে,যত্ন আত্তি করবে। তোমাকে একলা থাকতে হবে না।"সুচরিতার উত্তর শুনে অরুনাভ বলে, -"তোমার জন‍্যই আমি আজও মন শক্ত করে বেঁচে আছি 'সু',আর যদি তুমি আমার আগে চলে যাও তাহলে আমাকেও তাড়াতাড়ি তোমার কাছে টেনে নিও কিন্তু।আমি যে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না 'সু'। আর আমি না থাকলে তুমি শ্রুতির কাছে  থেকো,ওকে আমি বলে রাখবো।" সুচরিতা বলে,-"তুমি,মামা,শ্রুতির তোমাকে সঙ্গে রাখার যুক্তি আছে,আমি মামী.....পরের ঘরের মেয়ে,যার নিজের লোকেরাই আমাকে চায়না সে আবার স্বামীর ভাগ্নীর কাছে কি অধিকারে থাকবো বলো? তার চাইতে তুমি আগে গেলে আমাকে নিয়ে যেও তাড়াতাড়ি। মনে রেখো কিন্তু।আর এই দিন গত পাপক্ষয় ভালো লাগছে না।"


দিনগত পাপক্ষয়ই বটে। বয়সের ধর্মে একটু এদিক  ওদিক হলেই পেটের ব‍্যামো শুরু হওয়া এই এক নতুন রোগ দেখা দিল অরুনাভর শরীরে...যখন বাড়াবাড়ি হয় সুচরিতা কোমড় ব‍্যাথা নিয়ে সামলাতে পারেনা তাও চেষ্টা করে। ওকে একলা রেখে ওষুধ -পথ‍্যি কিনে আনতে পারেনা যখন তখন শ্রুতিকে ফোন করে অনলাইনে ওষুধ আর বাজার আনায়। না হলে সরকারি হসপিটালে ভর্তি করে। সুচরিতারও আজকাল একটু জল ঘাঁটলে সর্দি-জ্বর হয়। মাঝখানে মাথা ঘুরে পরেও গেলো। অরুনাভ প্রায় উন্মাদের মতন পাড়া প্রতিবেশীদের  ডাকাডাকি করে নিয়ে গেল হাসপাতালে। জানা গেল স্পন্ডালাইটিশ হয়েছে। এই ভাবে সে বছর দুজনাই পালা করে হাসপাতালে দুই-তিন রাত কাটিয়ে এলো। তারপর আবার ছন্দে ফিরলো তাদের জীবন। শ্রুতি মামাকে একটা স্মার্ট ফোন উপহার দিয়ে বলে গেলো,-" ভিডিও কল করে মাঝে মধ‍্যে তোমাদের সাথে কথা বলবো।" অরুনাভ ফোন হাতে পেয়ে খুব খুশী। বললো,-"হয়তো এমন জিনিস হাতে পাবো বলেই আজও বেঁচে আছি।" সারাদিন ফোন নিয়ে খুটখুট করে অনেক কিছু  শিখে ফেললো সে। এখন সুচরিতাকে নিয়ে পুরনো সিনেমা দেখে অনেকটা সময় কেটে যায়। সুচরিতার মন ভেসে যায় অনেক দূরে ...'এই সিনেমাটা দেখার সময় বাবা,মা,সান্টু সব্বাই বেঁচে ছিল,সান্টুর বয়স তখন কতো ছিলো! কেমন করে হাসতো! কেমন করে কথা বলতো! ভয় পেলে কেমন করে জড়িয়ে ধরতো....এই সব ভাবনায় তার  সিনেমা দেখার উৎসাহ কমে যেতো।সুচরিতার ভাবনায় ছেদ ফেলে অরুনাভ বলেছিল,-"সান্টু থাকলে কবেএএ আমরা এই ফোন ব‍্যবহার করা শিখে ফেলতাম....তাই না?"  সুচরিতা নিঃশব্দে ভাবে 'তাহলে সান্টু আমাদের মন থেকে এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। সান্টু দেখ্ আজও আমি আর তোর বাবা আলাদা মানুষ হলেও মনে মনে একসাথেই তোর কথা ভাবি।'


