পরকীয়া : অদ্বিতীয়া সেন


একমনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরী হচ্ছিলো লাবনী, কাজলটা হাতে তুলেও লাগাতে গিয়ে থেমে গেল, তারপর ভাবলেন আজ তো সবই অন্যরকম তবে এটাও অন্যই হোক না কেন, এই ভেবে কাজলটা আবার তুলে নিয়ে পরিপাটি করে লাগলো। এরপর হালকা মেকআপ করতে গিয়ে তার মনে পড়লো কতদিন এসব ব্যবহার করা হয়নি! স্কুল সংসার মেয়ে তার পড়াশোনা মা বাবা শশুর শাশুড়ী বর সবার খেয়াল রাখতে রাখতে সে হারিয়ে যাচ্ছিল। সাজতে সাজতে লাবনীর পুরনো কথা মনে পড়ছিল,........


রাজের সাথে লাবনীর বিয়েটা হয়েছিল সম্বন্ধ করে। লাবনী তখন সবেমাত্র স্কুলের চাকরীটা পেয়েছে, তখনই বছর পঁচিশের লাবনীর সাথে বছর আঠাশের রাজের বিয়ে হয়ে যায়। রাজ তার বছর তিনেক আগে স্কুলে চাকরী পেয়েছিল। বিয়ের আগে যাতে একটু হলেও চেনা পরিচয় হয় তাই রাজ নিজেই মাস ছয়েক সময় চেয়ে নিয়েছিল বিয়ের আগে। 


আজও মনে পড়ে সেই প্রথম দিনের দেখা হবার কথা, যেদিন সুসজ্জিত ক্যাফে ছেড়ে হঠাৎ করে রাজ বলে উঠেছিল "চলুন না একটু ভিক্টোরিয়াতে বসি" না করতে পারেনি লাবনী, তার হ্যাঁ তে রাজের মুখে ছেলেমানুষী হাসি ফুটে উঠেছিল। একটু একটু করে তার পছন্দ অপছন্দের কথা রাজ জেনে নিয়েছিল তার পরের ছয় মাসে। আর লাবনীও দেখেছিল আপাত দৃষ্টিতে কম কথা বলা "সিরিয়াস" অঙ্কের মাষ্টারমশাইয়ের অন্য রূপ যা শুধু তার জন্যে ছিল। তারপর রাজ তারা দুজনেই একমাত্র সন্তান হবার জন্য, দুইবাড়ি থেকে কাছাকাছি হবে এমন জায়গায় ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করেছিল যাতে দুজনেই দুজনের মা বাবার দেখাশোনা করতে পারে। তখন অনেকে বলতে এসেছিল বউ আসার আগেই ছেলেকে পর করে দিচ্ছে! রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রাজের মা, "ছেলেটার কথাই শুধু ভাবছ তোমরা আর মেয়েটা? তার মা বাবা বুঝি নেই? ওনাদের বুঝি বয়স হবে না? ওনাদের দেখাশোনার দরকার নেই বুঝি?" এরপর আর কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি।


দেখতে দেখতে ছয়মাস কেটে গিয়ে রাজের সাথে লাবনীর বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। নাহ্ প্রথমেই রাজ কাছে আসেনি তার কারণ তখন শুধু যে তারা ভালো বন্ধু ছিল। একসাথে থাকতে থাকতে একটু একটু করে রাজের প্রেমে পরে গিয়েছিল লাবনী। কখন যেনো নিজের অজান্তেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। নিজেকে রাজের কাছে সঁপে দিতে গিয়ে জানতে পারে রাজ তাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসে। এরপর ঝড়ের গতিতে কেটে গিয়েছিল অনেকগুলো দিন মাস বছর। তিন বছর পর লাবনীর কোল আলো করে তার মেয়ে বৃষ্টি আসে। নাহ্ তখনও রাজ তাকে একটুও অবহেলা করেনি, রাতের পর রাত মেয়ের জন্য জেগেছে সে, একা লাবনীর উপর মা হবার সব দায় তুলে দিয়ে নিজে আরামে থাকেনি। রাজের মতে লাবনী মা হলে সেও বাবা তারও সমান দায়িত্ব। ধীরে ধীরে কেটে গেলো অনেক গুলো বছর, আজ সেদিনের ছোট্ট বৃষ্টি সেভেনে পড়ে।


সময়ের সাথে সাথে দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে, তাই আজকাল আর নিজেদের কথা, নিজেদের মতো করে সময় কাটানো হয় না। আজও যদিও রাজ - লাবনী অন্যদের চোখে "perfect couple" কিন্তু ওদের মাঝেও যে আজ অনেক ফাঁক। আজ আর রাজ সে তৈরী হবার সময় অপলকে তাকিয়ে থাকেনা। বাড়ি আসার পরের একসাথে গল্পের সময়টুকু হারিয়ে যায় বৃষ্টির হোমওয়ার্ক করাতে। তারপর হাতে হাতে দুজনে রাতের খাবার তৈরি করে, সেভাবে আর নিজেদের মতো সময় কাটানো হয়না। রাতে মেয়ে কখন উঠে পড়বে সেই ভেবে অনেক গুলো দিন,মাস, বছর কাছে আসা হয়নি। তারপর মেয়ে যখন বড়ো হয়ে গেলো তখন সারাদিনের ক্লান্তি দুইজনকেই চেপে ধরতো। তারপর দুজনেরই মা বাবার বয়স হচ্ছে ওনাদেরও দেখাশোনা করতে হয়। আজকাল আর নিজেদের সময় বলতে কিছু নেই। সেই পুরোনো ভালোবাসার দিন সেই সময় হারিয়ে গিয়েছে। আজকাল কথা বলতে শুধু সাংসারিক কথাবার্তাটুকুই বেঁচে আছে দুজনের মধ্যে। দুইজনের দিক থেকেই অন্যজনের প্রতি থাকে গভীর অভিমান। কেনো অন্যজন তাকে বুঝছে না ।মাঝে মাঝে ছোটো ছোট কথা থেকে কথা কাটাকাটিও হতে থাকে।ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে তৈরি হয় এক ফাঁক, সেই ফাঁক দিয়ে প্রবেশ ঘটে দীপের। 


