কার ছায়া : অদ্বিতীয়া সেন


 

ঝিমলি ও রিমলি দুই বোন। তাদের মা বাবা যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়ে দুই মেয়েকে বড়ো করে তুলেছেন। কোনো কিছুর অভাব কোনোদিন বুঝতে দেননি তাদের। তাদের বাবা একজন সফল ব্যবসায়ী ও মা গৃহবধূ। দুই বোনের ভালোবাসা দেখে মা বাবা নিশ্চিন্ত হন যে তাদের পর ব্যাবসা নিয়ে চিন্তা রইলো না দুই বোন মিলে মিশে সেই ব্যাবসা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।ঝিমলি রিমলির থেকে দুই বছরের ছোট হলেও কলেজে উঠে রিমলির বন্ধুদের দলেই যোগ দেয়। রিমলির দলে আগে তিনজন ছিল, সে নিজে অর্ক এবং সায়ন এবার ঝিমলি যোগ দেওয়ায় সেই সংখ্যা চারে গিয়ে দাঁড়ালো। চারজনে কলেজের সময় টুকু বাদ দিয়ে প্রায় সময় একসাথেই থাকে , কলেজে বিষয় আলাদা আলাদা হবার জন্য একসাথে ক্লাসের সময় থাকতে পারে না।যাইহোক এই ভাবে দেখতে দেখতে দিন কেটে গেলো, রিমলি, অর্ক ও সায়নদের কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা এবং ঝিমলির ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো।একদিন ঝিমলি রিমলির বাড়ীতে চার বন্ধু দেখা করে। পরীক্ষা শেষ হতে কিছু সময় আছে সেটা কাজে লাগাতে হবে। কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যাবার প্ল্যান করবার জন্যই তাদের এই "মিটিং " এই নামেই ঝিমলির বাবা তাদের দেখা করা কে সম্বোধন করেন হাসতে হাসতে। যায় হোক মায়ের বানানো কফি পকোড়া খেতে খেতে তাদের গল্প জমে ওঠে। এক একজন এক এক জায়গার কথা বলে কোনোটাই সর্বসম্মতিক্রমে গ্রাহ্য হয় না। শেষে অর্ক সবাইকে থামিয়ে বলে ওঠে "ভাইলোগ আমার আর্জি শোনা হোক এবার। আমার দাদুর একটা বাড়ী আছে বাগান বাড়ী বলতে পারিস উত্তরবঙ্গের  একটা গ্রামে। অনেক দিন ধরে পড়ে আছে একজন মালী দেখা শোনা করে শুধু তাও সে রাতে থাকে না। বলিস তো ওখানে যেতে পারি আমরা সবাই মিলে"।শুনেই রিমলি বলে ওঠে "মানে তোদের ভাঙ্গা বাড়ী দেখতে এতদূর থেকে ঠেঙ্গিয়ে যাবো। মাথা খারাপ নাকি তোর??!!"অর্ক পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে ওঠে " ভাই পুরোটা ত শোন আরে রাতে মালী থাকেনা কেনো থাকেনা জানিস ভূতের ভয়ে! এবার বল"এরপরই বাকি তিনজনের কানফাটানো চিৎকার শোনা যায় "জিও ভাই!, নে একটা পকোড়া বেশী খা"!এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত, অর্ক তার বাড়ীতে বলে ব্যবস্থা সব পাকা করে ফেলে আর বাকি তিনজন তাদের বাড়ী থেকে অনুমতি আদায় করে অবশ্যই ভূতের কথাটা বাদ দিয়ে।

ঝিমলির ডাকে সবার ঘুম ভাঙ্গলো। সবাই ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে হারানের বানানো প্রাতঃরাশ খেয়ে নিল। এরপর অংশু তাদের নিয়ে আশেপাশের চা বাগান দেখাতে নিয়ে গেলো। লাপচুং (জায়গার নামের গল্পের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পূর্ণ কাল্পনিক,কোনো জায়গা এই নামে থাকলে সেটি সম্পূর্ণ কাকতালীয়) জায়গা টা যেকোনো প্রকৃতি প্রেমীর কাছে স্বর্গ। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, দূরে দেখা যায় হিমালয়। এই সবুজ শহরাঞ্চলে যে সবুজ দেখা যায় তেমন না বরং আরো অনেক গাঢ় অনেক সজীব। বোধহয় পরিবেশে দূষণ কম থাকাই এর কারণ। যাই হোক ওরা চারদিকে অনেক জায়গায় ঘুরল তার মধ্যে বেশীর ভাগই নাম না জানা কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, ফটো সেশন চলতেই থাকলো। এইসব করতে করতে বিকেল গড়িয়ে গেল,  যেহেতু ভারী প্রাতঃরাশ করে সবাই বেরিয়েছিল তাই দুপুরে বাড়ি কেউই আর ফিরতে চাইলো না। অংশু কেও ওরা ওদের সাথে বসিয়ে জোর করে খাইয়ে এনেছে অংশু আর হারানের অনেক ওজর আপত্তি উপেক্ষা করে।