অকস্মাৎ করোনা মহামারির কথা প্রকট ভাবে কানে এলো। এতোদিন 'মহামারি' শব্দের গুঞ্জন  কানে আসছিল। পৃথিবী জুরে লকডাউন শুরু হলো। টিভির প্রতিটি চ‍্যানেলে সারাদিন একই সংবাদ। মুখে মাশ্ক পরার,মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রাখার, বাড়ি থেকে না বেড়োনোর নির্দেশ। এ রোগ নাকি ষাটোর্ধো মানুষের জন‍্য বেশি বিপদ্দজনক। রোগাক্রান্ত মানুষগুলোকে আলাদা রাখা হচ্ছে। এদের মৃত‍্যু অবধারিত। মৃত‍্যুর পর শ্মশানে এদের দাহ করা নিয়ে নানান বিধি নিষেধ। তার সঙ্গে তীব্র গতিতে আমফান ঝড় আসার আগাম বার্তা। অরুনাভ বললো,-"বুঝলে 'সু' এ সব দেখার জন‍্যই আমি বেঁচে আছি। ঘরে চাল,ডাল,আলু,তেল,চিনি,আটা সব আছে তো মাস খানেকের মতন? ডিম আছে? না থাকলে বোলো।দিনের যেটুক সময় লকডাউন থাকবেনা সে সময় মুখে রুমাল বেঁধে ওগুলো আমি কিনে আনবো না হয়। বাঁচার জন‍্য খাদ‍্যের দরকার। তার জন‍্যই কাঁচা বাজার করে রাখার দরকার আছে।"  দিন যায় দিন আসে।একসঙ্গে একই পরিবারের ষাটোর্ধো কয়েকজন মানুষের মৃত‍্যুর খবর যখন এই দুজনের কানে এসে পৌঁছলো তখন দুজনার মুখেই মিষ্টি হাসির আভাস দেখা গেলো। অরুনাভ প্রথম কথা বললো,-"এই একটা সুযোগে আমাদের দুজনার যদি একসাথে জীবনাবসান ঘটে! আনন্দে আত্মহারা সুচরিতা স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো,-"খুব ভালো  বলেছো। মরার পরে আমাদের দেহ কোথায়  গেল,কি হলো তা দেখার জন‍্য ফিরেও তাকাবো না...মুখাগ্নির কোনো প্রশ্নই নেই কি বলো?" সুচরিতাকে আরও নিবিড় করে জাপটে ধরলো অরুনাভ,-"এখন আমাদের কয়েকটা কাজ করতে হবে 'সু'।"

 -"কি কাজ?"প্রশ্ন ভরা চোখে মুখ তুলে স্বামীর দিকে তাকালো সুচরিতা।

 -"আগে যা যা মূল‍্যবান জিনিস টাকা পয়সা ব‍্যাঙ্কের কাগজ পত্র সব আলমারির লকারে একত্রে রাখো তারপর একটা কাগজে শ্রুতির নামে সর্বস্ব লিখে দুজনে সই করে ওগুলোর সাথে রাখি চলো। তারপর আলমারির চাবিটা কোথায় রাখছো মনে রেখে শ্রুতিকে ফোন করে জানিয়ে দিতে হবে। জানি ওর এ সবের কোনো প্রয়োজন নেই,তবু ওকেই দেবো। আমরা না থাকলে সে সব শ্রুতি ইচ্ছামতন কাউকে দান করতে পারে কিংবা ভোগ করতে পারে।"তারপর কয়েকটা সাদা কাগজে শ্রুতির নাম-ঠিকানা-ফোন নাম্বার দিয়ে লিখতে হবে 'আমাদের মৃত‍্যর পর এখানে খবর দিও,এই মানুষটি আমাদের পরম আপনজন। তারপর ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে দেওয়ালে কাগজগুলো আঠা দিয়ে সেঁটে দিতে হবে। চলো আমরা কাজে নেমে পরি। শুভস‍্য শীঘ্রম।"


শ্রুতির সংসারে আর মনে উদ্বেগের ছায়া। বাড়ির ছেলে মেয়েরা প্রায় সবাই প্রবাসে নয় বিদেশে আটকে আছে। মহামারির আতঙ্ক সবার মনে। তার উপর বয়োজ্যেষ্ঠা সেজো খুড়শাশুড়ী ভায়ের ছেলের বিয়েতে নবদ্বীপ গিয়েছিলেন,লকডাউনের কারণে আটকে পরেছেন। সেজো খুড়শ্বশুড় সে কারণে সকলকে ব‍্যতিব‍্যস্ত করছেন। এরই মধ‍্যে মামার ফোন। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে মামা-মামী তাঁদের পরিকল্পনা মতন কথা উজাড় করে দিলেন। মানসিক ভাবে ক্লান্ত শ্রুতি জানালো -"মামা.মামিমা আমি  তোমাদের কথা ঠিক বুঝতে পারছি না,আসলে আমার মাথায় ঢুকছে না। আবার বলো আমি রেকর্ড করে রাখছি,পরে শুনে নেবো।" শ্রুতির ওসব শোনা হয় না সে অনলাইনে কিছু সমাজসেবকের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে ব‍্যাগ ভর্তি চাল, মাছ, ফল, ডিম, আনাজ কিনে পাঠিয়ে দেয়।