দীপের সাথে লাবনীর পরিচয় ফেসবুকে। টুকটাক কথা হতে হতে একদিন দীপ হঠাৎ লেখে "আপনার চোখ দুটো খুব সুন্দর" তো কোনদিন লেখে "আপনার ছবিতে হাসিটা বড্ড সুন্দর, কি সুন্দর টোল পড়ে" । এইরকম কথাবার্তা বেশ অনেকদিন চলছিল, দীপ একদিন হঠাৎ বলে "আচ্ছা একদিন দেখা করা যায়না? আমাকে বুঝি এখনও বিশ্বাস হয়না?" নাহ্ এই অনুরোধ লাবনী ফেলতে পারেনি। আগে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হলেও আজ তারা প্রথম দেখা করবে। লাবনী ভিতরে ভিতরে খুব উত্তেজিত আজ। অপেক্ষায় ছিল রাজ ও বৃষ্টির বেরিয়ে যাবার।


আজকাল একটু হালকার দিকের রঙ লাবনী বেছে নেয় নিজের জন্য, কিন্তু কি মনে হতে আজ ময়ূরকণ্ঠি নীল রঙের মুর্শিদাবাদ সিল্কটা তুলে নেয় নিজের জন্য।তারপর সাজতে বসে।


রাজের সাথে দেখা করতে প্রথমদিন যেমন ভিক্টোরিয়ার এসেছিল তেমনই আজ দীপের সাথেও দেখা করতে ভিক্টোরিয়াতে এসেছে। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে লাবনী দেখে দীপ আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য। দীপ তার স্ত্রীর উপহার দেওয়া ঘননীল রঙের শার্ট পরে এসেছে। লাবনীর আর তার দুজনেরই পছন্দের রঙ নীল। দীপ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে লাবনীর দিকে ঠিক যেমন আজ থেকে পনেরো বছর আগের লাবনীর দিকে এগিয়ে এসেছিল সে প্রথম দেখা করবার দিন। হ্যাঁ, লাবনী আর রাজ তাদের পুরনো দাম্পত্যটাকে একটু ঝালিয়ে নিতে নিজেদের মধ্যেই একটু লুকোচুরি খেলেছে, দুজনেই দুজনকে সবটা জানিয়ে। সব কাজ সব দ্বায়িত্বের মাঝে একটু সময় চুরি করতে। তাইতো রাজদীপ থেকে দীপ হওয়া রাজের! 


পড়ন্ত বিকেলের আলোতে লাবনীর কোলে মাথা রেখে রাজ শুয়ে থাকে, লাবনী যদিও একটু আপত্তি করেছিল কিন্তু সেটা ধোপে টেকেনি। তারপর একসময় সন্ধ্যে নামলে সব পাখির নীড়ে ফেরা মতো তারাও ফিরে আসে। আজ বৃষ্টি বাড়ি নেই সে তার ঠাম আর দাদুর কাছে গিয়েছে। বাড়ি ফিরে স্নান সেরে বেরোয় রাজ দেখে তার দিকে অপলকে তাকিয়ে লাবনী ," কি হলো ম্যাডাম? এভাবে তাকাবেন না লজ্জা করে তো আমার নাকি " আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাজের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় লাবনী। একটু পর থামে দুজনেই " কি বলেছিলাম? একটু সময় দরকার আমাদের নিজেদের মত করে। সম্পর্ক একটা গাছ তাকে রোজ জল দিতে হয় নয়তো সে মরে যায়।হ্যাঁ আমাদের মাঝে এখনও তেমন সমস্যা শুরু হয়নি হয়তো কিন্তু সেই অবধি যেতে কেনো দেবো তার আগেই সারিয়ে তুলবো নিজেদের সম্পর্ককে" রাজ বলে ওঠে, লাবনীর চোখ ভিজে যায় অস্ফুটে বলে ওঠে "ভালোবাসি", রাজ তৎক্ষণাৎ নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় তার লাবনীর ঠোঁটে।রাজের অবাধ্য হাত ঘুরে বেড়ায় লাবনীর সারা শরীরে। ধীরে ধীরে একাত্ম হয় দুটো শরীর মন, মিশে যায় দুজন দুজনে। 


ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গার পর লাবনী দেখে তার রাজ তার দীপ তার রাজদীপ তার বুকে মাথা দিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে। রাজের হালকা কোঁকড়া চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে লাবনী ভাবে রাজের প্ল্যানটা ভালোই ছিল। মাঝে মাঝে দীপের সাথে পরকীয়াটা চালিয়ে যাওয়া মন্দ হবে না। মুচকি হেসে রাজকে আরো একটু নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় লাবনী।




Post a Comment

Previous Post Next Post