পথের দিশারী :: মধুমিতা পাল


মিষ্টি সুরে বেজে উঠল রমেনবাবুর মোবাইলটা।

------হ্যালো দাদা, বলো।

------বলছি তুই শ্রেষ্ঠাকে পুরুলিয়া যাওয়ার পারমিশনটা দিয়ে দে।এই ম্যাচটা খুব ভাইটাল।এই ম্যাচটা থেকেই স্টেট এর সিলেকশনটা হবে।ও এত ভালো খেলে ওকে এইরকম একটা সুযোগ থেকে বঞ্চিত করিস না।

-----অতদূরে ওর মা কিছুতেই ছাড়তে রাজী নয়।

------তুই সেঁজুতিকে বল আমি নিজে ওদের কোচের সাথে কথা বলেছি,ওর কোন অসুবিধা হবে না।

-----আসলে দাদা,ও মেয়েকে একা ছাড়তে কিছুতেই রাজী নয়।একে তো শ্রেষ্ঠার খেলাটা ও পছন্দ করে না তারওপর...... বুঝতেই তো পারছো।

------ঠিক আছে আমিই না হয় দু'দিন ছুটি নিয়ে যাবো।এতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।

-----তুমি যাবে বললে ও না বলবে না।

-----তাহলে শ্রেষ্ঠাকে সব গোছগাছ করতে বলিস।

------তুমি আবার ওকে যেতে দিচ্ছ? ঝাঁঝিয়ে ওঠে সেঁজুতি।

------দাদা যাবে বলছে তো। তাছাড়া স্টেট সিলেকশনের ব্যাপারটাও আছে।

-----তাতে কী হয়েছে? কোথাও যাবে না ও।এতবড় একটা ধিঙ্গি মেয়ে সারাজীবন কি ক্রিকেট খেলে বেড়াবে? বলিহারি যাই তোমাকে আর তোমার দাদার আক্কেলকে।কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। ছোটবেলাতেই বলেছিলাম ভর্তি করো না। শুনলে না। বললে এখন খেলুক বড় হলে আর খেলবে না।তো আর কত বড় হলে ওই মেয়ে খেলা ছাড়বে? বলি মেয়েটার কী কোন ভবিষ্যত নেই?একে তো লম্বা তালগাছ তার ওপর রোদে পুড়ে গায়ের রঙটা কী হয়েছে দেখেছো?এই মেয়েকে কেউ বৌ করে নিয়ে যাবে তো?মেয়ের কি বিয়ে দেবে না?

------আচ্ছা এতো উত্তেজিত হচ্ছ কেন?ও কী একা মেয়ে যে ক্রিকেট খেলছে? ভারতবর্ষের বহু মেয়েই তো ক্রিকেট খেলে।এই ক্রিকেটই ওকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে দেখো।

-----থামতো, কে খেলল না খেলল অতো আমার জানার দরকার নেই। আমার মেয়ে খেলবে না--এই আমি বলে দিলাম। আমি একটা সুখী সংসার চাই ওর।মন দিয়ে পড়াশোনাটা করতে বলো আর একটু শান্ত, ধীর-স্থির হতে বলো তোমার আদরের ছোট মেয়েকে।বলো দিদি কে দেখে যেন শেখে।দুই বোন যেন দুই মেরুর। আমার হয়েছে যত জ্বালা। এবার যাচ্ছে যাক। পরেরবার থেকে আর নয়----এটা বলে দিও তোমার আদরের মেয়েকে।

রাগে গজরাতে গজরাতে চলে গেল সেঁজুতি। বাবা-মায়ের সব কথা আড়াল থেকে শুনছিল শ্রেষ্ঠা।


সরকারি অফিসের ক্লার্ক রমেনবাবু আর সেঁজুতির দুই মেয়ে--বিদিশা আর শ্রেষ্ঠা। দুই মেয়ে আর স্ত্রী কে নিয়েই ওনার ছোট্ট সংসার। অকৃতদার এক দাদা আছেন---বরেনবাবু। চাকরি সূত্রে বাইরেই থাকেন। ছুটিছাটায় বাড়িতে আসেন। খেলাধুলা ভীষণ ভালোবাসেন। 