-"নাঃ! করোনার আমাদের পছন্দ হয়নি আমরা পাপি-তাপি মানুষ তাই আমরা ঈশ্বরের হিসেবের খাতার বাইরে। ঈশ্বর ভালো মানুষদের বুকে জড়াতে ভালো বাসেন বেশি তাই অসময় তাদের কাছে টেনে নেন।" প্রথম লকডাউন শেষ হতে অরুনাভ মন্তব‍্য করলো। এর পর আবার ছন্দে ফেরা। শ্রুতি আসতে পারছে না ছেলে মেয়েরা বিদেশে বসেই সাবধান করছে,-"মনে রেখো তোমাদের কিছু হলে আমরা পৌঁছতে পারবো না অথচ ছটফট করবো....আমাদের শান্তির কথা ভেবে তোমরা পথেঘাটে বেড়িও না প্লিজ।" অরুনাভ আর সুচরিতার মাথার ওপর কারো শাসন নেই তাই প্রয়োজনে নিত্য বাড়ির বাইরে বেড়োতেই হয়। দুজনে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চাল,আলু কেনে,রেশন তোলে। ওয়াটার ফিল্টার,মিক্সি,কুকার,ফোন খারাপ হলে সাড়াতে যায়। পেট ভরানোর জন‍্য এতো ব‍্যবস্থা এতো জোগাড়। এদিকে ব‍্যাঙ্কের সুদ আরও কমে গেছে তাই জীবন ধারণের জন‍্য কোন কার্ড করলে কম ব‍্যয়ে চিকিৎসা সম্ভব,কোন কার্ড করলে বয়স্করা ভাতা পাবেন তার খোঁজ খবর নিয়ে ওরা দুইজনে ছুটোছুটি করে,মায় লাইন পযর্ন্ত দেয়। অরুনাভ প্রায়ই বল‍ে,--"শরীরের নাম মহাশয়/যা সওয়াবে তাই সয়।।দেখো আমাকে কেউ বলবে আমি আশি পেরিয়ে নব্বই ছুঁতে চলেছি!" সুচরিতা ছুটে এসে ওর বাম হাতের কেড়ো আঙ্গুলে দাঁত বসায়। বলে কে কি বোঝে জানিনা ,তবে আমার জন‍্য তোমাকে থাকতেই হবে।"


 এবারের ঠাণ্ডাটা অরুনাভকে ছেড়ে যেতে চাইছে না।তার সঙ্গে পেটের রুগ্নতা যেন যেঁকে বসেছে শরীরে।ওর জন‍্যে নিত‍্য চিঁড়ে সেদ্ধ নয় কাঁচকলা পেঁপের ঝোল আর গলা ভাত রান্না হচ্ছে ...সুচরিতার গলা দিয়ে নামেনা তাও খেতে হয়। এ সময় অরুনাভকে একলা রেখে দোকান বাজার যাওয়াও মুশকিল। একা একা বাথরুমে যেতে গিয়ে  যদি পরে যায়। নিজের পা আর কোমরে ব‍্যথা নিয়ে  মানুষটাকে টেনে টেনে বাথরুমে নিয়ে যেতেও সুচরিতার শারীরিক কষ্ট হয় বইকি। শ্রুতিকে ফোন করে। শ্রুতি অনলাইনে ফর্দমাফিক সব অর্ডার করে পাঠিয়ে দেয়। অরুনাভ একটু সুস্থ হলে খাওয়াদাওয়ার ব‍্যাপারের বিধি নিষেধ থাকলেও শারীরিক আর মানসিক দিক থেকে ক্লান্ত সুচরিতা প্রয়োজনে স্বামীকে একলা দোকানে কিংবা ব‍্যঙ্কে পাঠাতে বাধ‍্য হয়। অনেকদিন শ্রুতির না আসাতে অরুনাভকে একটু উদ্বিগ্ন হতে দেখে ফোন করে সুচরিতা। শ্রুতি ভিডিও কল করে মামা মমিকে দেখতে চায়। সুচরিতা বুঝতে পারে অরুনাভকে ভুলের রোগে ধরেছে তাই কলটা ধরতে পারছে না। ইদানিং  প্রায়ই  ভুল করে অরুনাভ। 'বয়স কালের ভীমরতি বুঝে সুচরিতার বুক কেঁপে ওঠে। বৃদ্ধ মামাকে দেখার জন‍্য শ্রুতি শেষ পযর্ন্ত ছুটে আসতে বাধ‍্য হয়।


