বিকেল থেকেই মনামির মধ্যে একটা সাজো সাজো ভাব।মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে।আয়নার সামনে বার বার গিয়ে একটা করে শাড়ী কাঁধে ফেলছে আর খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে কোন শাড়ীটা পড়ে গেলে অয়নের সঙ্গে তাকে ভালো লাগবে।
মাত্র তিনমাস হল অয়নের সঙ্গে মনামির বিয়ে হয়েছে। সেই অয়নেরই খুব কাছের বন্ধু প্রীতমের আজ বৌভাতের অনুষ্ঠান।
অয়ন অফিসে যাবার সময় বলে গেছে তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে থেকো, আজ আমিও অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসবো।
বরযাত্রীও ছিলো, কিন্তু ঐদিন হঠাৎ শ্বাশুরি মা অসুস্থ হয়ে পরাতে আর বরযাত্রী যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
যাগগে ঐ নিয়ে মনামির কোন দু:খ নেই।
আজ সেই বউভাতেই অয়নের সঙ্গে এটেন করবে তাতেই সে খুব এক্সাইটেড।
তাই বিকেল থেকেই নানা জিনিস শাড়ী গয়না নিয়ে বসেছে।কি ভাবে সাজবে,কি গয়না পরবে।
ইতিমধ্যে শ্বাশুড়িমা এসে একবার দু:খ করে গেলো,বউমা সেদিন আমার জন্য তোমাদের বরযাত্রী যাওয়া হয়নি,আজ কিন্ত সকাল সকাল চলে যেও।
অয়ন সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে অফিস থেকে চলে আসবে বলে গেছে।
তার আগেই মনামি রাতে মায়ের খাবার দাবার রেডি করে রান্নাঘর থেকে ছুটি নিয়ে আসে।
ঠিক সন্ধ্যা ৬টার সময় ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে মনামি।
এখান থেকে প্রীতমদের বাড়ী আধঘণ্টার রাস্তা,পাশের বাড়ী মনার গাড়ী টা তাই অয়ন বলে রেখেছে।
যাইহোক মনামি নিজের মতো করে সাজা শুরু করলো।
বিয়ের পর এই প্রথম অয়নের সঙ্গে কোন বিয়েবাড়ি। খুব আনন্দ হচ্ছে।
কিন্তু পৌনে সাতটা বেজে গেলো অয়নতো এখনো একবারও ফোন করলো না।
কোথায় আছে কখন আসবে কিছুই বুঝতে পারছে না ও।
এই সাতপাঁচ ভেবে মনামি নিজেই অয়নকে ফোন করলো, কিন্ত দু দুবারই রিং হয়ে কেটে গেলো অয়ন ফোন ধরল না।
খুব টেনশন হতে লাগলো
মনামির সাজগোজ কমপ্লিট, এখন
শুধু শাড়ী টা পড়া বাকি।
ঘড়িতে এখন ৮টা।
মনামি এখন কি করবে কিছুই ভেবে পায়না। মনে মনে অয়নের ওপর ভীষণ রাগ হয়।অন্তত একটা ফোনতো করে মানুষ?
সাজ কমপ্লিট করে মনামি একটা হাউসকোট পড়ে খাটে শুয়ে টিভিটা চালিয়ে দেয়।ঠিক সেই সময় অয়ন হঠাৎ ফোন করে অন্য একটা নাম্বার থেকে, জাস্ট দুটি কথা, "মন আমার যেতে দেরী হবে,বাড়ীতে গিয়ে সব বলবো।"
অয়ন মনামিকে আদর করে মন বলেই ডাকে।
কিন্তু অয়নের কি হলো কিছু বুঝতে পারলো না মন।শুধু মনে হলো ও কোন একটা সমস্যার মধ্যে আছে।
কিন্তু অন্য লোকের ফোন থেকে কেনো ফোন করলো। ওর ফোনটা রিং হয়ে যাচ্ছে অথচ তুলছেও না।
রাগে দু:খে দু-চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে এলো মনের।
বৌভাতেও যাওয়া হল না।
আস্তে আস্তে সব সাজ খুলে ফেললো ও।
ইতিমধ্যে মা আবার এসে জিজ্ঞেস করলো কি হোল বৌমা এখনো অয়ন ফিরলো না যে?
ওর দেরী হবে মা, ফোন করেছিলো, কোথায় আছে, কি করছে কিছুই বলল না।
কি করবে রাগে দু:খে লাইট নিভিয়ে মনামি শুয়ে পড়ল।
সত্যি সব পুরুষ মানুষই বোধহয় এমন হয়।কথা দিয়ে মেয়েদের চোখের জল ফেলে।
আবার মনের মধ্যেও বিভিন্ন দুশ্চিন্তা এসে ভিড় করে,কি জানি কোন সমস্যায় পরেছে কিনা,কোন বিপদ হল কি না।
দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা দশটা চল্লিশ পেরিয়ে গেলো।
নানা দুশ্চিন্তার মধ্যেই মনামির চোখটা যেই একটু লেগে এসেছে, অমনি কলিং বেলের আওয়াজ, অয়ন এসেছে,রাগে অভিমানে মনামি ভাবলো আজ অয়নের সঙ্গে একটাও কথা বলবে না।
এত আশা নিয়ে সারাদিন ও ছিল প্রীতমের বউভাতে যাবে বলে আর অয়ন সব আনন্দে জল ঢেলে এত রাতে বাড়ী ফিরছে, কি এমন কাজ ছিলো? আজ সত্যিই অয়নের সঙ্গে কথা বলবে না।
একবুক অভিমান রাগ দু:খ নিয়ে মন অয়নকে দরজা খুলে অয়নের মুখোমুখি দাঁড়ালো।
দরজা খুলে একি দেখছে মনামি?
