আজ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিউক্লিয়ার ফিকশন এর সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্হিত কলকাতার নামকরা সায়েন্স কলেজের বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা মিস হিয়া রায়। ওখানে উপস্হিত হয়ে একজনকে দেখে দীর্ঘ কুড়ি বছর পর হিয়া কেঁপে উঠলো। সেই একই নিশ্চুপ চাহনি, মুখ জুড়ে হালকা হাসি। হিয়াকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, "কি রে, চিনতে পারছিস?আমি আর তুই একই বিষয়ে পড়াই। পার্থক্য তুই কলকাতায় আমি এখানে। তা কেমন আছিস? " প্রশ্ন শুনেও হিয়া উওর দিতে পারল না। শুধু তার চোখ আটকে গেল বুকে গোঁজা পার্কার পেন আর ঘাড়ের ইংরেজি "A" অক্ষরের উল্কির উপর। হিয়া মনে মনে ডুবে গেল কুড়ি বছর আগের স্মৃতির পাতায়।।
হিয়ার আজ কলেজের প্রথম দিন। দুরু দুরু বুকে কলেজের গেট দিয়ে প্রবেশ করছে ও। ক্যাম্পাসের চারিদিকে সুন্দর সুন্দর ঝকঝকে ছেলেমেয়েরা প্রজাপ্রতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে। হিয়ার খুব ভয় করছে।তার মত একটি মেয়ে এতবড় ঝাঁ চকচকে কলেজে সত্যিই বেমানান।তার না আছে আধুনিক পোশাক, না আছে বিও, কোনোকিছুতেই সে এই কলেজের কারো সমতুল নয়। হিয়া আস্তে আস্তে শ্রেনিকক্ষে এসে বসে। আজ তাদের প্রথম দিন। সিনিয়র দাদা দিদিরা তাদের স্বাগতম জানানোর জন্য এলাহী আয়োজন করেছে। নতুনদের খুব সুন্দরভাবে স্বাগতম জানালো ওরা। ওখানে সিনিয়রদের মধ্যে দেখতে পেল তাদের গ্রামপ্রধানের মেয়ে সায়নি কে। হঠাৎ হিয়া শুনতে পেল তার নাম ঘোষনা হচ্ছে স্টেজ থেকে,গান করার জন্য। হিয়া ছোটো থেকেই মায়ের কাছে গান করত,তা সায়নি জানত।তাই হঠাৎ করেই তার নাম ঘোষণা করেছে। হিয়া ভয়ে ভয়ে স্টেজে গিয়ে দাঁড়াল,আর অনেক দ্বিধা,ভয় নিয়ে মিষ্টি সুরে গেয়ে ধরল--
"প্রান ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রান।"
কলেজের প্রথম দিনটা খুব ভালো কাটলো। সবাই খুব প্রশংসা করল তার। কয়েকজনের সাথে ভালো বন্ধুত্বও হয়ে গেল। সবাই খুব ভালো।হিয়ার নতুন জায়গা নিয়ে ভয় একদম কেটে গেল।
হিয়া কলেজ থেকে মিনিট পনেরো দূরত্বে একটি মেসে থাকে। ওখানে সবাই সিনিয়র, কিন্তু খুব ভালো। শুধু রনিতা দিদিকেই একটু কেমন যেন লাগে।তার কলেজেই সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।মেয়ে হয়েও কেমন একটা ছেলে ছেলে ভাব। ওর দিকে কেমন ভাবে যেন তাকায়। হিয়ার খুব অশ্বস্তি হয়। কিন্তু কাউকে কিছু বলে না।এভাবেই সব কিছু নিয়ে দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেল। সামনে প্রথম সেমিষ্টার। হিয়ার খুব টেনশন হচ্ছে। ছোটো থেকেই হিয়ার পরীক্ষার আগে টেনশনে জ্বর চলে আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হোল না।সেদিন হিয়ার ঘরের রুমমেট দিদিটিও ছিল না, কদিনে জন্য বাড়ি গিয়েছিল। হিয়া একাই ছিল ঘরে। রাতে ঘুমের মধ্যে তার ভীষন জ্বর আসলো। কিন্তু সে ঘোরের মধ্যেও বুঝতে পারছিল কেউ একটা পরম মমতায় তার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। সকালে উঠে সে বেশ ভালোবোধ করে। কিন্তু বুঝতে পারে না কাল রাতে কে তার সাথে ছিল। সবাইকে জিঞ্জাসা করেও জানতে পারে না।এরপর হিয়া সব ভুলে পরীক্ষায় মন দিল। এভাবে দেখতে দেখতে কলেজের দিন গুলোও শেষ হয়ে আসলো।
দুমাস পরেই তাদের ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু সব ভালো মধ্যেও কিছু তিক্ত জিনিস সবার জীবনে হয়ে থাকে,ওর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হোল না।
হিয়ার কলেজের একটা সিনিয়র ছেলে ও তার দলবল ,তাদের একজনের বাবা আবার পার্টির প্রভাবশালী নেতা, তারা ক্ষমতার জোরে সবাইকে বিরক্ত করে। হিয়াও ওদের নজর থেকে বাঁচলো না। হিয়াকে প্রথম বিরক্ত করে বসন্ত উৎসব এর দিন কলেজে।জোর করে ওকে রং লাগিয়ে দিয়ে যায়। তারপর বিভিন্ন সময় ওকে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করে। কিন্তু প্রতিবারই কিছু না কিছু ভাবে সে বেঁচে গেছে একজন হেলমেট পড়া বাইক আরোহীর জন্য, কখনও বা পুরো টুপি দিয়ে পুরো মুখ ঢাকা ব্যক্তিটির জন্য।