মাসখানেক পর  অরুনাভর ঘুমের রোগে ধরলো। যখন তখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।একদিন সুচরিতার অনেক ডাকেও অরুনাভ উঠলো না দেখে পাড়ার ডাক্তারকে ডেকে আনালো সে। ডাক্তারবাবু  অরুনাভকে স্থানিও হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। বললেন,-"পটাশিয়াম সডিয়াম কম থাকায় এই ঘুম।" পাড়ার মানুষের সহযোগিতায় এ‍্যাম্বুলেন্সে করে কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকৎসা ব‍্যবস্থার দূর্বলতার কারণে সরকারি হাসপাতালের মায়া কাটিয়ে বেসরকারী হাসপাতালে তাকে ভর্তি করে সুচরিতা। খবর পেয়ে শ্রুতি ছুটে আসে। করোনা পরীক্ষার ব‍্যবস্থা করে হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী অরুনাভকে বিশেষ ইন্টেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়। শ্রুতিকে বাড়ি পাঠিয়ে সুচরিতা নাওয়া-খাওয়া ভুলেও সারাদিন  হাসপাতালে বসে থাকে। বিশেষ আই.সি.ইউতে রাখার ফলে সুচরিতা তার কাছ যেতেও পারেনা। দ্বিতীয়দিন ভিসিটিং আওয়ারে কাঁচের ছোট্ট একাটা জানলা  দিয়ে  একটুখানির জন‍্য অরুনাভকে দেখে ফিরে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে  দেখা করে জানতে পারে অরুনাভকে পরশু ছেড়ে দেওয়া হবে। ত‍ৃতীয় দিন করোনা নেগটিভের রিপোর্ট অনুসারে করোনাহীন আইসিইউতে অরুনাভকে স্থানান্তরিত করা হলে কিছুক্ষণের জন‍্য সুচরিতা অরুনাভর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পায়। সেখানে গিয়ে সুচরিতা দেখে অরুনাভকে নাকে পাইপ দিয়ে খাওয়ানোর ব‍্যবস্থা করা হয়েছে। হাতে ইনজাকসানের চ‍্যানেল করা হয়েছে,অক্সিজেন আর স‍্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। দুটো হাত দুদিকের খাটের গ্রিলের সঙ্গে বাঁধা। অরুনাভ ওর দিকে অবাক চোখে চেয়েছিল। সুচরিতা প্রশ্ন করলো,-"আমাকে চিনতে পারছো?"অরুনাভ বললো,-"তোমাকে চিনবো না!তুমি তো আমার সব।" অরুনাভ আরোও প্রশ্ন করে আমি কোথায়  আর এরাই বা কারা? আমার  হাত দুটো বাঁধা কেনো?" সুচরিতা বলে,-"তুমি হাসপাতালে,তোমার চিকিৎসা চলছ, এরা তোমার দেখাশোনা করছে। তোমাকে অক্সিজেন আর স‍্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। পাছে তুমি এগুলো খুলে ফেলো তাই তোমার হাত বেঁধে রেখেছে।" অরুনাভ বললো,-"না আমি এগুলো খুলে ফেলবো না,আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও।" সুচরিতা বললো,--"ডাক্তারবাবু বলেছেন কালকে তোমাকে ছেড়ে দেবেন। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় এগুলো খুলে দেওয়া হবে।" পরের দিন একজন প্রতিবেশিকে সঙ্গে এনেছিলো সুচরিতা। শ্রুতিও এসেছিল। হাসপাতালের সমস্ত ফর্মালিটিজ শেষ করে সে এ‍্যাম্বুলেন্সের আর অক্সিজেনের ব‍্যবস্থা করে যখন বাড়ি ফিরিয়ে আনলো তখন সন্ধ‍্যে হয়ে গেছে।


অরুনাভকে যখন হাসপাতালে আনা হয়েছিল তখন তার সংজ্ঞা ছিল না। যখন সংজ্ঞা ফিরলো তখন  'সুচরিতাকে কোথাও দেখতে পেলোনা। এই অপরিচিত পরিবেশে এই অপরিচিত মানুষগুলোকে দেখে আর আশেপাশের সাদা চাদরে মোরা মানুষগুলোকে শুয়ে থাকতে দেখে ভাবলো বুঝিবা তার মৃত‍্যু হয়েছে। আশেপাশে সকলেই পার্থিব জগত থেকে বিদায় নিয়ে হয়তো এখানেই আসে। আচ্ছা এটা কি কোনো গ্রহ? মৃত‍্যুর পর সে নিয়ম মাফিক সে  এই গ্রহে এসে পৌঁছেছে। হুম,দেবালয় বা যমালয় 

