' একটা কথা তোমায় না বলে পারছিনা জানো , আমাদের এই স্বামী - স্ত্রীর সম্পর্কটা ঠিক যেনো বইয়ের প্রকাশক আর লেখকের মতো। তুমি হলে আমার লেখক আর আমি হলাম তোমার প্রকাশক। কারোরই কাউকে ছাড়া চলে না।' এই কথা বলেই সুপ্রিয় হেসে উঠলো। ঠিক তখনই সুমনা বলে উঠলো , ' কি ব্যাপার ? সকাল সকাল কি হলো তোমার ? না গো , সত্যি বলছি , আমি অনেক ভেবে দেখলাম সত্যি, তুমি ছাড়া আমি একেবারেই অচল।' এবার সুপ্রিয়র কথায় মুচকি হেসে সুমনা ভাবতে বসলো , ' সত্যিই কি তাই ? নাকি পুরোটাই অভ্যেস ? '
প্রায় ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক চড়াই , উৎরাই পেরিয়ে আজ থিতু হয়েছে ওরা। একটা কথা সুপ্রিয়র প্রায়ই মনে হয় , এই ত্রিশ বছরে সুমনাকে ও নিজের করে পেয়েছে কতবার ? বাড়ির বড় বউ হওয়ার সুবাদে সুমনা সবসময় সবার জন্যই বরাদ্দ। সুপ্রিয়র জন্য আলাদা করে সময় দেওয়ার মতো সময়ই নেই তার। এই বিষয়ে সুমনা অবশ্য অবিচল থেকেছে সবসময়। এতে যে তার স্বামীও কিছু মনে করতে পারে , সেবিষয়েও কোনো হুঁশ নেই তার। কারণ তার কাছে সংসার আর স্বামী একই । সংসারে সবার সেবা করা মানে আসলে স্বামীরই সেবা করা।
পড়াশোনা জানা একজন শিক্ষিত মেয়ের থেকে সুপ্রিয়র আশা ছিল অনেক। সংসারের কাজের পাশাপাশি বাইরের জগতের কাজও সে ভালোভাবে সামাল দিতে পারবে , এমনটাই সে ভেবেছিল। কিন্তু তার সমস্ত ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে সুমনা বাইরের সব ব্যাপারেই সুপ্রিয়র ওপরে নির্ভর করা শুরু করলো। এতে সুপ্রিয়র সত্যি মনে মনে বেশ রাগ হতে শুরু করলো। তার মনে হতো , 'একবার দেখেই যাকে সারা জীবনের সঙ্গিনী হিসেবে বেছে ছিলাম , এবং শুধু তাই নয় , যাকে দেখেই মনে হয়েছিল , এই পারবে সময়ে , অসময়ে আমার পাশে থাকতে। সে কিনা সব কিছুতেই আমার ওপরে নির্ভরশীল ? ' বলাবাহুল্য এইজন্যই সে সুমনার ওপরে অভিমান করে হঠাৎই কাজের সূত্র ধরে কিছুদিনের জন্য বাইরে চলে গেলো। দূরে বসে সুমনাকে স্বাবলম্বী করে তোলাই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য। অবশ্য এতে সুমনার কোনো অসুবিধাই হলো না। কারণ সে তো ছিল শিক্ষিত ও কর্মঠ । তাই তো প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে সংসারের ঝক্কি সামাল দেওয়ার পাশাপাশি সে বাচ্চা পড়ানোর কাজও শুরু করে দিলো। এদিকে সুমনাকে আত্মনির্ভরশীল করতে গিয়ে সুপ্রিয় নিজেকে বড্ড বেশি পরনির্ভরশীল করে তুললো। ফলত সব অভিমান ভুলে সে আবার বাড়ি ফিরে এলো।
একদিন বিকেলে চায়ের টেবিলে সুপ্রিয় সুমনাকে জিজ্ঞেস করলো , ' তোমার জীবনে প্রথম প্রেম কিভাবে এসেছিল ? সুমনা হকচকিয়ে বলে উঠলো , মানে ? হঠাৎ করে তোমার যে কী হয় ? বলো না , বলো না ! অনেক অনুরোধের পরে সুমনা বলতে শুরু করলো, আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে , এক শুভ সন্ধ্যায় আমার প্রথম প্রেম এসেছিল। খুব সুন্দর করে সেজেগুজে সে আমায় নিতে এসেছিল। তাই ? বলে সুপ্রিয় একটু থেমে বলে উঠলো , অ্যাই কি বললে তুমি ? আমার সাথে মজা হচ্ছে ? আমার কথা , আমাকেই বলছো ? উত্তরে সুমনা বললো , কি করবো বলো ? যা সত্যি তাই তো বলবো নাকি ? এবার বলোতো তোমার প্রথম প্রেমের কথা ! সুপ্রিয় বললো , আমার প্রথম বলো আর শেষই বলো , সবই তুমি ! এতই যখন মিল দুজনের , তাহলে তারপর কেনো জীবনটা অন্যখাতে বয়ে গেলো বলতে পারো ? এই বলে সুমনা বলতে শুরু করলো , আমার পছন্দ , অপছন্দ , ভালোলাগা , মন্দলাগা কোনো কিছুরই কি খবর রাখতে তুমি ? এই বলে থামতেই সুপ্রিয় বলে উঠলো , তুমি তো সবসময় সবাইকে নিয়ে এমনভাবে ব্যস্ত থাকতে যেনো কোনকিছুরই তোমার দরকার নেই। তুমি সবদিক থেকে পরিপূর্ণ ! কথা শেষ হতেই সুমনা বললো , একজন মানুষের বৈশিষ্ট্যই যদি বুঝতে না পারলে , তাহলে তাকে কিভাবে ভালোবাসলে ? শোনো তবে , দুজন অপরিচিত মানুষ বিবাহসুত্রে যখন একসঙ্গে থাকতে শুরু করে , তখন একটু একটু করে দুজনই দুজনের সব ভালোলাগা , মন্দলাগা , সব পছন্দ - অপছন্দগুলোও জেনে নেয়। এরই নাম ভালোবাসা , এরই নাম প্রেম। তুমি কোনদিন জানতে চাওনি দেখে আমি মনে করেছি , তুমি আমায় পছন্দ কর না! তাই তোমার সাথে চাওয়া - পাওয়ার হিসেবও করিনি আর তোমার সব কাজের সঙ্গী হতেও আমি চাইনি ! আজ " পড়ন্ত বিকেল" এ এসে আর এই নিয়ে হিসেব নাই বা কষলে ! বিশ্বাস করো , আমার সত্যি তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আমি যা পেয়েছি , তার জন্য আমি ধন্য ! আর যা পাইনি , তা আমার পাওয়ার ছিল না , বলেই আমি পাইনি। এই নিয়ে তুমি নিজেকে অভিযুক্ত কোরো না । চলো আমরা সবকিছু ভুলে বাকি জীবনটা নিজেদের নিজেদের মতো করে কাটাই , যা তুমি সর্বক্ষণ চেয়ে এসেছো ! অনেক্ষন নীরব থাকার পর সুপ্রিয় এবার বলে উঠলো , তুমি যাই বলো সুমনা , আমি সত্যি তোমার কাছে হেরে গেছি ! জীবনের এই শেষ বেলায় এসে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে তুমি সত্যি স্বাবলম্বী হতে পেরেছো, যা আমি পারিনি। আমার নিজের সম্বন্ধে দর্প চূর্ণ হয়েছে। আচ্ছা হয়েছে, বাবা হয়েছে , আজ থেকে শুধু আনন্দ , এই বলে দুজনেই শেষ বিকেলে একমত হলো।'