ট্রেনের মধ্যে বসে মোবাইলে কথা বলতে বলতে চলেছি। নিচে পায়ে যেন কিছু একটা লাগলো মনে হলো! নুয়ে দেখলাম একটা ডাইরি পড়ে রয়েছে। তুলে পাশাপাশি যাত্রীদের জিজ্ঞেস করে জানলাম কারো নয়। কৌতুহলী মন ভেতরে কী আছে জানবার জন্য ছটফট করে লেখা। বুঝলাম অন্য কেউ লিখেছে। খুব সুন্দর করে লেখা কিছু ঘটনা পড়তে সময় কেটে যাচ্ছিল। ভাবলাম আমার লেখার সম্পদ হলো। কয়েক পাতা পর দেখি পাতার ভাঁজে দুটো পাঁচশো টাকার নোট। দারুন প্রাপ্তি । যাক লাভই হলো।
এবার মন বিরোধিতা করল। ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
ফোন করলাম। অপর প্রান্তে মহিলা কন্ঠ। বললাম "তিমির বাবু আছেন ?"
"কে আপনি ?"অপর প্রান্ত থেকে জানতে চাইল।
"আমি তিমির বাবুকে চাইছি ।"
"আচ্ছা মা কে দিচ্ছি", বলে চলে গেলেন।
"হ্যালো , কে বলছেন ?"-মহিলার কন্ঠ।
তাঁকে বললাম কী জন্য ফোন করেছি । "
"উনি তো গতবছর মারা গেছেন।"
অবাক হলাম।
" উনার ডাইরী তো বৌমার কাছে থাকে ।" বলে বৌমাকে ডাক দিলেন।
"নমষ্কার বলুন " বললেন এক মহিলা।
আমি ডাইরিই কথা বলতেই উনি বিষ্ময় প্রকাশ করে "বললেন হ্যাঁ ওটা নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার ছেলেটা ট্রেনে পড়ছিল। আপনি পেয়েছেন ? খুব ভালো হলো। দয়া করে আপনি যদি আপনার ঠিকানা বলেন তবে আমি নিয়ে আসবো।"
আমি বললাম "আমি থাকি বেহালায়। আপনার বাড়ী কোথায় ?"
"আমি শ্যামবাজার । কষ্ট করে যেতে হবে ।",মহিলা বললেন।
"আপনার বাড়ির আর কেউ নেই যে এসে নিয়ে যাবে ?" আমি জানতে চাইলাম।
"আছে তবে সবাই ব্যস্ত । আমিই গিয়ে নিয়ে আসবো। রবিবার সকালে আপনার অসুবিধা আছে ? "
আমি বললাম, "রবিবার সকালে আমি একটু বাইরে যাবো । আপনি বিকেলে আসুন। "
"দেখি কী করা যায়" , বললেন মহিলা।
ডাইরিটির বাকী পাতা গুলো উল্টিয়ে পেলাম সুন্দর কিছু লেখা। বুঝলাম এ একজন সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষের ।
শনিবার সন্ধ্যায় ফোন করে জানাল রবিবার আসতে পারবেন না। অনুরোধ করলেন যদি আমি পৌঁছে দিই। রাগ হলো । ভাবলাম না নিয়ে এলেই ভালো হতো। এবার ঠেলা সামলাও।
কোন রকম ভাবে বুধবার সন্ধ্যায় সময় বের করে যাব বলে জানালাম।
যথাসময়ে পৌঁছে কলিং বেল টিপতেই একজন মহিলা দরজা খুলে সামনের শোফায় বসতে বললেন জ্যেঠিমা এখুনি আসছেন।
ঘরটি দামী দামী আসবাব পত্রে সাজানো, সৌখিন। সামনের টেবিলে আজকের আনন্দ বাজার পত্রিকা।
হাতে নিয়ে পড়ছি , এমন সময় ষাটোর্ধ্ব ভদ্র মহিলা এসে নমস্কার করে বসলেন পাশের সোফায়। সাদা শাড়িতে শ্রদ্ধার প্রতিমূর্তি।
বললেন তার স্বামী ছিলেন নাটক পাগল। তিমিরবাবু নাটক করতেন। সেটাই ছিল নেশা। তার নাটক দলে তিনিও নাটক করতেন। পরবর্তী কালে স্কুলে শিক্ষিকার চাকুরী পান এবং অনেক প্রতিকূলতাকে এড়িয়ে তিমির বাবুকে বিয়ে করেন। তিমিরবাবু সারা জীবন ডাইরি ব্যবহার করতেন। রোজনাপচা লেখার জন্য নয়। বিভিন্ন উক্তি , নাটকের ডায়ালগ লেখার জন্য। গত বছর সেরিব্রাল স্টোক হয় এবং তার দিন পর মারা যান।
এরমধ্যে একজন মহিলা প্লেটে গরম বেগুনী , মিষ্টি নিয়ে এলেন।
বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাটি বললেন, "এটি আমার বৌমা।"
এবার বললেন ,"আপনি একটু টিফিন করুন।"
আমি বললাম ,"আপনি আমাকে আপনি বলবেন না। তাছাড়া টিফিন কেন ? এক কাপ চা হলেই হতো ।"
"তা হয় নাকি বাবা ! তুমি আমাদের অতিথি, " বললেন তিনি।
খাবার ইচ্ছে না থাকলেও খেলাম। "তোমার বাড়িতো বেহালায় । দেশের বাড়ি কোথায় ? কী করা হয় ?"