বিকেল হয়ে গেছে দেখে অংশুই তাড়া লাগায় ফেরবার জন্য। ফিরে এরপর ওই ভূতবাংলো থেকে বাড়িও তো যেতে হবে নাকি। তাকে তার বাবা পই পই করে বলে দিয়েছে সাঁঝের আগে ওই বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়ি চলে যাবার জন্য। ওই বাড়িতে বাবা বসে থাকবে তার ফেরবার অপেক্ষায় , তাছাড়া দাদাবাবু দিদিমণিরা নতুন তারা জায়গাও চেনে না , তাদেরও তো বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। এইসব ভেবে অংশু সবাইকে তাড়া লাগায়। বাকিরাও বাড়ি ফিরতে রাজি হয়ে যায় আসলে সহজ সরল ছেলেটাকে ওরা কষ্ট দিতে চায়না, থাকুক না নিজের বিশ্বাস নিয়ে কি দরকার ওদের সরল বিশ্বাস ভাঙ্গার। বাড়ি ফিরে অংশু ও হারান সেই দিনের মতো বিদায় নেয়। যাবার আগে বলে যায় কোনো ভাবেই যেনো ওরা কেউ রাতে বাড়ির বাইরে না যায়। ওরা আজ কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে যায় , কাল সকালে সূর্যোদয় দেখবে এই প্ল্যান হয়। 

মাঝরাতে আজও একটা অস্বস্তিতে ঝিমলির ঘুম ভেঙে যায়। জল খেয়ে শুয়ে না পড়ে আজও গল্পের বই নিয়ে বসে। বেশ ঘণ্টা খানেক কেটে গেছে ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সময় প্রায় রাত সাড়ে তিনটা , এক মিষ্টি বাঁশীর সুর ঝিমলি শুনতে পেলো। অদ্ভুত মিষ্টি এক সুর, সাথে যেনো করুন আকুতি মিশে আছে। কেউ যেনো তার প্রিয়ার জন্য বাজাচ্ছে, মনপ্রাণ উজাড় করে তাকে ডাকছে। ঝিমলির কি যে হলো। সে ভুলে গেলো হারানের কথা রাতে যেনো বাড়ির বাইরে না যায়। সন্তর্পনে চাবি খুলে হাতে শুধু টর্চটা নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো ঝিমলি। এখন তার ও অবস্থা বৃন্দাবনের গোপিনিদের মতো, তাঁরাও যেমন শ্রীকৃষ্ণের বাঁশী শুনে স্থির থাকতে পারতেন না তেমনই ঝিমলিও সেই সুর লক্ষ্য করে চললো। ভুলে গেলো পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ভুলে গেলো অজানা জায়গার বিপদ ভূতের কথা নয় অচেনা একটা জায়গায় রাতে কত রকম বিপদ হয় সেসব তুচ্ছ করে ঝিমলি ওই সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে চললো। বাগানের শেষ প্রান্ত ছাড়িয়ে আরো বেশ কিছুটা এগিয়ে একটা বড়ো পাথরের উপর একজন কাউকে বসে থাকতে দেখলো। সে তার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে , হতে তার বাঁশী তাতে একমনে সে সুর তুলে চলেছে কোনো দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঝিমলি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো আর একমনে বাঁশী শুনতে লাগলো। সময় যেনো ওখানেই থেমে গেলো বিশ্ব চরাচরে আর কেউ নেই শুধু একজন শিল্পী ও তার শ্রোতা । এভাবে কতক্ষণ কেটেছে তার কোনো হিসেব নেই, চারদিকের অন্ধকার বেশ হালকা হয়ে এসেছে, ভোর হতে বেশী আর বাকি নেই। এমন সময় শিল্পী তাঁর বাঁশী থামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর চলে যাবার জন্য পিছন ঘুরতেই তাঁর একমাত্র শ্রোতার মুখোমুখি হলেন। ঝিমলি অবাক হয়ে দেখলো সামনের মানুষটির দিকে এতক্ষণ অন্ধকার বেশী থাকায় তার নজরে পড়েনি, সামনের মানুষটি ভারতীয় নন বিদেশী। বয়স আনুমানিক ২৫-২৬ হবে, পরনে সাহেবী পোষাক, টকটকে ফর্সা গাত্রবর্ন, সুঠাম লম্বা চেহারা, একমাথা কালো কোঁকড়া চুল , এমন জায়গায় বিদেশী দেখে ঝিমলি অবাক হয়ে গেলো প্রথমে। প্রাথমিক বিহ্বলতা  কাটিয়ে সামনের মানুষটিকে সম্ভাষণ করতে গেলো সাথে লুকিয়ে তাঁর বাঁশী শোনার জন্য ক্ষমা ও চাইতে গেলো। কিন্তু তার কিছু বলার আগেই তাকে অবাক করে মানুষটি বলে উঠলো "নমস্কার,আমি রায়ান"।

