গুরু দক্ষিণা :: অধীর কুমার রায়।


স্কুলে টিফিন বিরতি চলছে।বসে আছি প্রধানশিক্ষকের ঘরে,কোন একটি বিষয় নিয়ে সলা পরামর্শ চলছে বাইরে গাড়ির শব্দ পেলাম। একটু পরে ঘরে প্রবেশ করলো সৌম্যমূর্তি সুদর্শন এক যুবক। চুলগুলি কোকরানো নিষ্পাপ মুখের আদল।প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দরকারি কথার মাঝেই আমার দিকে চোখ ফেরালো,আমাকে দেখেই কথা অসমাপ্ত রেখেই ছুটে আসে আমার কাছে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো,মুখের দিকে তাকিয়ে বললো-"আমাকে চিনতে পারছেন মাস্টারমশাই। আমি তপু, তপন চ্যাটার্জী।" স্মৃতির সরণী বেয়ে খুঁজতে লাগলাম । ফাইভ, সিক্স, সেভেন, প্রতিটি ঘরের প্রতিটি বেঞ্চির কোনায় কোনায় অনুসন্ধান চালালাম। চোখ বুঁজে দেখলাম ক্লাস সেভেনের ঘরের তৃতীয় সরণীর ডান দিকে বসে আছে লাজুক ছেলে ,আমার প্রিয় ছাত্র তপু ওরফে তপন চ্যাটার্জী।

কি মেধাবী ছাত্র ছিল।তখন ওকে বলেছিলাম"তুই বড় হয়ে কি হতে চাস?"তপু দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিল-"আমি আপনার মতো শিক্ষক হতে চাই।"আমি বলেছিলাম "নারে তুই শিক্ষক হবি কেন?তুই অফিসার হবি।মানুষের মতো মানুষ হবি দেশ গড়বি"।ও পায়ে হাত দিয়ে বলেছিল-"আর্শিবাদ করুন স্যার।"

অনেক দিন পর আবার তপন প্রণাম করলো।আজ তপু অনেক বড়ো হয়েছে। আমার জন্যে নিয়ে এসেছে একটা উপহার হাতঘড়ি একথা সেকথার পরে জিগ্যেস করলাম-"এখন কি করিস"? তপু গর্বের সঙ্গে বললো " আমি সরকারি BLRO সরকারী অফিসার।"

গর্বে আমার বুক ভরে গেল। কৌতূহলের সঙ্গে বললাম স্যালারি কত দেয়?

তপু এবারও গর্বের সঙ্গে নির্দ্বিধায় বললো " ভালোই পাই স্যার , "সব মিলিয়ে" ৯৫হাজার।"

ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে অহংকার প্রকাশ পেল।

আমি বললাম "সব মিলিয়ে"ব্যাপারটা কি তপন?

তপন চ্যাটার্জী বললো "উপরি " স্যার।

"উপরি"কথাটা শুনে মাথা ঘুরতে লাগলো।

রাতে ঘুম হলো না।শুধু ভাবতে লাগলাম- "উপরি" কি?

ডিকসনারী খুলে দেখলাম উপরি অর্থাৎ ঘুষ।

--"ঘুষ" ।তপু ঘূষ খায়?

মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়লো।নিজের শিক্ষার প্রতি ধিক্কার দিলাম।নিজেকে বড্ড ছোট মনে হলো।

বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকালাম ।দেখলাম দূরে রাস্তার মোড়ে সেদিনের সেই বটবৃক্ষ আজ কত বড় হয়েছে।কত পশু পাখি তার ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে অথচ তপু?

মাথা উঁচু করে দেখতে হয়।

বারবার ভাবতে লাগলাম তপনের মতো মেধাবী ছাত্ররা যদি এভাবে মলিনতায় ডুবে যায় ,তাহলে আমরা দেশ গড়বো কাদের নিয়ে।

পরদিন সকাল বেলায় তপনের হাত ঘড়িটা ফিরিয়ে দিয়ে এলাম।আর শপথ করলাম তপনের মতো বটবৃক্ষের আমি আর প্রণাম নেব না।

এটাই হোক আমার শিক্ষক জীবনের গুরুদক্ষিণা।

ভাবতে ভাবতে দু চোখে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।

তপনের জন্য করুনা হলো।

তপন মানুষের মতো মানুষ হয়েছে?

হায় তপন চ্যাটার্জী!!!


  

Post a Comment

Previous Post Next Post