তুমি আছো তাই :: অদ্বিতীয়া সেন


"আজও দেরী করছ তো, একবার এসো, আমি আর কথা বলবো না দেখো" বলে ওঠে সৃজনী। "তাই বুঝি! দেখি আমি সেতার বাজানো শুরু করলে কে রেগে থাকে!" পাশ থেকে সৃজনীর স্বামীর গলা ভেসে আসে। দুজনের খুনসুটি চলতেই থাকে , একজন রাগে তো অন্য জন মানায়, আবার উল্টো এভাবেই সময় কেটে যায়।

"আজ কেমন বুঝছেন ডাক্তারবাবু?" অনীশ জিজ্ঞেস করে, "আর কি বলবো মিস্টার ব্যানার্জী, গত কুড়ি বছর ধরে তো একই রকম জানেনই তো, ওনার জগতে উনি যখন থাকেন দিব্যি সুস্থ মানুষ কিন্তু রিয়েলিটিটা বোঝাতে গেলেই ভায়োলেন্ট হয়ে পড়েন"! "জানেনই তো মেয়েটার উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেছে!" "সবই জানি কিন্তু সত্যি আমার হাতে কিছু নেই! উনি নিজেই চিকিৎসায় সাড়া দেন না! আসলে যে ঘটনার মধ্যে দিয়ে উনি গিয়েছেন তাতে উনি রিয়েল ওয়ার্ল্ডে ফিরতে চান না!" "স্বাভাবিক! জানেন আমি তখন বিদেশে ছিলাম ফিরতে ফিরতে বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছিল!"

খুব সাধারণ পরিবারের সৃজনীর বিয়ে হয়েছিল ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে, সবাই ভেবেছিলো এ বড়োলোকের ছেলের খেয়াল কিন্তু তাদের ভাবনা মেলেনি, খুব সুখে ছিলো সে আর তার স্বামী দীপ । দীপ সৃজনীকে চোখে হারাতো। কিন্তু ওই যে অদৃষ্ট তাতে সুখ না থাকলে যা হয়! ধনি ব্যবসায়ী অজিতেশ মৈত্র তাঁর একমাত্র নাতির নামে সমস্ত সম্পত্তি করে দেবার পরই বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনরা গোলমাল শুরু করেন, বিরোধ চরম আকার নেয় অজিতেশ বাবু মারা যেতে। কুড়ি বছর আগে ব্যবসার কাজের নামে নির্জন জায়গায় ডেকে নিয়ে যায় তারা দীপকে, কিন্তু হিসেব গোলমাল করে দীপ সাথে সৃজনীকে নিয়ে যায়। বিরোধী পক্ষ তখন মরিয়া, দুজনকেই শেষ করে দেবার পরিকল্পনা করে! দীপ নিজে বাঁচতে পারবে না বুঝতে পেরেও সৃজনীকে বাঁচাতে সচেষ্ট হয়, ফলে মারাত্মক ভাবে জখম হয়! সেই অবস্থায় যখন তার উপর আরো অত্যাচার করবার পরিকল্পনা করে শত্রুরা, সৃজনীর অনেক কাকুতি মিনতিতেও তাদের মন গলেনা, ঠিক সেই মুহূর্তে সৃজনী একটা ছুরি হাতে পেয়ে যায় সেটা সে দীপের বুকে আমূল বিঁধিয়ে দেয়। দীপ সাথে সাথে মারা যায়! দীপকে মুক্তি দেবার জন্য সৃজনী এই কাজ করে! শত্রুরা সৃজনীকে মারতে গিয়ে দেখে সে তখন বদ্ধ উন্মাদ! তাই এক পাগলকে না মারাই ঠিক বলে বিবেচনা করে, পাগলের না থাকে সম্পত্তির অধিকার না থাকে তার সাক্ষ্য দেবার মূল্য !তাই আর সময় নষ্ট না করে, সেই স্থান দ্রুত ত্যাগ করে! যদিও তাদের শেষরক্ষা হয়না, খবর পেয়ে দীপের বন্ধু অনীশ দেশে ফিরে আসে, এসে পুলিশী তৎপরতায় ও নিজের চেষ্টায় সবাইকে তাদের প্রাপ্য সাজা দিতে পারে! শুধু সুস্থ হয়না সৃজনী! সৃজনী শুধু বন্ধুপত্নী নয় অনীশের কাছে সে ছোটো বোন। সেদিন ঠিক কি কি ঘটেছিল আর সৃজনী কি করেছিল সেটা খুনীদের থেকেই জানতে পারে পুলিশ অনীশ সবাই কারণ সৃজনী তখন বলার অবস্থায় নেই। চিকিৎসায় কিছুটা ঠিক হলেও দীপের মৃত্যু সৃজনী মেনে নেয়নি তার পৃথিবীতে দীপ বেঁচে আছে। অনীশ গত কুড়ি বছরে অনেক চেষ্টা অনেক চিকিৎসা করেও সৃজনীকে সুস্থ করতে পারেনি। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে অনীশ পায়ে পায়ে অ্যাসাইলামে সৃজনীর ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। অনীশকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসে সৃজনী, " আরে দাভাই তুমি কখন এলে, এই এদিকে এস না দেখো কে এসেছে" মুহূর্তের মনের ভুলে অনীশের মনে হয় একটা ছায়া সৃজনীর পাশে দেখলো সাথে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া, এমনটাই হয় সৃজনীর সেলে এলে, কেনো হয় সেটা অনীশ নিজেও জানে না! চলে যাবার সময় আবার পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে দেখলো সৃজনী হাত নাড়ছে চোখ গেলো পাশের দেয়ালে, সেখানে কিন্তু দুটো হাতের ছায়া, যারা হাত নাড়ছে! তবে কি! দীপ সত্যিই ছেড়ে যায়নি! হয়তো তাই সত্যি। চোখ মুছতে মুছতে অনীশ চলে গেলো , সৃজনী তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেতার শুনতে, সেই সুর অবশ্য শুধু তার জন্য! শিল্পী ও তার একমাত্র শ্রোতা ব্যতীত আর কারুর জন্য সেই সুর নয়।



Post a Comment

Previous Post Next Post