সুস্পষ্ট উচারণে বলা কথা গুলো ঝিমলির কানে যেনো সুধা বর্ষণ করলো। সে কলকাতা শহরে বড়ো হওয়া আধুনিকা হঠাৎ করে নিজের আচরণে নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেলো, একেই কি পূর্বরাগ বলে! জানা নেই শোনা নেই প্রায়ান্ধকার জায়গায় শুধুমাত্র বাঁশীর সুর শুনে কি সে প্রেমে পড়লো নাকি?!!! কিন্তু এই সুর এত চেনা কেনো লাগে, যেনো যুগ যুগ ধরে এই সুর সে শুনে আসছে!! "ধুর আগে উত্তর তো দি নয়তো কি যে ভাবছেন উনি" - এই ভেবে ঝিমলি বলল "নমস্কার, আমি ঝিম sorry অ...." "ঝিম বলে থামলেন কেনো?" "আসলে ওটা আমার নিকনেম" "তো সেটাই চলুক না" "নমস্কার আমি ঝিমলি" ঝিমলি এবার গড়গড় করে বলে গেলো, উত্তরে একটা মিষ্টি হাসি এলো। ঝিমলি আবার বলতে শুরু করলো "sorry আমি আপনার permission না নিয়েই..." " It's ok... কেউ শুনলে আমার ভালোই লাগে, তাছাড়া আপনার মতো মনোযোগী শ্রোতা হলে তো কথাই নেই"। এই সামান্য কথায়ও ঝিমলি যেনো লজ্জা পেয়ে গেলো, সেটা ঢাকা দিতে তাড়াতাড়ি অন্য কথায় চলে গেলো, "আচ্ছা আপনি... আপনি এত ভালো বাঙলা কি করে বলছেন" "আমি তো বাঙালিই, হ্যাঁ জাতিগত ভাবে ব্রিটিশ জিন আছে কিন্তু আমার জন্ম বাঙলাতেই আর আমার মা জন্ম এবং জাতিগত দুভাবেই বাঙালী তাই বাঙলা আমার মাতৃভাষা, মায়ের ভাষা জানবো না?!!" "আপনি এখানে কি বেড়াতে এসেছেন না কি কোনো কাজে" "নাহ্ বেড়াতে নয় কাজেই এসেছি, আর আপনি" এভাবেই টুকিটাকি কথা বলতে বলতে কখন যে তারা বাগানের মধ্যে দিয়ে বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে ঝিমলি খেয়ালই করেনি। রায়ান হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো যখন তখনও ভোর হয়নি, যদিও কথা ছিল সবাই মিলে সূর্যোদয় দেখতে যাবে তবুও আনমনে ঝিমলি কাউকে না ডেকে ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো এবং অকাতরে ঘুমিয়ে পড়লো। ঝিমলির ঘুম যখন ভাঙলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে খাবার জায়গায় এসে দেখলো বাকি তিনজন বসে খাচ্ছে। "কি রে দিদিয়া তুইও আমাকে ছাড়া শুরু করে দিলি" "আরে তুই উঠলি! তোকে ডাকতে ডাকতে তো আমাদের পেটে ইঁদুর ছুঁচো সবাই দৌড়াচ্ছিল তাই খাচ্ছি, তবে চিন্তা করিস না তোর সাথে আবার খাবো নয়তো তোর তো মনে কষ্ট হবে। এমনি যদিও আমার খাবার আর ইচ্ছা নেই তবে তোর মনে তো আর কষ্ট দিতে পারিনা, তাই আর কি" সায়ন কথা গুলো বলে ওঠে। "থাক থাক আমার কষ্ট হবে না তুই আর খাস না" ঝিমলি উত্তরে বলে ওঠে। এভাবেই হাসি মজার মধ্যে দিয়ে ওদের খাওয়ার পর্ব শেষ হলো। আজ সবাই ঘুরতে গেলেও ঝিমলি যায় না শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে, কি যেনো এক ক্লান্তি তার সারা শরীর জুড়ে। রাত জাগার ফল সে মনে মনে ভাবে। যদিও দিদিয়া তার সাথে থাকবে বলছিলো কিন্তু সে এক প্রকার ঠেলেই রিমলিকে ঘুরতে পাঠালো, সব কথা ভাগ করে নেবার তার সাথী দিদিকেও আজ সে গতকাল রাতের কথা বলতে পারেনা। কি যেনো এক অজানা অনুভূতি তাকে আটকে দেয়।