যা-ই হোক না কেন এটাই সেই মৃত‍্যু পরবর্তী স্থান। তার হাত কেনো বাঁধা? তাহলে এটাই কি নরক!তাকে কি শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? এখানে তার 'সু' নেই! নেই সেই পরিচিত আস্তানা। কিন্তু কখন কি করে তার মৃত‍্যু ঘটলো কিছতেই মনে করতে পারলো না সে।আশেপাশে সান্টুকে খুঁজলো...সান্টু কি এসেছিল তার সাথে দেখা করতে? আর মা! মাকে কি একবার দেখতে পাবো? সান্টু আর মা তারা কি এখানেই আছে?'

এখন  সুচরিতার কথা শুনে অরুনাভ তার জীবনে দেখা হাসপাতাল ঘরের কথা মনে করার চেষ্টা করতে  গিয়ে সেই সরকারি হাসপাতালের দৃশ‍্য মনে পরলো... সেটার তুলনায় এই হাসপাতাল বেশ গোছানো, ,পরিচ্ছন্ন আর বড়। তাছাড়া 'সু' বললো ওর অজ্ঞান অবস্থায় এখানে আনা হয়েছিল তাই হয়তো এটা যে হাসপাতাল তা বুঝতে পারেনি। পরের দিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এ‍্যাম্বুলেন্সে করে এনে আর স্ট্রেচারে করে বাড়িতে তার ঘরে বিছানায়  তুলে শোওয়াতেই অরুনাভর মনটা চনমনে হয়ে উঠলো, বললো,-"বাথরুমে গেলে ভালো হয়।-"  -"দাঁড়াও একটু,তুমি একা পারবে না, শ্রুতি ওষুধ কিনতে গেছে দেরী হবে ফিরতে। আমি দরজা দিয়ে এসে তোমাকে ধরছি।" সুচরিতার উত্তর শুনে  অরুনাভ বিড়বিড় করে বললো -"আমি একাই পারবো।" সুচরিতার কানে সে কথা ঢুকলো না সে অক্সিজেন সিলেন্ডারের ভাড়া কতো পরবে সেই প্রশ্ন করতে করতে স্ট্রেচার বাহকদের সাথে বাইরের ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।। সকলে বেড়িয়ে যেতে সুচরিতা দরজা বন্ধ করে এদিকে আসলো । ততক্ষণে অরুনাভ শোওয়া অবস্থাতে পেছন ঘষে ঘষে  বিছানা থেকে নেমে পরেছে। তার নাকে যে অক্সিজেনের পাইপ ঢোকানো আছে তা সে খেয়াল করেনি। এই অবস্থায় তাকে দেখে সুচরিতা ছুটে এসে তার নাক থেকে অক্সিজেনের নল টা খুলে ওকে ধরতে গেলে -"আমি একাই পারবো।"বলে এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে দুপা এগোতে গিয়ে অরুনাভ টলে পরে যাচ্ছিল। সুচরিতা ওকে ধরে ফেলে বললো,-"আঃ! তুমি এখন দুর্বল  একা পারবে না।" অরুনাভ আবার ওর হাত ছাড়িয়ে টলতে টলতে এগিয়ে গেলো। রান্নাঘরের পরেই বাথরুম কিন্তু রান্নাঘর ছাড়িয়ে আর সে এগোতে পারলো না সেখানে দাঁড়িয়েই প্রস্রাব করে ফেললো। সুচরিতা আর চুপ করে থাকতে পারলো না। অরুনাভকে ধরে জোর করে বিছানায় এনে শোওয়ালো।বললো,-"কদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাটিয়েছো এখন তুমি দূর্বল। মাথা টলছে, কটা দিন যাক,তারপর একা একা যেও বাথরুমে।"এইটুক পরিশ্রমেই ক্লান্ত অরুনাভর দুই চোখে ঘুম নেমে এলো। শ্রুতি ফিরে এসে সব শুনলো তারপর ফেরার সময় মামুর কপালে হাত রাখতেই চোখ খুললো অরুনাভ। শ্রুতি বললো,-"মামু,তুমি একদম একা একা বিছানা থেকে নেমো না ক'দিন।তোমার কয়েকদিনের মধ্যে সব শক্তি ফিরে আসবে তখন যা মন চায় কোরো। জানোতো মামীর কোমরে কষ্ট হয়, তুমি যদি দুষ্টুমি করো মামী তোমাকে একা একা সামলাবে কি করে! আমাকে এবার বাড়ি ফিরতে হবে।" অরুনাভ ওর হাতটা চেপে ধরে উঠে বসলো।মনে মনে ভাবলো 'বিছানা থেকে না নামি উঠে বসতে তো পারছি।' জড়ানো কন্ঠে বললো,-"তুই আবার  আসিস কিন্তু, অনেক কথা আছে। না না অনেক না শুধু দুটো কথা আছে।"শ্রুতি কান পেতে অরুনাভর কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলো..কিছুটা বুঝে বললো,-"আসবো তো আবার কালকে, এখন জানোতো আমাকে ফিরতে হবে,অনেকদূর,রাত হয়ে যাবে।।"অরুনাভ আর কিছু বলার চেষ্টা না করে শ্রুতির হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো,-"যাঃ।" শ্রুতি চলে যেতে সুচরিতা ওর কাছে এসে বললো,-"জানোতো সকালে টাটকা মাছ কিনেছি। একটু গরম গরম ঝোল-ভাত চটকে তোমাকে খাওয়াবো,প্লিজ ওঠার চেষ্টা কোরো না,আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।" 