রমেনবাবু নিজে শান্ত-শিষ্ট ভোলেভালা মানুষ। সংসারের সব দায় দায়িত্ব স্ত্রী অর্থাৎ সেঁজুতির ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজে চাকরি--খবরের কাগজ---আর তাসের আড্ডা----এই নিয়েই থাকেন।


বড় মেয়ে বিদিশা মায়ের খুব বাধ্য।ফর্সা-নিটোল,টানা টানা চোখ।পান পাতার মত মুখের গড়ন।এক কথায় যাকে বলে চোখে পড়ার মতো সুন্দরী। পড়াশোনা-গানবাজনা সবেতেই বেশ দক্ষ।

ছোট মেয়ে শ্রেষ্ঠা একদম তার বিপরীত। লম্বা,শ্যামবর্ণ, পেটানো চেহারা। জৌলুসের লেশ মাত্র নেই। পড়াশোনাতে মোটামুটি গোছের। গানবাজনার ধারপাশ দিয়ে যায় না।ওর সবটুকু ভালোবাসা ক্রিকেটকে ঘিরেই। নিজের ঘরের দেওয়াল ক্রিকেটারদের ছবিতে ভর্তি।

ছোটবেলা থেকেই পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলত ও।ওর ক্রিকেট খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে বরেনবাবু ওকে পাড়ারই একটা ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেন। সেঁজুতি দেবী তখনই প্রবল আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু ভাশুরের কথা ফেলতে না পেরে বাধ্য হয়েই মত দিয়েছিলেন।ভাশুরকে খুব শ্রদ্ধা করেন সেজুঁতি দেবী। শ্বশুর মশাই মারা যাওয়ার পর ভাশুরই নাকি সংসারের সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উনিই রমেনবাবু কে পড়াশোনা শেখান।


বাড়িতে সবসময়ই বড় মেয়ের সাথে ছোট মেয়ের তুলনা করেন সেঁজুতি দেবী। খুব কষ্ট হয় শ্রেষ্ঠার। দিদি খুব গুণী আর ওর কোন গুণ নেই----এটা শুনতে শুনতেই বড় হয়েছে ও।ফলে মা আর দিদির প্রতি একটা রাগও জন্ম নিয়েছে ওর মনে।দিদিকে যে ভালোবাসে না তাই নয়---তবে দিদির সঙ্গে সেই সখ্যতাটা কোনদিনই গড়ে ওঠে নি।

দিদি মাধ্যমিকে স্টার নাম্বার নিয়ে পাশ করলে মা বলেছিল-----

------দিদিকে দ্যাখ কেমন বাড়ির মুখ উজ্জ্বল করেছে। সবাই কত প্রশংসা করেছে ওর। রেজাল্টটা দেখেছিস? সারাদিন ব্যাটবল নিয়ে ঘুরে বেড়ালে সাতজন্মেও এই রকম রেজাল্ট করতে পারবি না। বাড়ির মুখটা যে তুই পুড়াবি তা বেশ বুঝতে পারছি আমি।

খুব কষ্ট হয়েছিল শ্রেষ্ঠার। বলেছিল----

------আমি যেমন দিদির মত রেজাল্ট করতে পারবো না তেমনি দিদি কি পারবে আমার মত ম্যাচ জেতাতে?ওর ভালোবাসার জায়গা পড়াশোনা আর আমার ক্রিকেট----সবসময় তুমি ওর সাথে আমার তুলনা কেন কর?আমার কী কোন গুণই তোমার চোখে পড়ে না?

----না পড়ে না। আমি তো অবাক হয়ে যাই আমার পেটে জন্ম নিয়ে তুই কী করে এত ছন্নছাড়া হলি?তোর কথা ভেবে ভেবে তো আমার রাতের ঘুমই চলে গেছে।

মায়ের কথাগুলো শ্রেষ্ঠা কে ফালাফালা করে দেয়। চোখে জল এসে যাওয়ায় ঝাপসা দেখতে থাকে।বহু কষ্টে চোখো জলটা আটকায় ও।ছোট থেকেই কান্নাটা ওর খুব একটা আসে না।ওর মনে হয় দুর্বল মানুষেরাই চোখের জল ফেলে।যারা প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছে তাদের কান্নাটা ঠিক মানায় না।


