ডায়েরীর পাতা :: সায়ন্তন গাঙ্গুলী


 

প্রথম দিন আমি এলাম রানীগঞ্জ। অফিসের কাজে। কয়েক বছর আগে এরকমই একটা দিন এসেছিলাম প্রথমবার। আর প্রথমবার এসেই এখানকার একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি। নাম রানী। আমি বলতাম, রানীগঞ্জের রানী।

সন্ধ্যাবেলা ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকেই কিছু খাবার কিনে হোটেলে ঢুকে গিয়েছি। অফিসের ঠিক করে দেওয়া হোটেল। রাত প্রায় ১১টা নাগাদ খাওয়া দাওয়া সেরে শুতে এলাম।


পরেরদিন আমার কোম্পানির এখানকার (রানীগঞ্জ) অফিসে কাজ ছিলো। কাজ শেষ করে রাতে আবার হোটেল। ডায়েরী লেখার মাঝখানে কারেন্ট চলে গেলো। শুনলাম, চার ঘণ্টার আগে কারেন্ট আসার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তবু গরমটা একটু কম লাগছে। তাই অসুবিধে হচ্ছে না।


সেদিন সত্যিই প্রায় চার ঘণ্টার কাছাকাছি, হয়তো চার ঘণ্টার একটু বেশি হবে, কারেন্ট ছিলো না। তাই ডায়েরী বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু অনেক পুরনো কথা, পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিলো।


আমার প্রথম রানীগঞ্জে আসা। সময়টা ছিলো ডিসেম্বর মাস। বেশ ঠাণ্ডা এখানে, বিশেষ করে রাতের দিকে। কলেজের বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছি। একদিন সকালে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ প্রায় দেবদূতের মতো একটা মেয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। জানলাম, তার নাম রানী। তবে নাম রানী হলেও পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়। বাবা দিনমজুর, মা একটা কয়লা খনিতে কাজ করে।

পরে রানীকে আমরা বললাম: "আজকে তুমি আমাদেরকে সাহায্য করলে। কিন্তু রোজ তো আর কেউ এইভাবে আমাদেরকে সাহায্য করতে আসবে না। তার থেকে তুমি আমাদের গাইড হয়ে আমাদেরকে রানীগঞ্জ ঘুরে দেখাও। আমাদেরও ঘোরা হবে, তোমারও কিছু রোজগার হয়ে যাবে।"

রানী উত্তর দিলো: "আমি তোমাদেরকে ঘোড়াতে পারি। কিন্তু তার জন্য আমি কোনও পারিশ্রমিক নিতে পারবো না।"

আমরা রাজি হয়ে গেলাম।

এরকমভাবে আমরা ঘুরলাম, মজা করলাম। মজা করতে করতে আমি আর রানী কখন যে পরস্পরকে ভালোবেসে ফেলেছি, নিজেরাই জানি না। টের পেলাম ফেরার দিন। আমার কোলকাতা ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। রানীকে রানীগঞ্জে রেখে আমি কোলকাতায় থাকতে পারবো না। তবু ফিরতেই হলো কলেজের বন্ধুদের সাথে কোলকাতায়।


বছর দুয়েক পরে আমার একটা সরকারী চাকরীর পরীক্ষার সিট পড়লো আসানসোলের একটা স্কুলে। আমার খুব আনন্দ হচ্ছিলো। আসানসোল থেকে পরীক্ষা দিয়ে রানীগঞ্জে যাবো। আবার আমার রানীগঞ্জের রানীর সাথে দেখা হবে। এবার আর ওকে ছেড়ে আসবো না। একেবারে বিয়ে করে নিয়ে আসবো।


আমি আসানসোল পৌঁছলাম। পরীক্ষা দিলাম। তারপর রানীগঞ্জ পৌঁছলাম। কিন্তু রানীকে পেলাম না। জানতে পারলাম, রানী আর নেই। সে আত্মহত্যা করেছে। মারা যাওয়ার পর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, রানী অন্তঃসত্ত্বা ছিলো।

তার মানে, রানী আমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছিলো? কেন এরকম করলো রানী? আমার সাথে ওর, আর ওর সাথে আমার যোগাযোগের মাধ্যম তো খোলা ছিলো। কেন জানালো না আমাকে?


আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না আজকে। আজ প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেলো রানী নেই। আজকে রানীর মৃত্যু বার্ষিকী। ও জীবিত থাকাকালীন আমি ওর জন্য কিছু করতে পারিনি। কিন্তু আজকে আমি করবো। আজকের পর থেকে পৃথিবীর কেউ আমাকে আর কখনও কোত্থাও দেখতে পাবে না। আর আমার ডায়েরীর পাতা অসমাপ্ত থেকে যাবে। আমি না থাকবো রানীগঞ্জে, না ফিরবো কোলকাতায়।


আমি হোটেলের ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি, তিনি আমার সমস্ত অফিসিয়াল জিনিসপত্র, কাজের রিপোর্ট অফিসে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। আর বাকি জিনিসপত্র আমার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। এবার আমি শান্তিতে ঘুমাবো, যে ঘুম আর কোনও দিন ভাঙবে না।




Post a Comment

Previous Post Next Post