মা বলে রবীনের মত ছেলে হয় না। কী সুন্দর দেখতে ! গায়ের রং যেমনি , স্বাস্থ্যও তেমনি ! এক নজরেই প্রত্যেকের ভালো লেগে যাবে।কথাবার্তা কী সুন্দর ! আস্তে আস্তে বলে , গলা চড়ে না কখনও।
দীপকের আবার এত শুনতে ভালো লাগে না। মা র খুব বাড়াবাড়ি। কিছুটা কারণ অবশ্য আছে। বাপ - মা মরা সাত ভাই - বোনের মধ্যে সব থেকে ছোট রবীন। বাবা- মাকে পেলো কোথায় ! দেখলেই মনে হয় , চোখ দুটো সবসময় কী যেনো খোঁজে ! আহারে!
চার ভাই আর তিন বোনের জগৎ রবীনের। দাদা - দিদি প্রত্যেকেরই বিয়ে - শাদি সারা। ভরা সংসার সকলের। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর রবীন এখনও কোনো চাকরী জোগাড় করতে পারলো না। থাকে বড়দার আশ্রয়ে। ভাইপো - ভাইঝিদের সঙ্গে বেশ মিল। ওরাও কাকা বলতে অজ্ঞান। এসব দেখে দীপা বৌদি সবসময় মুখ বাঁকায়। যদিও ফাই- ফরমাস খাটাতে ভোলেনা দেওরটিকে দিয়ে। ছোট ভাইয়ের প্রতি দাদার স্নেহধারা এখনও শুকায়নি।
আমাদের দলের নিত্য সদস্য ও নয়। বয়সে ছোট। তবু ও সন্ধ্যের পর হরিদার দোকানে আমাদের আড্ডায় মাঝে - মাঝে এসে বসে, বকর বকর করে। খুব একটা পাত্তা পায় না।
সন্ধ্যের পর আমাদের বন্ধুদের কাছে হরিদার দোকানটা যেন ছিল এক অমৃত ধাম। ছাড়াতে হাজার চেষ্টা করেও যায় না এর টান। অফিস ছুটির পর রাত আটটা নাগাদ আমাদের একমাত্র ঠিকানা ছিল ওটাই। দোকানটা আসলে এক মিষ্টির দোকান। বাজারে হরিদার দোকানের চায়ের খ্যাতি। ঐ টানেই মেলা লোক আসতো দুবেলা। আমাদের তো ছিল বাঁধা ঠেক। দোকানদার হরিদা স্বয়ং ছিলেন আমাদের আড্ডার পার্টনার।
আড্ডায় আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে মায়ানমারে সাম্প্রতিক সেনা তৎপরতা, গ্রেটা থুনবার্গকে সঙ্গে নিয়ে আমরা 'এ্যাসেজ' বিজয়ের লড়াইতে অস্ট্রেলিয়ার পীচ চষে ফেলতাম। আলোচনার বহর ছিল এরকম বিশাল।এর মধ্যে একদিন রবীন এসে জুটল - একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। আমরা আকাশ থেকে পড়লাম।
ফাতনা , লাটাই - ঘুড়ি , দমদম - শেয়ালদা - ঘুঘুডাঙা ভোস .... ভো .... ভো .... স লোকাল তো চলছিল অনেকদিন ধরে। বড়দার বাড়িতে শোয়ার ঘরের জানালা থেকে গোলাপী - হলুদ তিনতলা ছাদের দূরত্ব তো বেশি নয় খুব ! রবীনের আক্ষেপ ছিল, এই দূরত্ব যে কবে শেষ হবে ! বড় আমরা। কৌতুহল বাঁচিয়ে রেখেছিলাম , দেখা যাক্।
সেদিন ছুটে এলো রাত আটটার ঠেকে আমাদের কাছে। দীপক আর শান্তকে সামনে পেয়ে বলে উঠলো , দাদা একেবারে ফেঁসে গেছি। এবার বাঁচান। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো রবীন। কাঁধে ব্যাগ, কী সব ঠাসা আছে। শান্ত না তাকিয়ে বলে ওঠে , ফেঁসে গেছো তো অনেকদিন আগেই। আজ আবার নতুন কী হলো ?
দাদা , রমা বিয়ের জন্য তাগাদা দিচ্ছে। নইলে ওর বিপদ। লোকাল থেকে একেবারে এক্সপ্রেস ট্রেন! কী ব্যাপার ! কবে ঘটলো এত পরিবর্তন ? রবীন বলে , সে অনেক ব্যাপার , পরে শুনবে না হয়। এখন বলো কী করি ?
রবীনের থুতনি ছুঁয়ে মুখে চুক - চুক আওয়াজ তুলে শান্ত বলে , আহা চাদুরে আমার ! ফাঁস গ্যয়া তো ক্যা করি!