একে মায়ের কথাগুলো খুব আঘাত করেছিল ওকে, তার ওপর দিদির বলা কথাগুলো কাঁটার মত বিঁধছিল।দিদি বলেছিল-----

------বড় হচ্ছিস,এবার মায়ের কথাগুলো তো একটু শুনতে পারিস। ছেলেদের মত সবসময় ব্যাটবল নিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াস কেন?কী পাবি ক্রিকেট খেলে?বড় হচ্ছিস,এবার ওসব ছাড়। তার চেয়ে পড়াশোনাটা বরং মন দিয়ে কর। 

অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল সেদিন। কিন্তু কিছুই বলে না।জ্যেঠুমণির শেখানো কথাগুলো মনে পড়ে যায়-----তোকে যে যত অপমান করবে সব সহ্য করে নিবি।ব্যাটে-বলেই দিবি যোগ্য জবাব।

সেদিনই মনে মনে ও প্রতিজ্ঞা করেছিল,- একদিন এর জবাব ও নিশ্চিত দেবে।


বাড়ির মধ্যে একমাত্র জেঠুমণিই ওর আশ্রয়।বাবা ওকে সাপোর্ট করলেও জেঠুমণির মত নয়। সেই জেঠুমণিও থাকে অনেক দূরে।তবে রোজ রাতে ও ফোনে জেঠুমণর সাথে কথা বলে তবেই ঘুমোতে যায়।সব আদর-আবদার-চাওয়া-পাওয়া তো জেঠুমণির কাছে।

ছোটবেলায় জেঠুমণিরও খুব ইচ্ছে ছিল ক্রিকেটার হওয়ার কিন্তু দাদু মারা যাওয়াতে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় জেঠুমণিকে।তাইতো জেঠুমণি ওকে বলেছে, ওর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নপূরণের সব দায়িত্ব জেঠুমণির।তাইতো আজ আগেই জানিয়ে রেখেছিল যে, ও পুরুলিয়া যাবেই।সব ব্যবস্থা যেন জেঠুমণি করে দেয়। ও জানত,জেঠুমণির কথা বাবা বা মা কেউ ফেলতে পারবে না।


এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। ইংরেজিতে মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। ওর ফাইনাল ইয়ার চলছে। দিদির বিয়ের সময় ও অনেকবার বাবা মাকে বলেছিল----

------দিদিকে নিজের পায়ে আগে দাঁড়াতে দাও না,তারপর না হয় ওর বিয়ে দেবে। এতদূর এত ভালো পড়াশোনা করে কী লাভ হল?

উত্তরে মা বলেছিল----

------তুই থাম, দিদিকে নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না।এত ভালো সম্বন্ধ কেউ হাতছাড়া করে? চাকরি বিয়ের পরও করা যায়।

বাবা বলেছিল----

------মা নিশ্চয় সবদিক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দিদিকে দেখে মনে হয়েছিল ও বিয়ের আনন্দে ফুটছে।চুপ করে যায় ও।খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় দিদির। বিয়ের সময় ও যতটা পেরেছে আড়ালে থেকেছে।আত্মীয়-স্বজনদের সামনে পড়লে তো সেই একই প্রশ্ন----এখনও ছেলেদের মত ক্রিকেট খেলছিস? কী পাবি রে?

অথবা মাকে বলে----

------ওকে এবার খেলা বন্ধ করতে বল, নাহলে বিদিশার মত এতো ভালো জামাই পাবে না।

ও বুঝতে পারে না ওকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের এত মাথা ব্যাথা কেন? কই ও তো কারুর নিয়ে মাথা ঘামায় না।জেঠুমণিকে বললে,জেঠুমণি বলেছিল-----

------যারা একটু আলাদা তাদের নিয়েই লোকে সমালোচনা করে। তুই যে আর পাঁচটা মানুষের মত নোস,এটা তার প্রমাণ। তুই তোর লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যা সাফল্য পাবিই।

এরপর আর কোনকিছুই বিচলিত করতে পারে না শ্রেষ্ঠাকে।

* * * * *


খেলার সূত্রেই রেলওয়েতে একটা চাকরি পেয়েছে শ্রেষ্ঠা।দু একবার বিয়ের কথা বললেও ও বিশেষ পাত্তা না দেওয়ায় মা আর বেশি কিছু বলে না।এখন ও জেঠুমণির সাথে কলকাতায় থাকে।ওর লক্ষ্য জাতীয় দলে চান্স পাওয়া।।