যদিও হিয়া তাকে কোনোদিনই চিনতো না। তাই আমলও দেয়নি বিষয়টা কিন্তু মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়,কে এই মানুষটি, যে সবসময় তাকে আগলে রেখেছে বিপদ থেকে। অথচ সামনেও আসে না।
আসলে হিয়ার জীবনে একটাই উদ্দেশ্য ভালো রেজাল্ট করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তাই কোনোদিকে তাকানোরও অবকাশ নেই তার। সে যতটা সম্ভব নিজেকে পড়ার মধ্যেই ডুবিয়ে রাখে।
কিন্তু আজ তার বন্ধুরা তাকে ছাড়লো না।আজ তার ক্লাসমেট প্রিয়ার জন্মদিন। প্রিয়ার বাবা বড় ব্যবসায়ী। প্রতিবছর খুব বড়ো করে তার মেয়ের জন্মদিন পালন করে, প্রিয়ার সব বন্ধুরা যায়। কিন্ত হিয়া এইসব আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে। কারন সে জানে,এই সব বড়োলোকের অনুষ্ঠানে নিজেকে মাতালে চলবে না। তার ওপর নির্ভর করে আছে অনেকগুলো মুখ। সে স্কলারশিপ পেয়ে এত বড় কলেজে পড়লেও তার বাড়ির কথা সবসময় তার মনে রাখতে হবে। তাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, বাড়ির সবার পাশে লাঠি হয়ে দাঁড়াতে হবে।
কিন্ত এবার কিছুইতে হিয়া তার বন্ধুদের এড়াতে পাড়ল না। তাদের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে,এরপর সবাই যে যার মত আলাদা হয়ে যাবে। এইসব বলে হিয়াকে সবাই জোর করে নিয়ে গেল প্রিয়াদের বাড়িতে।
সন্ধ্যার একটু আগে থেকেই হিয়া রেডি হতে বসল। কিন্তু কি পড়ে যাবে সেটা নিয়ে ভাবছে এমন সময় রনিতা একটা প্যাকেট এনে দিল হিয়ার হাতে। বলল,দেখ আমি জানি তুই আমায় পছন্দ করিস না। কিন্তু আজ একটা বিশেষ দিন,এছাড়া আর খুব অল্প দিনই তুই এখানে আছিস তাই এই ছোট্ট উপহার তোর জন্য। হিয়ার কী হোল কে জানে ও এই প্রথম রনিতা না করতে পারল না। উপহার টা নিল।
প্যাকেট টা খুলে দেখল একটা লাল রঙের জামদানি তার সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ গয়না সব। হিয়া অবাক হয়ে রনিতার দিকে তাকাল, আর মনে মনে ভাবল একদম আমার মনমত পছন্দের সব কিছু, কী করে জানলো এই মেয়েটা?
হিয়া আর কিছু না ভেবে শাড়ীটা পড়ে ফেলল,সাথে ম্যাচিং হালকা গহনা। ছোট্ট টিপ আর ঠোঁটে হালকা রংঙের ছোঁয়া। আর তার লম্বা চুল টা ছেড়ে দিল পিঠের ওপর। এই সাজে হিয়াকে কোনো পরীর থেকে কম মনে হচ্ছিল না। হিয়া রেডি হয়ে বেড়িয়ে গেল প্রিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে , রনিতা বারান্দা থেকে মুগ্ধ নয়নে ওকে দেখে যাচ্ছিল নিশ্চুপ।কিছুক্ষন পর রনিতাও বেরোল।
আজ আবার ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস। চারিদিকে তা নিয়ে হইচই। হিয়ার অবশ্য এইসব দিনে কিছু আসে যায় না।তার কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। প্রিয়ার বাড়িতে ঢুকতেই হিয়া অবাক হয়ে যায়। এত জমক সে এর আগে কখনো দেখেনি। প্রচুর আলো, প্রচুর লোক, সাজগোজ, যেন এক অন্য জগতে এসে পৌঁছেছে। তাদের গ্রামের সব থেকে বড়লোক রমেন জ্যাঠুর ছেলের বিয়েতেও এত জাঁক ছিল না। হিয়া অবাক মুগ্ধতায় সব কিছু দেখছিল।ওর বন্ধুরা ওকে দেখে হইহই করে ওঠে। ওকে এত সুন্দর লাগছিল যে ওরাও মুগ্ধ হয়ে যায়। একজন তো বলেই ফেলল, "আজ হিয়াকে পুরো মোহময়ী লাগছে।" প্রিয়া এসে ওর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। প্রিয়াকেও পুরো রূপকথার গল্পের নায়িকা মনে হচ্ছিল। প্রিয়া ওকে সব বন্ধুদের সাথে খাবার জায়গায় নিয়ে গেল। কত রকমের যে পানীয় সাজানো হিয়া বুঝতেই পারলো না। ও জীবনে দেখেই নি। আর একপাশে দেখল সুন্দর সুন্দর পাত্রে অনেক রকমের নাম না জানা সুস্বাদু খাবার। যে যার খুশি মত নিয়ে খাচ্ছে কোনো বাধা নেই তাদের গ্রামের বিয়ে বাড়িতে বেঞ্চিতে বসে খাবার মত নয়। তার হঠাৎ বাড়িতে ছোট্ট ভাই বোন গুলোর কথা মনে পড়ে মন খারাপ হল। কতদিন তারা কোনো ভালো খাবার খায় না। না না হিয়া ওদের বাদ দিয়ে কিছুতেই এই সব মুখে তলতে পারবে না।
