রিপুর অধীন : সায়ন্তনী দাস ধর


আজ সকাল থেকেই বুল্টিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকেল ৪টে পর্যন্ত বাড়ির প্রায় সব জায়গায়,এমনকি আশেপাশে প্রতিবেশীদের বাড়িতেও যখন বু্ল্টির কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না.. তখন বাড়ির প্রধান অভিভাবক.. নিখিলেশ সেনশর্মা পুলিশে খবর দিলেন। পুলিশ আসার পর আবার খোঁজার পর সেনশর্মা বাড়ির ১৫ বছরের অনাথা আশ্রয়ী এবং বাড়ির কাজে সাহায্যকারী বুল্টিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল বাড়ির পিছনে ঘন জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বুল্টি কর্মচারী হলেও বাড়ির সকলের এবং পাড়ার সকলের ভীষণ প্রিয় ছিল তার শান্ত এবং মিষ্টি স্বভাবের জন্য.. তবে কেন বুল্টিকে এই অবস্থায় পাওয়া গেল?? কে এবং কেন করল এমন জঘন্যতম কাজ?? কী রহস্য জুড়ে রয়েছে এই খুনের পিছনে?? প্রশ্নগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ির সদস্যদের মনে। 

                 "কেউ তো এমন ছিল, যে চাইত না বুল্টি বেঁচে থাকুক! আপনাদের বাড়িতে সেই ছোট্টবেলা থেকে ছিল বুল্টি, কিছুই জানেন না আপনি?" দুঁদে পুলিশ অফিসার কমলাকান্ত চৌধুরি রাশভারি স্বরে জিজ্ঞেস করেন সেনশর্মা বাড়ির ছোট ছেলে অখিলেশকে।

"দেখুন, আমি একা মানুষ, সংসারের সাতেপাঁচে থাকি না। গানবাজনা নিয়েই থাকি। আমি তো নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না! আপনাকে কি বলব!" অখিলেশকে বড়ই চিন্তিত দেখায়।

            "বুল্টিকে আমরা কখনও কাজের মেয়ে হিসেবে দেখিনি। ঘরের মেয়ে হয়েই থাকত। হাসিখুশি, চটপটে, মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে ছিল, বাইরের কারোর সাথেও কোন সমস্যা ছিল বলে তো কখনও শুনিনি। কিছুই বুঝতে পারছি না, কি করে এমন হল!" সেনশর্মা বাড়ির মেজো ছেলে অজিতেশকে বিমূঢ় দেখায়।

                      "পনেরো বছরের একটি মেয়ে! কোন প্রেমিক ছিল না? হয়তো প্রেমিকটিই রেগেমেগে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। কি বলেন?" 

কমলাকান্তের কথায় তীব্র প্রতিবাদ করে নিখিলেশের স্ত্রী অঞ্জনা ও অজিতেশের স্ত্রী তানিয়া, "না,না, বুল্টি আর প্রেম! অসম্ভব! বুল্টিকে আপনি তো দেখেননি, ও এমন মেয়েই ছিল না!" দুজনেরই চোখের কোনটা যেন ভিজে ওঠে।

            বুল্টি ছাড়াও এ বাড়িতে কাজকর্ম দেখাশোনা করত মোতি। সারাদিন এ বাড়িতে কাজকর্ম করে রাতে নিজের বাড়িতে ফিরে যেত।

"বাবু, বড় ভাল মেয়ে ছিল বুল্টি। বাড়ির সব কাজে আমাকে সাহায্য করত, দুপুরে নিজের হাতে ভাত বেড়ে দিত আমাকে। 

আমার শরীর খারাপ হলে বলত, 'তোমাকে কিছু করতে হবে না, ও আজকে আমিই সামলে নেব।' মনটা অনেক বড় ছিল ওর। অনাথ মেয়ে, বাপ মায়ের ভালবাসা তো পায়নি, কিন্তু সকলের জন্য ছিল বুকভরা ভালবাসা! এমন মেয়েকে যে এভাবে মেরে ফেলেছে, তার যেন কঠিন শাস্তি হয়, দেখবেন বাবু।" চোখ মুছে বলে মোতি।

          বাড়িতে ফিরে গভীর চিন্তায় ডুবে যান কমলাকান্ত। বুল্টির বিরুদ্ধে কেউই এমন কিছু বলেনি, যাতে এতটুকু সূত্র পাওয়া যায় খুনটা কে করল! দেখা যাক, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কি বলে!

এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকদিন। রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, খাবারে বিষক্রিয়ায় বুল্টির মৃত্যু হয়েছে। 

"এ... এটা কিভাবে সম্ভব! বুল্টিকে কে খাবারে বিষ দেবে? কেনই বা দেবে? ওর তো কোন শত্রু ছিল না!" সেনশর্মা বাড়ির সকলেই একযোগে বলে ওঠে।

"আপনাদের মধ্যেই কেউ নিশ্চয়ই দিয়েছে। বুল্টি তো আপনাদের বাড়িতেই থাকত, খেত। আপনারা কেউই সন্দেহের ঊর্ধে নন।" কমলাকান্ত গর্জন করে ওঠেন।

বাড়ির সকলেই একে অপরের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে, কে এমন জঘন্য কাজটা করতে পারে, অনেক ভেবেও কেউ বুঝতে পারে না! 

          "বাবা, কদিন ধরেই দেখছি, খুব চিন্তায় আছ! কোন জটিল কেস বুঝি?" কমলাকান্তের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তিতাস জিজ্ঞেস করে।

তিতাসের গোয়েন্দা হবার খুব শখ। বন্ধুমহলে ছোটখাটো কিছু রহস্যভেদও সে ইতিমধ্যে করে ফেলেছে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে, এটা কমলাকান্তও অস্বীকার করতে পারেন না। সবটাই তিনি তিতাসকে খুলে বললেন। 

"বুল্টির ব্যাকগ্রাউন্ডটা জেনেছ, বাবা? মানে, ও কোথা থেকে ওদের বাড়িতে এল, ওর পরিবারের কেউ আছে কিনা!"

"ওর সম্পর্কে তো বিশেষ কিছুই জানা যায়নি রে। এটুকুই জেনেছি, খুব ছোটবেলায় বুল্টিকে ওদের বাড়িতে এনেছিল নিখিলেশ। ওর অফিসের দারোয়ানের মেয়ে বুল্টি।" কমলাকান্ত বলেন।

"দারোয়ানের মেয়ে ওদের বাড়িতে কেন?" তিতাস প্রশ্ন করে।

"দারোয়ান মারা যাবার পর তার স্ত্রীও কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। তখন অসহায় বাচ্চাটিকে বাড়িতে নিয়ে আসে নিখিলেশ।" 

"বাবা, আরেকটু খোঁজ নাও বুল্টির অতীত সম্পর্কে। যতটা সহজ শুনতে লাগছে, অতটাও সহজ বোধহয় নয়!" 

        "আমি তখন সবে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছি। বড়দার ছেলে নীল তখন বছর চারেকের। বড়দা নিয়ে এল বছর দুয়েকের বুল্টিকে। বছর খানেক আগে ওদের অফিসের দারোয়ান মারা যাবার পর তার স্ত্রী ওদের অফিসে চাকরি পায়। মেয়েকে নিয়ে চালিয়ে নিচ্ছিল সে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার মৃত্যুর পর বুল্টির দায়িত্ব নেওয়ার কেউ ছিল না। ঐ দারোয়ানের সাথে বড়দার সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। তাই দয়াপরবশ হয়ে বড়দা ছোট্ট বুল্টিকে নিয়ে আসে আমাদের বাড়িতে। তারপর আমাদের সকলের আদর যত্নে নীলের সাথেই বড় হয়ে ওঠে ও। আমার ছেলে লালের জন্মের পর ওরা তিন ভাইবোনের মতই একসাথে বড় হয়। বড়দি তো বুল্টিকে ইস্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছিল। খুব বুদ্ধিমতী ছিল মেয়েটা। মোতির হাতে হাতে ঘরের কাজকর্ম যেমন করত, পড়াশোনাও করত মন দিয়ে। কোন খারাপ গুণ ছিল না। বড়দি তো ওকে নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসত। আমাদেরও খুবই পছন্দের ছিল ও। সংসারের সকলকে ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছিল। 

সবসময় বলত, 'তোমরা না থাকলে আমার যে কি হত!'