"আমার দেশের বাড়ি বর্ধমানের কাছে এক গ্ৰামে। আমি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করি।"
বাড়িতে কে কে আছে ,পড়াশুনা কোথায় করেছি , কলকাতায় কত দিন আছি সব জিজ্ঞেস করলেন । বললেন তার একমাত্র পুত্র খুব মেধাবী ছিল । কোন একসময় ড্রাগ এট্রাকট্রেড হয়। অনেক চিকিৎসার পর সুস্থ হয় এবং একটা চাকরি পায় আই টি সেক্টরে। ভেবেছিলাম ওর আর সংসার হবে না।
বৌমা অনেক আগে থেকেই আমাদের নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত। পরে শিক্ষিকার চাকরী পায়। ওর জীবনেরও অনেক ট্রাজেডি আছে আমাকে বলেছিল। পরে বিট্টুকে বিয়ে করতে রাজি হয়।
যাই হোক অনেক কথা বলে ফেললাম মনে কিছু করো না ।" বলেই তিনি একবার ভেতরে গেলেন।
ফিরে এলেন অত্যন্ত সুন্দর কাপে চা এবং নিমকি নিয়ে।
আমি বললাম ,"ভালোই লাগলো আপনার সাথে কথা বলে।" আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ডাইরিটা উনার হাতে দিয়ে বললাম," দেখে নিন এর মধ্যে দুটি পাঁচশো টাকার নোট রয়েছে।"
হাতে নিয়ে বললেন," এখনো ভালো মানুষ আছে বাবা । তুমি অনায়াসে ঐ ডাইরিটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে হাজার টাকা নিয়ে নিতে পারতে ! কিন্তু তোমার শিক্ষা এবং সরলতা তোমার মানবিক রূপকে প্রকাশিত করেছে। তুমি ভালো থাকো।"
এক সুদর্শন ভদ্রলোক একটি আট দশ বছরের বাচ্চা কে নিয়ে বাইরে থেকে এলেন।
লোকটি নমস্কার করে বললেন ," আপনি নিশ্চয়ই ডাইরিটি নিয়ে এসেছেন ? খুব উপকার হলো। অনেক ধন্যবাদ।" কথাগুলোয় একটু জড়তা রয়েছে।
ভদ্রমহিলা বললেন " এই আমার ছেলে এবং বাচ্চাটি আমার একমাত্র নাতি। ছেলে চাকরি ছাড়া কিছু করতে পারে না। নাতি সাঁতার শিখতে গিয়েছিল। একজন এসে পৌছে দেয়।"
আমি বললাম "এবার আসি । "
বললেন তোমার কথা শুনতে খুব ভালো লাগছে। ডিনার করে যেও ।"
"না না । আমি আসছি । " বললাম।
"ঠিক আছে তোমার নম্বর তো আছে । আমাদের নাট্য উৎসবে এসো । এটাই কী তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ?"
"হ্যাঁ" -বলে বেরিয়ে এলাম।
বেশ কয়েকদিন পর আচেনা হোয়াটসঅ্যাপ -এ হাই লেখা দেখে লিখলাম, "কে আপনি ?"
"হারানো ডাইরি ফিরে পাওয়া একজন", লেখা উঠলো ।
"আচ্ছা । সকলে ভালো তো ?"
