গাম্ভীর্যের আড়ালে :: সমর আচার্য্য


অফিসের কাজে কলকাতা যাচ্ছিলাম। ঝড়ের গতিতে রেলগাড়িটা ছুটে চলেছে । আমার লোয়ার বার্থের উল্টোদিকের  বার্থে  তনিমা বসে আছে । তনিমা সেন। আমার কলেজ জীবনের বান্ধবী।আমার দিকে একবার আড়চোখে দেখেই না দেখার ভান করে বসে রইল।


আমি ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অনেক  চেষ্টা করলাম । একসময় বলেই ফেললাম, কি ব্যাপার আমাকে চিনতে পারছো না? আমি সমরেশ, তোমার সেই কলেজের বাজে বকাটে ছেলেটা। তুমি তো তনিমা? একবার আমার দিকে একটু গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে বললো, আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে । আমি তো কোন সমরেশকে চিনি না ।


বলেই আবার জানালার দিকে মুখ করে বসে রইল। খোলা জানালা দিয়ে দুরন্ত বাতাস এসে ওর চুলগুলো  উড়িয়ে দিয়ে মুখখানা ঢেকে দিচ্ছিল, ও হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে নিচ্ছিল । একবার ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মনে হলো ওর চোখে জল । নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, ওর সীটে, ওর কাছাকাছি বসে আস্তে করে বললাম, কেন না চেনার ভান করছো তনিমা । আমার কতটুকু দোষ ছিল বলো ।  আমিতো কতবার তোমাকে হ্যাংলার মত প্রপোজ করেছিলাম, কিন্তু তুমি তো তখন অনিমেষের প্রেমে পাগল। আমাকে পাত্তাই দেওনি । আর দেবেই বা কেন? অনিমেষ বড় লোকের ছেলে, বিশাল তার ঠাটবাট । গাড়ি নিয়ে কলেজে আসে যায়। পরে শুনেছি ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিল আবার কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স ও হয়ে গিয়েছে।


তোমার ডিভোর্স এর কথাটা শুনে ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম। আমি তখন জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত। একটা চাকরি পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ঘুরছি। 

পরে অনিতা, মানে আমাদের সেই কলেজ বন্ধু অনিতা বলেছিল, তুমি একটা চাকরি নিয়ে উত্তর বঙ্গে চলে গিয়েছ।



আর গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারল না তনিমা, আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলে বলল, চোখের জল ধরে রাখতে পারব না বলেই গম্ভীর হয়ে অচেনার ভান করছিলাম । তুমি ভালো আছো সমরেশদা ?

পরক্ষণেই বলে ওঠে,জানো সমরেশদা, মানুষ চিনতে বড় ভুল করে ফেলেছিলাম। বাহ্যিক আচার আচরণ আর ঠাটবাট দেখে সত্যিই আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। কাচ কে হিরে ভেবে প্রকৃত হিরে চিনতে ভুল করেছিলাম। তারপরেই আমার দিকে সরে এসে চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে, আচ্ছা সমরেশদা , তুমি এখনো আমায় ভালোবাসো?

উত্তর দিতে পারিনি । শুধু ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে পিছনে ছুটে যাওয়া গাছপালার দিকে উদাস নয়নে চেয়ে রইলাম।


কতক্ষণ পর তনিমার খিলখিল হাসির শব্দে প্রায় সম্বিত ফিরে পেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ও সেই আগের মতোই খিলখিল করে হাসছে। আমার দিকে চেয়ে বলল, তুমি ভয় পেয়ে গেলে, তাই না সমরেশদা? গলার স্বর কেমন আবেগরুদ্ধ। মনে হলো চোখ দুটো ফেঁটে এখুনি অবিরল ধারায় বর্ষণ নামবে। আবার বলল, তুমি ভয় পেয়ো না সমরেশদা। আমাকে তো জানোই। আমি চিরকাল ই এমন। যখন যা মুখে আসে বলে দিই। বলেই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম এবার সত্যি সত্যিই ওর চোখে বর্ষণ নেমেছে।



বুকের ভিতর টনটন করে উঠল। ইচ্ছা হচ্ছিল ওর হাসির আড়ালের কান্নাটুকু থামিয়ে দিই। বুকে টেনে নিয়ে বলি, আমি আছি তনিমা । আমি এখনো তোমারই আছি। দু'চোখে বয়ে যাওয়া জলটুকু মুছে দিই । কিন্তু পারলাম না।

অস্ফুটস্বরে ডাকলাম, তনিমা--। ও দৃষ্টি সরিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে আমার মুখের দিকে চাইল। বলল, হ্যাঁ, বলো, কিছু বলো সমরেশদা ---।

কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু  অপলক দৃষ্টিতে তনিমার দিকে চেয়ে রইলাম । চোখ দুটো বড্ড ভেজা ভেজা মনে হল।

          

Post a Comment

Previous Post Next Post