হিয়া ওখান থেকে সরে এসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে লাগল। হঠাৎ কলেজের সেই বাজে ছেলেটাকে দেখল প্রিয়ার বাড়ীতে। জিঞ্জাসা করে জানল প্রিয়ার বাবার বন্ধুর ছেলে। ওকে দেখেই হিয়া গুটিয়ে গিয়েছিল। এক অদ্ভুত ভয় তাকে পেয়ে বসল। এর মাঝেই প্রিয়ার জন্মদিনের কেক কাটা হয়ে গেলে হিয়া ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাকে অনেকটা রাস্তা একা যেতে হবে। তার অন্য বন্ধুরা কেউ এত তাড়াতাড়ি ফিরতে চাইল না। তাই ও একাই বেড়িয়ে পড়ল।
হিয়া রাস্তায় নেমে বাস ধরল। বাস থেকে নেমেও ওকে বেশ খানিকটা রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। ও ঘড়ি দেখল। সাড়ে দশটা বাজে। বাস থেকে নেমে হিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটার চেষ্টা করল। কিন্তু শাড়ী পড়ে থাকার জন্য দ্রুত হাঁটতেও পারছিল না। পুরো রাস্তাটা শুনশান। একটা লোকও নেই।ওর খুব ভয় করে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড়ি এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পরে। হিয়া দেখে কলেজের সেই বাজে ছেলেটা আর তার সাথীগুলো। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গুটিয়ে যায় আর দৌঁড়াতে থাকে। ছেলের দল ওকে ফলো করে। হিয়া দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটি বাইকের সামনে এসে হুমরি খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।
পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙলো ও তখন নিজেকে আবিষ্কার করলো ওর নিজের চিরপরিচিত প্রিয় বিছানায় । ওকে যে কে, কখন নিয়ে আসল বা কীভাবেই যে সে মেসে ফিরলো তা হিয়া যেমন মনে করতে পারছে না, তেমনি তার মেসের কেউই বলতে পারছে না।
তারপর দেখতে দেখতে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল। সবাই যে যার নিজের বাড়ীতে ফিরে গেল। নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে।
হিয়া এখন প্রতিষ্ঠিত। জীবন সংগ্রামে নানা চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে সে আজ একজন অধ্যাপিকা। তার ছোট ভাই বোনদেরকও প্রতিষ্ঠিত করে যার যার সংসার গড়ে দিতে পেরেছে। শুধু হিয়াই আজ তার তৈরী এই বিশাল বাড়িতে নিঃসঙ্গ একাকী জীবন কাটাচ্ছে।
আজ আবার সেই ১৪ই ফেব্রুয়ারি। এই দিনটি আসলে হিয়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তার প্রিয় নামহীন একটি খামের জন্য। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে এটা তার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। কলকাতার কলেজের মেস থেকে চলে আসার পর থেকে প্রতিবছর এই খাম আসে। ঠিকানা বদলেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।তার ছন্দময়হীন জীবনে এই একদিন যেন খশির বার্তা নিয়ে আসে। তখন মনে হয় তার জন্য পৃথিবীর কোনো প্রান্তে নিশ্চিত কেউ আছে অপেক্ষায়। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি? যে প্রতিবছর নিয়ম করে একটি নীল খামে একটি পার্কার পেন আর একটি লাল গোলাপ পাঠায়। হিয়ার সংগ্রহে এই করে কুড়িটি একই পেন, শুকনো লাল গোলাপ ও নামহীন নীল খাম। শুধু খামের উপরে লেখা একটি ইংরেজি অক্ষর "A"। হিয়া অনেক চিন্তা করেও এই পত্র প্রেরককে বুঝতে পারেনি। তাহলে কি চিরকাল তার এই একটুকরো ভালোবাসা ভালোলাগার আকাশ তার কাছে অধরাই থেকে যাবে?
হঠাৎ কারো ডাকে হিয়ার চমক ভাঙে। সে নিজেকে আবিষ্কার করে সেমিনার রুমে রণিতার সামনে।খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, কিন্তু এক অদ্ভুত আনন্দ ও ভালোলাগায় তার মনটা ভরে যায়।