সারা জামায় রক্ত মাখামাখি, ক্লান্ত বিধ্বস্ত একটা মুখ।
মনামি ভয়ে আঁতকে ওঠে।
এ কি অবস্থা তোমার অয়ন! কি হয়েছে তোমার?
অয়ন মাথা নিচু করে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকেই সোফায় বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
মন আমি পারলাম না গোপাল কে বাঁচাতে, আমি পারলাম নাগো।
মনামি অয়নের পাশে বসে জিজ্ঞাসা করে,কি হয়েছে আমাকে বল,প্লিজ আমি আর থাকতে পারছি না,আমাকে বলো প্লিজ?
তোমার মনে আছে কিছুদিন আগে আমি তোমাকে গল্প করেছিলাম?
আমার অফিসের উলটো দিকের ফুটপাতে একজন ভিখারিনী তার ৮ বছরের একটা ছেলে নিয়ে ফুটপাতেই বসবাস করতো।
ছেলেটা খুব সুন্দর গোলগাল চেহারা,ভীষণ সুন্দর কথা বলতো।
হ্যা, হ্যা মনে পরেছে, তুমি আমাকে একদিন বলেছিলে যে ইচ্ছে করে গোপাল কে আমার বাড়ীতে নিয়ে এসে মানুষ করি,এত ভালো ছেলে ঠিক ভাবে দুবেলা দুমুঠো খেতে পায় না। কি হয়েছে সেই গোপালের?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অয়ন মনকে বলে, জানো মন প্রীতমের বিয়ের দিন মানে রবিবার দিন গোপালের জন্মদিন ছিলো, সোমবার অফিসে গিয়ে দুপুরবেলা চা খেতে গিয়েছিলাম, তখনই আমাকে গোপাল বলেছিলো, কাকু আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে একটা খেলনা গাড়ী দেবে।
আমি ওকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম তুইতো আমাকে জন্মদিনে নিমন্ত্রণই করিসনি তাহলে কি ভাবে দেবো?
ও উত্তর দিয়েছিল তুমিতো আসনাই কি করে খাওয়াবো।
ওকে কথা দিয়েছিলাম, যা কাল আমি অফিসে আসার সময় তোর জন্য একটা সুন্দর গাড়ী নিয়ে আসবো।
সেই মত আজ অফিসে যাবার সময় ফুটপাথ থেকে একটা খুব সুন্দর গাড়ী কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম,যে দুপুরে চা খেতে নামলে ওকে হাতে দিয়ে দেবো জন্মদিনের উপহার হিসাবে।
কিন্তু তা আর হল না।প্রতিদিনের মত আজও আমি টিফিন করে চা খেতে নিচে নেমেছি,হাতে ওর খেলনা গাড়ীটা,দূর থেকে দেখলাম প্রতিদিনের মত ও চায়ের দোকানটার পাশে বসে খেলা করছে।
অফিসের গেট থেকে সবে পা বাড়িয়েছি ওর উদ্দেশ্যে, হঠাৎ বাসটা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ওর গায়ের উপর উঠে গেলো, ও! কি ভয়ংকর সে দৃশ্য!
সব কিছু ভুলে ওকে নিয়ে আমি আর একজন হাসপাতালে ছুটি,কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।রক্তাক্ত অবস্থায় আমি ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে দুবোতল রক্তও নিয়ে এলাম, কিন্তু গোপালকে বাঁচাতে পাড়লাম না।আমার খেলনাটা ওর মাথার কাছে রেখে এসেছি।অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফার মধ্যে শরীরটা এলিয়ে দেয়।দুচোখ বেয়ে অয়নের জল নেমে আসে।
মনামির দুচোখেও জল, অয়নকে শান্তনা দেবার মতো কিছু নেই। অয়নের কাছে একটা বিরাট মানসিক আঘাত।তবু অয়নের মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে।
অয়ন মনকে বলে সরি মন তোমাকে আমি বিয়েবাড়ি নিয়ে যেতে পাড়লাম না।
মনামি আরও নিবির ভাবে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে,আমি যদি তোমার সঙ্গে গয়না শাড়ী পড়ে বিয়ে বাড়ী যেতাম, তাহলে তো তোমার মত একজন মানুষ আমার দেখা হোত না।আজ যে আমি একজন "সত্যি কারের মানুষ" দেখলাম।