কি যে হয়ে গেল, ভাবতেই পারছি না!" তানিয়াকে খুবই দিশেহারা লাগে কমলাকান্তের। 

         "আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, এমন ভাল একটি মেয়ের মৃত্যুর জন্য যে বা যারা দায়ী, তাদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি দিন। ওর মাকে আমি কথা দিয়েছিলাম, ওকে আমি ভাল রাখব। সে কথা আমি রাখতে পারলাম না। ভাল রাখা তো দূর, মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই পারলাম না!" ভীষণই ভেঙে পড়ে নিখিলেশ।

        নীল ও লালের সাথেও আলাদা করে কথা বলেন কমলাকান্ত। একদম ভেঙে পড়েছে ছেলেদুটো। সত্যিই নিজেদের বোনের মতোই ভালবাসত ওরা।

"দিদিকে যারা খুন করেছে, তাদের ধরে ফাঁসি দিও পুলিশকাকু। আমার সাথে কত খেলা করত বুল্টিদিদি, পড়াশোনাও দেখিয়ে দিত! আমাদের বাড়িতে জেঠু অঙ্কে খুব ভাল। কিন্তু জেঠু খুব বকে। তাই বুল্টিদিদির কাছেই আমি অঙ্ক করতাম। বুল্টিদিদিও জেঠুর মতই অঙ্কে তুখোড়, কি সহজ করে অঙ্ক বুঝিয়ে দিত! নীলদাদাও অঙ্কে অত ভাল ছিল না!" গড়গড় করে বলে লাল, "জান পুলিশকাকু, নীলদাদার বেস্ট ফ্রেণ্ড ছিল বুল্টিদিদি। তাই তো রাতে শুয়ে শুয়ে নীলদাদা বুল্টিদিদির জন্য কাঁদে। তখন আমারও খুব কান্না পায় বুল্টিদিদির জন্য।" কমলাকান্ত একটু অবাকই হন।

       "অবাক হবার মতই ঘটনা বটে! বুল্টির জন্য কাঁদছে নীল! ওদের মধ্যে কি কোন সম্পর্ক ছিল? অস্বাভাবিক নয় কিন্তু। বাবা, তুমি নীলের সাথে আবার কথা বল।" তিতাসের কথাটা ফেলনা নয়, ভাবেন কমলাকান্ত। 

            "নীল, বুল্টির সাথে তো তোমার খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল, তাই না? ভালবাসতে ওকে?" কমলাকান্তের প্রশ্নে একটু যেন থতমত খায় নীল।

"কে... কে বলেছে? সেরকম কিছুই নয়।" 

"মিথ্যে বলছ তুমি। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। ভালবাসা তো কোন অন্যায় নয়। স্বীকার করছ না কেন? মিথ্যে বললে তোমারই বিপদ বাড়বে।" 

"না... মানে... হ্যাঁ ... ভালবাসতাম বুল্টিকে। খুব ভাল মেয়ে ছিল ও। 

ও অবশ্য বলত, 'বাড়ির কর্মচারীকে ভালবাসতে নেই।'

কিন্তু ... আমি কিছুতেই ওর থেকে দূরে সরে থাকতে পারতাম না। 

মা একদিন আমাদেরকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিল, বুল্টিকে চড় কষিয়েছিল, আর আমাকে ভীষণ বকেছিল। বলেছিল, বুল্টিকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেবে। আমি সহ্য করতে পারিনি। মায়ের সাথে খুব তর্ক করেছিলাম। প্রশ্ন করেছিলাম,  কর্মচারী বলে ওকে আমার ভালবাসার অধিকার নেই!" দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে নীল। 

স্তব্ধ কমলাকান্ত। 

        "ছবিটা এবার ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, তাই না বাবা?" 