রবীন বেজার মুখে বলে , মজার কথা নয় শান্তদা। বিয়ে করব বলে তো রাজী। কিন্তু থাকা হবে কোথায় ? দাদার এখানে থাকা যাবে না। বেকার ভাই , বিয়ে করে দাদার হোটেলে ! বৌদি দেবে আর কি ! যতক্ষণ ছিল সে রাতে হরিদার দোকানে , সারাক্ষণ এক পেঁচাল গেয়ে গেল।
পরদিন থেকে দোকান বন্ধ। গুরুতর অসুস্থ হয়ে হরিদা হাসপাতালে। ঠেক অচল। কয়েকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই আমাদের। ইতিমধ্যে লোকমুখে জানা গেল , বড়দাই নাকি নিজের বাড়িতে তুলেছে ভাইবৌকে। পাড়ার মেয়ে , পাড়ারই এক বাড়িতে বৌ সেজেছে।
আবার একদিন এল রবীন , আমাদের রাত আটটার আড্ডায়। খুব হাসি - খুশী। একটা নাকি চাকুরী বাগিয়ে নিয়েছে। রমার অস্বস্তির জন্য ওকে আলাদা ডেরা খুঁজতে হচ্ছে। দাদা - বৌদি এখনও জানে না।
বাড়ি কই ! সহজে পাওয়ার কথা নয়।রবীনের সঙ্গে আমরাও চিন্তায়। বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পর হরিদাই একটা সন্ধান জানাল। দালাল মারফৎ নয়। হরিদার ই এক দুঃসম্পর্কের দিদি ডালিমতলা লেনে থাকে একা একা। শ্বশুরবাড়ির ভিত। দোতলা বাড়ি। ছেলে বাইরে থাকে। দীর্ঘসময় ব্যবধানে কলকাতা আসে। একজন অতি বিশ্বস্ত , আপন লোক খুঁজছেন দিদি। খালি কটা ঘর ভাড়া বসাবেন। যে থাকবার , দেখাশোনা করবে , আর নামমাত্র ভাড়ায় থাকবে। রবীনের পছন্দ হয়ে গেল বাড়ি দেখে। হরিদার দিদির ও তাই। রমা দিদিকে প্রণাম সেরে পিসি সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলল। দু পক্ষই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো শেষ পর্যন্ত। রমা এবার খুব খুশী। বাড়িওয়ালী পিসি , মানে হরিদার দিদির একটাই শর্ত ছিল রমাদের কাছে , বাড়িতে থাকবে বাড়ির ছেলে - মেয়ের মতই। আমার মার ভালোছেলের এতাদৃশ ভালো পরিণতি , পাড়া - প্রতিবেশী সকলেরই মনে ধরল।
কর্মস্থলের কাজের চাপ , ট্রান্সফার , সংসারের জগদ্দল পাথর , সব সামলে আমরা তখন লক্ষ্মীছাড়া। চারদিকে ছিটকে পড়েছি। হরিদার দোকানের আড্ডা গেছে। আমি ছাড়া আর কেউ আসে না। হরিদা আর আমি এই দুইয়ে মিলে আড্ডাকি তেমন জমে ! মনটা সবসময় উশখুশ করত রবীনের খবর ছাড়া।
একদিন হরিদার দোকানে আমাকে খুঁজতে এসেছিল রবীনের বড়দার বড় ছেলে নিমু। বাবা শয্যাশায়ী , কাকাকে দেখতে চায়। উৎসাহ নিয়ে হরিদার দিকে তাকালাম। উনিই তো দিতে পারেন , রবীনের খবরাখবর যা কিছু। অবাক হলাম , হরিদা চোখ নাড়িয়ে আমাকে কী যেন বারণ করছে।
ভাইপোকে চায়ের কাপ নিয়ে পাশে বসিয়ে জানতে পারলাম ওর ভালো কাকার সব কীর্তি - কাহিনী। নিমুর মুখে একটাই কথা , বাবা একটা কথাই কাকার কাছে জানতে চান , বাবা - মা মরে গেলে , ' যে ভাবে নানা বিপত্তির মধ্য দিয়ে তোকে বড় করেছি , বিয়ে দিয়ে থাকতে দিয়েছি আমার এই ছোট জায়গায় , তার কি এই প্রতিদান দিলিরে আজ রবীন ? ' ছেলেটা বলে আর কাঁদে। আহত মনে দীর্ঘ বিবরণ জানতে আর প্রবৃত্তি হল না ভাইপোর কাছ থেকে।
নিমুকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে , 'রবীনের খোঁজ যদি না ও পাই আমি একদিন যাব তোমাদের বাড়িতে।'
ভাইপো চলে গেলে আড়ালে হরিদা আমাকে শোনাল ভাল ছেলের আরেক কাহিনী।
থাকতে থাকতে বাড়িওয়ালি পিসীর সঙ্গে বেশ জমে উঠেছিল রমা আর রবীনের। হঠাৎ জুটে যাওয়া ভাইপো - ভাইঝিতে পিসী , মানে হরিদার দিদির হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল। এটা সেটা বাড়ির নানা কাজে - ব্যাংক , পোষ্ট অফিস , বাজার - দোকান , সবেতেই রমা আর রবীন। এদের ছাড়া চলে না। আজকালকার ছেলেমেয়ে নিজেরটা ভালো বোঝে।
বুঝলও তাই। পিসীকেও বুঝিয়ে ছাড়ল একসময়। নানা কেরামতির মধ্য দিয়ে পিসীর সইটা রপ্ত করে নিয়ে কোথাকার কোন আব্রাহামের হাতে বাড়ির দলিলটা তুলে দিল একদিন। কড়কড়ে নগদ নিয়ে এক হাতে , দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে বোকা বানিয়ে এক রাতে ডালিমতলা লেনের পুরনো গলি ছেড়ে কোনো এক অজানা দেশে পাড়ি দিল , কেউ খবর রাখল না তার। কদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি বলে পিসীকে জানিয়েছিল ওরা দুজন।এরপরেই রমা আর রবীন চিরদিনের জন্য সকলের হাতের বাইরে চলে গেল।
পিসী আগের অবস্থায় ফিরে এল। সামনে তার আব্রাহাম।