পরের দিন সকাল থেকে সুচরিতা অরুনাভকে চা খাওয়ানো,মুখ ধোওয়ানো,বাথরুমে নিয়ে গিয়ে  কমোটে ধরে ধরে বসানো, উষ্ণ গরম জলে গা স্পঞ্জ করানো ইত্যাদি সমস্ত কাজ করে বিছানাতে বালিশে ঠেসান দিয়ে বসিয়ে রান্নাঘরে গেল। বিছানায় বসে বসে অরুনাভ রান্নাঘরে স্ত্রীকে দেখছিল আর ভাবছিল,-' আহা বেচারি,কোমরে যন্ত্রনা নিয়ে আমার  কতোনা শুশ্রূষা  করছে। আসলে আমি তো ওর একমাত্র ভরসা। আমার সংসারে এই মানুষটাকে কতোটুকই বা সুখ দিয়েছি! আর কবেই বা দেবো সুখ?' দুপুরে যত্ন করে তাকে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে সুচরিতা বললো,-"তোমাকে হাসপাতালে নাক দিয়ে খাওয়ানো হতো,তোমার জ্ঞান ছিলনা। শ্রুতি এ কয়দিন সমস্ত খরচ করেছে,আমাদের প্রাইভেট হাসপাতালে খরচ করার মতন ক্ষমতা কোথায়? তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে তবে আমার শান্তি।"অরুনাভ সুচরিতার কোমরে হাত রাখলো।সুচরিতা বললো,-"হ‍্যাঁ কোমরে অসহ‍্য যন্ত্রণা করছেই তো,আমি কি পারি তোমাকে টেনে টেনে বার বার বাথরুম-ঘর করতে! তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হলে আমার সুখ আর শান্তি।" সন্ধ‍্যেবেলা সুচরিতা অরুনাভকে ধরে ধরে ড্রইং রুমে এনে সোফায়  বসিয়ে টিভি চালিয়ে দিয়ে বললো,-"টিভি দেখো বসে বসে।আজ শ্রুতি আসতে পারলো না ওর ননদ এসেছে...বলেছে মামুর কিছু কথা থাকলে হোয়াটসএ‍্যাপে ভয়েস ম‍্যাসেজ পাঠাতে..আমি বলেছি ও সব আমি পারিনা,আর তোর মামু মনে হয় কেমন করে ওসব করতে হয় সেই কায়দাটাই ভুলে গেছে।" সোফাতে বসিয়েই রাতের খাবারটা খাইয়ে দিলো সে। বললো,-"শ্রুতি বলছিল 'মামি,তোমার কোমরে কষ্ট তাই বলছি একটা আয়া রাখো'...."অরুনাভ জরানো গলায় হাত নেড়ে বললো,-"নো আয়া,আমি নিজেই সব পারবো।" সুচরিতা -"আচ্ছা বেশ বেশ।" বলতে বলতে হাসিমুখে তার মুখ ধুইয়ে মুছিয়ে এঁটো থালা রাখতে গেল। অরুনাভ ভাবলো,-'না কোনো আয়া টায়া নয়,বুঝতে পারছি 'সু'এর কষ্ট হচ্ছে। আজ আমি  নিজে নিজেই ওঘরে নিজের বিছানায় শুতে যাবো।' যেই ভাবা সেই কাজ,সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।একপা এগোলো সঙ্গে  সঙ্গে মাথাটা ঘুরে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পরে গেল মেঝেতে। শব্দ শুনে ছুটে এলো সুচরিতা। চিৎকার করে উঠলো,-" কি কান্ড করেছো...সারাদিন এতো করলাম আর এইটুক পারতাম না! কেন তুমি উঠতে গেলে?" সুচরিতা তার শরীরটাকে তোলার চেষ্টা করতে যেতে তার হাত ছেড়ে মেঝেতে শুয়ে পরলো অরুনাভ, তার শরীরটা যেন ছেড়ে দিয়েছে, মাথা তুলতে পারছে না। আর্ত চিৎকারের সাথে সুচরিতা পাড়া প্রতিবেশিকে ডাকতে লাগলো আর বলতে লাগলো,-"আমি কি আমার কোমর ভেঙে তোমাকে তুলতে পারি....কেন এতো কষ্ট দাও আমাকে...তোমার জন‍্য আয়াই ভালো আমার দ্বারা সম্ভব নয়।"  কি করবে বুঝতে পারছে না সে উপস্থিত বুদ্ধি আর কাজ করছে না সোফার ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে শ্রুতিকে কল করে এক নিশ্বাসে সব বলে শেষে কেঁদে বললো,-"আমি আর পারছি না,তুমি আয়া সেন্টার থেকে আয়ার ব‍্যবস্থা করো।" শ্রুতি ঠান্ডা গলায় বললো,-"বুঝতে পারছি, দরজাটা বন্ধ আছে, দরজাটা খুলে জোরে জোরে  ডাকো,এখন শীতে সবাই যে যার ঘরের দরজা বন্ধ রেখেছে। তোমার ওপরের তলার ভাড়াটে তার ফোন নম্বরটা আজই আমাকে  দিয়েছিলেন, দাঁড়াও,আমি তাঁকে ফোন করছি।"