তিতাসের কথায় মাথা নাড়েন কমলাকান্ত, "বাড়ির কর্মচারীর সাথে একমাত্র ছেলের প্রেম- মেনে নিতে না পেরে অঞ্জনাই কি তাহলে খাবারে বিষ মিশিয়ে মারল বুল্টিকে? কিন্তু একেবারে খুন? এটা ঠিক মেনে নেওয়া যাচ্ছে না!"

"আমার যতদূর ধারণা, আরও বড় কোন কারণ আছে। আন্দাজ করতে পারছি, কিন্তু কোন প্রমাণ নেই। বাবা, তুমি এক কাজ কর তো... নীল তো স্বীকার করেছে, সে বুল্টিকে ভালবাসত। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নীল বুল্টিকে খুন করেছে, এই কারণ দেখিয়ে তুমি নীলকে গ্রেফতার কর।"

"কি... কি বলছিস! নীল খুন করেছে বলে আমার একদম মনে হয় না।"

"আমিও জানি, বাবা। কিন্তু আসল অপরাধীকে টেনে বের করে আনতে নীলকে গ্রেফতার করাটা আবশ্যক। আমি নিশ্চিত, অপরাধী নিজেই তার অপরাধ স্বীকার করবে।" তিতাস আত্মবিশ্বাসী। 

তিতাস সম্ভাব্য খুনি ও তার অপরাধের কারণটি বিশদে বাবাকে বুঝিয়ে বলে। কমলাকান্ত তিতাসের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ পেয়ে চমৎকৃত! 

                 তিতাসের কথাই সত্যি প্রমাণিত হয়। কমলাকান্ত নীলকে বুল্টির খুনি বলে সাব্যস্ত করতেই সেনশর্মা বাড়ির সকলেই বিস্ময়ে থ! নীলের হাতে হাতকড়া পরাতেই অঞ্জনা ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। পাগলের মত সে বলতে থাকে, "না না, ওর কোন দোষ নেই। ওকে ছেড়ে দিন। আমিই অপরাধী।" 

ঘরে তখন অপার নিস্তব্ধতা।

"খুনের কারণ কি, সেটা আপনি বলবেন নাকি আমি বলব?" গুরুগম্ভীর স্বরে বলেন কমলাকান্ত। 

মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অঞ্জনা স্খলিত ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে পড়ে।

ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে সে, "বুল্টি আসলে আমার স্বামীর অবৈধ প্রেমের ফসল। আমার স্বামীর চরিত্রের এই দিকটি সম্বন্ধে একেবারেই অবগত ছিলাম না আমি। তাই কোনদিনও সন্দেহ করিনি ওকে। বুল্টির বারো বছর বয়সে আমি জানতে পারি ওর জন্ম রহস্য। সংসার ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম সেদিনই। কিন্তু আমার স্বামী আমার হাতে পায়ে ধরে আমাকে যেতে দেয়নি। বারবার নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চায় আমার কাছে। ও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আমি যে ওকেই একমাত্র ভালবাসি। তাই দুর্বল হয়ে পড়ি। থেকে যাই এ সংসারেই। বুল্টিকেও মেনে নিই। ওর কি দোষ! কিন্তু সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল! সম্প্রতি আমি আমার ছেলের সঙ্গে ওর প্রেমের কথা জানতে পারি। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে আমার! নানাভাবে বুঝিয়েও কিছুতেই নীলকে বুল্টির থেকে দূরে সরাতে পারিনি। আসল সত্যিটাও বলতে পারিনি ওকে! কি বলতাম! ওর বাবা চরিত্রহীন! যাকে ও ভালবাসে, সে ওর বোন! উফ্! আমি আর পারছিলাম না। কোন উপায় না পেয়ে শেষে যাকে আমিই বড় করেছি, সেই মেয়েটাকেই খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেললাম!  এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না যে! আমি অপরাধী ... আমাকে নিয়ে চলুন, ফাঁসি দিন। এই জীবন আমি সহ্য করতে পারছি না!" অঝোরে কাঁদতে থাকে অঞ্জনা। 

সকলেই বিস্ময়ে হতবাক। মাথা নিচু করে একপাশে বসে থাকে নিখিলেশ।

Post a Comment

Previous Post Next Post