"হ্যাঁ ভালো"।
সেদিন রাতে হোয়াটসঅ্যাপ খুলতেই দেখি --
প্রিয় সুজন,
সেদিন তুই আমাকে চিনতে পারিস নি। আমি কিন্তু তোকে এক দেখাতেই চিনেছিলাম। তুই তো একদম আগের মতোই আছিস। দরজার ফাঁক দিয়ে তোকে আরো দু'বার দেখলাম। সাবলিল কথাবার্তা যেমন ছিল তেমনি আছে । শুধু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একটু ভারিক্কি হয়েছিস।
হয়তো ভাবছিস আমি কে ? বলছি।
তোর মনে পড়বে নিশ্চয়ই কলেজে তুই ছিলি ডান পন্থী। সব সময় তখনকার শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলো তুলে সভা করতিস। আমি ছিলাম বাম পন্থী। স্বৈরাচারী, বুজিবাদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতাম। দুজনের মত ছিল আলাদা কিন্তু মন ছিল এক।
এখনো ভাবছিস আমি কে ? দুজনে দুপক্ষে বিতর্ক করেছি কিন্তু নাটকে দুজনে প্রেমিক প্রেমিকা হয়েছি। বাস্তবে কখন তোর প্রেমে পড়ে গেলাম। তুই বলেছিলি তোকে ছাড়া বাঁচবো না। সময় পেলেই আমরা মিলতাম নির্জন জায়গায়। কত স্বপ্ন দেখতাম। একদিন দেখা না হলে কষ্ট হতো।
এরপর আরো বড়ো বড়ো ছাত্রনেতা হোলি।শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য আন্দোলন করতে আরম্ভ করলি। পরবর্তী কালে আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন রাজ্যে তুই চলে গেলি।
তোর দেখা পাওয়া কমতে থাকলো। একসময় তোর খবর কোন ভাবেই পেলাম না। তোর বাড়ি গেলাম মাসিমা বললেন তুই দিল্লিতে কী যেন পড়ছিস। আমি অবাক হলাম। এর মধ্যে বাবা মারা গেলেন। বাবার জমানো টাকা শেষ হলো বাবার ওষুখে। ভাড়া মেটাতে না পারায় বাড়ি ছাড়তে হলো। অসুস্থ মাকে নিয়ে কলকাতায় এলাম। যদি কোন কাজ পাই সেই আশায়!
আরো সময় কেটে গেল। যে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না সে আমাকে জানালো না কোথায় কী করছে ! নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিলাম। সেই সময় আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন মিসেস সরকার (বর্তমানে আমার শাশুড়ি)। আমি তার নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হলাম। তিনি আমাকে মানসিক শান্তি দিলেন। আমি এস এস সি দিয়ে শিক্ষিকার চাকরি পেলাম। অপেক্ষা করলাম আরো কয়েক বছর। বয়স বেড়ে গেল। শেষে পরমজিৎ(বিট্টু)কে বিয়ে করলাম। সন্তান ধারণ করতে না পারার জন্য একটি বাচ্চা দত্তক নিয়েছি। তুই দেখেছিস নিশ্চয়ই।
আমি তোকে দেখেই চিনতে পেরেছি। শাশুড়ি মাতা বার বার বলা সত্ত্বেও আমি আর তোর কাছে যাই নি , যদি তুই চিনে ফেলিস।
তোর মনটা সেইরকমই আছে বুঝলাম তাই ডাইরিটি দিতে এসেছিলি। কথাগুলোও সেই আগের মতই সহজ, সরল রয়েছে। তুই শুধু আমাকে বুঝলি না।
সেদিন তুই যা কিছু বলেছিস সব শুনেছি। শুধু তুই কবে বিয়ে করেছিস ,ছেলে মেয়ে কটি বললি না। নিশ্চয়ই তোর বউ খুব শিক্ষিত এবং সুন্দরী ?
যদি সম্ভব হয় জানাবি। ভালো থাক।
ইতি
পঞ্চতপা
বার বার পড়লাম। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
আমি দিল্লি থেকে পঞ্চতপার ঠিকানায় দুটো চিঠি দিয়েছিলাম। সেগুলো আমার কাছে ফেরত যায় কারণ ঐ ঠিকানায় ঐ নামে কেউ নেই জানায়। পরে ফিরে এসে যাই। কোথায় গেছে ? কেউ বলতে পারে নি। আমি কী করবো ভেবে পাই নি। আমিও তার পথ চেয়ে আছি । বলতে পারবো না কোন মতেই। কারন পঞ্চতপা জীবন একটা তরঙ্গে বয়ে চলেছে। সেখানে কোন রকম ছন্দ পতন চাই না। ওর ভালো চেয়েছি এবং চাই। ও সকলকে নিয়ে ভালো থাকুক।
একটা ডাইরি আমাকে স্বপ্ন ও বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।