মরমে মরে যাচ্ছে অরুনাভ। "এমনটা আমি চাইনি,চেয়েছিলাম 'সু'কে সাহায্য  করতে কিন্তু ফল হলো উল্টো। মনে হচ্ছে এই ভাবে বেঁচে থাকার চাইতে মরে গেলেই ভালো হতো। কিন্তু আমি মরলে 'সু'এর কি হবে! তার চাইতে আর দুষ্টুমি করবো না। 'সু' বললো আয়ার কথা! মা,মাগো, তোমাকে আমি নিজের হাতে সেবা করেছিলাম...লেখাপড়া ছেড়েছিলাম। তোমার কি আর আমার কথা মনে পরে না! তোমাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। "

পরের দিন সকাল থেকে অরুনাভ সুবোধ বালকের মতন সুচরিতার কথা মতন চললো। প্রাণ ভরে সুচরিতার শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করলো। মনে হলো এযেন তার মায়ের গায়ের গন্ধ!তার কাঁধ ধরে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছের চেয়ারটাতে বসে পরলো সে। সুচরিতা চা-বিস্কুট  দিতে ওখানে বসে নিজে  নিজেই খেলো। মনে হচ্ছে আজ শরীরটা একটু ভালো আছে। চা পান শেষে তাকে বিছানায়  বসিয়ে ফোনটা ওর হাতের কাছে রেখে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সুচরিতা বললো-"আটটার সময় আয়া আসবে তার আগে আমি স্নান সেড়ে আসছি।তুমি কিন্ত উঠতে যেও না,পরে গিয়ে  যদি পঙ্গু  হও তাহলে তোমারও কষ্ট আমারও কষ্ট।" দেওয়াল ঘড়িটা দেখলো অরুনাভ,সাড়ে ছটা বেজে গেছে। সুচরিতা বাথরুমে। ফোনটা বাজতে হাতে তুলে কলটা রিসিভ করলো। শ্রুতির গলা,-"মামু কেমন আছে মামি?"-"ভালো আছি।"অরুনাভ বললো। শ্রুতি বললো,-"বাঃ! লক্ষ্মী ছেলে। মামিকে ফোনটা দাও।" অরুনাভ কিছু বলতে চায়,বললো,-"মামী স্নান করছে। একটা কথা ছিল।"

-"তাড়াতাড়ি বলো,আমি কাজ করছি।"

-"তোর মাকে দেখে মামীকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ওর বাবা। তুই জানিস?"