হঠাৎ একদিন দিদি ফোন করে ওকে বলে-----

------আমি কয়েকটা দিন তোর কাছে থাকতে চাই।

খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল ও। দিদি ওর কাছে থাকবে? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অনেকদিন দিদিকে দেখেনি।দিদি কলকাতায় থাকলেও দিদির বাড়ি ও ইচ্ছে করেই যায়নি।দু'একবার গিয়ে বুঝেছে, দিদির শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ওকে খুব একটা পছন্দ করেনা।

দিদি এলে দেখে দিদির চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। চোখের তলায় কালি পড়েছে। রাতে বোধহয় ভালো করে ঘুমোয় নি। এই ক'দিনের মধ্যে দিদির চেহারার এত পরিবর্তন? দিদি কি তাহলে ভালো নেই।

দুদিন পর রাতে শোয়ার সময় দিদিকে জিজ্ঞাসা করলে দিদি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে-----

------আমি মানসিক দিক থেকে একটুও ভালো নেই রে বোন।বড়লোক বাড়ির বৌ হলে কী হবে, ওরা উঠতে বসতে হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয় যে আমি ওদের দয়ায় বেঁচে আছি।

জামাইবাবু কিছু বলে না?

------সে তো সবসময় বলে আমি নাকি ওর পয়সাগুলো খলমকুচির মত শাড়ি গয়না কিনে উড়িয়ে দিচ্ছি। একদিন ইস্যু নেওয়ার কথা বলতে কী বলল জানিস?বলল---

-----খরচ তো বাড়বে। তুমি তো কিছু করো না। সামনের বছর আমার প্রমোশনটা হোক তারপর ভাববো।

বড্ড খারাপ লাগে রে।মা-বাবা কষ্ট পাবে বলে কিছু বলিনি। তোর কথাটা শুনে যদি কিছু একটা করার কথা ভাবতাম তাহলে আজ আমাকে এই মানসিক যন্ত্রনা ভোগ করতে হতো না।এখন আমি কী করবো বল না।

-----গান করছিস?

-----সেতো কবেই চুকে বুকে গেছে। মাঝে মধ্যে গাইতাম। একদিন জলখাবার দিতে একটু দেরী হয়ে গেছিল বলে শাশুড়ি বলল-----

------সকাল থেকে গান নিয়ে বসলে জলখাবার কি আর সময়ে পাওয়া যাবে?বৌমা, বিয়ে তো হয়ে গেছে এখন প্রতিদিন গান না গাইলেও চলবে।ব্যস সেই যে বন্ধ করেছি আর গাওয়া হয়নি।মন থেকে গাওয়ার ইচ্ছেটাই হয়নি আর।

------আসলে কী বলতো দিদি, বিয়েটাই জীবনের শেষ কথা নয় রে।হোক না ভালো বর, বড়লোক ঘর তবু নিজের স্বপ্ন, নিজের ভালোবাসা নিজেকেই পূরণ করতে হয়।মেয়ে বলে কী আমাদের কোন স্বপ্ন,কোন ভালোবাসা থাকবে না? তুই চিন্তা করিস না দিদি, আমি তোর সাথে থাকবো। মাস্টার্স করে কেউ বসে থাকে না।টিউশান শুরু কর, সঙ্গে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যা।তোর যা রেজাল্ট তাতে আজ না হোক কাল একটা চাকরি পবিই। আর গানটা আবার শুরু কর। মনে জোর আন দেখবি সব কালো মেঘ সরে গেছে। আমাকেও তো ক্রিকেট খেলা নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি বল,তবু আমি মনের জোর হারাইনি।


যতদিন নিজে ভালো করে রোজগার না করছিস ততদিন তোর সব খরচ আমার। বিদিশা জড়িয়ে ধরে বোনকে।বলে-----

-------তোকে ক্রিকেট খেলা নিয়ে কত কথাই না বলেছি,অথচ আজ দ্যাখ এই ক্রিকেটই তোর আমার পথের দিশারী।



 

Post a Comment

Previous Post Next Post