-"হুম জানি তো।"

-"অনেক থ‍্যাঙ্কস তোর মাকে। তোর মা তো আর নেই তাই তোকেই  বলছি মামিকে দেখিস....হ‍্যাঁ আমাকে তো দেখলি এবার  মামির খেয়াল রাখিস।"

-"মামু তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছিনা রেকর্ড করে রাখলাম,ধীরে সুস্থে পরে শুনবো,এখন রাখলাম কেমন। মামিকে বোলো ফোন করতে।"

আয়া এসেছে। সুচরিতা নিশ্চিন্ত। তবু নিজের হাতে তার সেবা করছে আর বলছে -"ভয় নেই,আয়ার হাতে তোমাকে পুরোপুরি ছাড়বোনা,ও রইলো হেল্পার হিসেবে। যদিও দৈনিক তিনশো টাকা তবু থাক।" দুপুরে গা স্পঞ্জ করে যত্ন করে ঝোল-ভাত খাওয়াতে  বসলো সুচরিতা। আয়া জলের গ্লাস ধরে তার পাশে দাঁড়িয়ে।  মুখ ধোয়ানোর সময় তার মাথায় নিজের হাত ছোঁয়ালো অরুনাভ। সুচরিতা হেসে বললো,-"আজ তোমাকে  অনেকটাই সুস্থ লাগছে, মনে হচ্ছে আর ক'টা দিনের মধ‍্যে তুমি নিজের পায়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়াতে পারবে। নাও এখন ওষুধটা খেয়ে শুয়ে পরো,শুইয়ে দেবো? আর, হ‍্যাঁ, শ্রুতি ঘন্টা দুয়েকের মধ‍্যে এসে যাবে, ওকে নাকি তুমি কিছু বলতে চেয়েছো?" ভরাপেটে অরুনাভর ঘুম ঘুম পাচ্ছে চোখ বুঁজে আসার আগে মন প্রাণ দিয়ে সুচরিতাকে দেখছে আর ভাবছে,-আমার মা দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পঙ্গু ছিলেন,আমি তাঁর সেবা করলে তিনি  তাঁর সুস্থ হাতখানা আমার মাথায় রাখতেন। ওইটুকুই ছিল আমার বল আমার ভরসা। আজ আমার সেবা করে মায়ের অসম্পূর্ণ কাজ তুমি সম্পূর্ণ করছো 'সু'। মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন তোমার সেবা যদি পাই.... কিন্তু অনেক তো বয়স হলো...তোমার এই সেবাতেও সেই হারিয়ে যাওয়া বয়সটা ফিরে আসবে না,তোমার ভরসা হয়ে দাঁড়ানোর সেই শক্তিটা আর ফিরে পাবোনা। আসলে এখন আমি তো পঙ্গু  হয়েই গেছি 'সু'। অনেক চেষ্টা করেও এই জীবনে তোমাকে সুখ দিতে পারলাম না তাই আজ আর বোঝা হতেও মন চায়না। এবার আমাকে বিদায় নিতেই হবে'সু', তুমি যে কটাদিন বাঁচো সুস্থ হয়ে বাঁচো। দেখি মৃত‍্যুর পর তোমাকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারি কিনা! উফ্ বড্ড ঘুম পাচ্ছে।" সুচরিতা ওষুধ খাইয়ে তাকে যত্ন করে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নিজে ডাইনিং টেবিলে খাওয়া শেষ করে আরো একবার  অরুনাভর গালে,মাথায় হাত বুলিয়ে বসার ঘরে গেল। ঘুমের মধ‍্যে অরুনাভ প্রাণ ভরে সুচরিতার স্নিগ্ধ স্পর্শ আর শরীরের গন্ধ অনুভব করলো। আয়া টিফিন খেয়ে শোওয়ার ঘরের চেয়ারে বসে রইলো। শ্রুতি এসেছে। আয়া এসে বললো,-"দাদার বুক আর ওঠা নামা করছে না মনে হচ্ছে।" সুচরিতা আর শ্রুতি ছুটে  গেল ওই ঘরে। নাকের তলায় হাত রাখলো সুচরিতা অস্ফুট স্বরে বললো,-"নাঃ নিশ্বাস পরছে না।"পায়ের তলায় হাত ছোঁয়ালো,-"ঠান্ডা!" শ্রুতি বল্লো,-"কি করে হলো!আজই তো ফোনে কতো কথা বললেন মামু! দেখি রেকর্ড করা আছে। গমগমিয়ে রেকর্ডের শব্দ ধ্বনিত হলো,-"তোর মাকে দেখে তোর মামীকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ওর বাবা। তুই জানিস?"

-"হুম জানি তো।"

-"অনেক থ‍্যাঙ্কস তোর মাকে। তোর মা তো আর নেই তাই তোকেই বলছি, মামিকে দেখিস....হ‍্যাঁ আমাকে তো দেখলি এবার  মামির খেয়াল রাখিস।"


সুচরিতা জলভরা চোখে অরুনাভর শরীর জড়িয়ে তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বোললো,--" তুমি তো জানো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না তাই আমাকে যে কথা দিয়েছিলে সেটা কিন্তু রক্ষা কোরো,আমি দিন গুণবো।"

Post a Comment

Previous Post Next Post