দেখতে দেখতে আরো চারদিন কেটে যায়, রোজ রাতেই ঝিমলির সাথে রায়ানের দেখা হয়েছে, সকালে রোজই ঝিমলির উঠতে দেরী হয়েছে, এর মধ্যে একদিনই সামনে একটু ঘুরতে গেছিলো সবার সাথে নয়তো তাকে বাড়ি থেকে  বারই করা যায়নি। আসলে রায়ানের সাথে দেখা হওয়া তার বাঁশীর সুর তার কথা বলা সবটাই ঝিমলি কে এতটাই ঘিরে রেখেছে যে ওই সময় টুকুর স্মৃতি রোমন্থন করেই সারাদিন তার কেটে যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখা, যে টুকু সময় ঝিমলি ঘুমোয় সে স্বপ্ন দেখে যাই আবছা আবছা। এই ভাবেই একরকম ঘোরের মধ্যে মাঝের চারটে দিন কেটে গেছে। আজ তাদের সবারই মন খারাপ, আজ সায়নকে বাড়ি চলে যেতে হলো ওর ঠামি হটাৎ করে অসুস্থ হয়েছেন বলে। সায়ন না থাকলে ওদের সবারই মন খারাপ থাকে , জায়গা টা সায়নই জমিয়ে রাখে। যাইহোক কিছু করবার নেই । আজ সকালে ওরা কেউই বেরোয়নি , টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল বলে , তাড়াতাড়ি খেয়ে আজ শুয়েও পড়েছে সবাই। ঝিমলি ঘুমিয়েই পড়েছিল হঠাৎ রিমলির ডাকে ঘুম ভাঙলো।

রিমলির ডাকে ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠে ঝিমলি, তার এখনও ঘুমের রেশ কাটেনি, "এই আয় একটা জিনিস দেখবি আয়" বলে রিমলি তাকে ডেকে নিয়ে ছাদের দিকে চলে। "এই এই দিদিয়া হারান কাকা ছাদে রাতে যেতে না করেছিল, ভুলে গেছিস নাকি একটা দিকের রেলিং ভাঙা" "উফ তুই চল তো, তোকে একটা সারপ্রাইজ দেবো চল শিগগির" এই বলে রিমলি ঝিমলিকে এক প্রকার টেনে ছাদে নিয়ে যায়। 

ছাদে গিয়ে ঝিমলি ডেকে সেখানে অর্ক আগে থেকেই আছে। "আয় আয় ঝিমলি আয়" "তোরা কি দেখবি ভূত নাকি, শোন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে যা বলার জলদি বল" "আরে এতো জলদির কি আছে আজই তো যা শোনবার শুনবি আর আমরা কেউ তোকে বিরক্ত করবো না" অর্ক বলে ওঠে। "বাবাহ এ তো ভূতের মুখে রাম নাম , কি বলবি বল" হাই তুলতে তুলতে ঝিমলি বলে ওঠে। "আমরা বিয়ে করছি মানে আমি আর অর্ক" রিমলি বলে ওঠে,ঝিমলি প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায় পরক্ষনেই খুব খুশি হয়। "আসলে তোকে আগে জানিয়ে দিলাম কারন তুই তো তখন থাকবি না" "মানে! কি সব বলছিস আমি থাকবোনা তো কোথায় যাবো, হবু জিজু?" ঝিমলি পাল্টা অর্ককে বলে ওঠে । " তুই থাকবি না মানে তুই বেঁচে থাকবি না । তাই জন্যই তো তোকে এখানে নিয়ে আসা এই ট্রিপটা প্ল্যান করা, অবশ্য সায়নকে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে হতো , সে নিজেই  বিদায় হয়ে সে খরচ টাও বাঁচিয়ে দিয়েছে!" " কি সব আবোল তাবোল বলে যাচ্ছিস এই দিদিয়া দেখ না!" "একদম ঠিকই বলেছে তোর জিজু তুই আর ফিরবি না এখান থেকে, এখানেই আজই মরবি তুই"   "দিদিয়া কি বলছিস আমি তোর বোন তুই এভাবে কেনো এসবের মানে কি কি দোষ আমার" " বোন হলে তো মেনেই নিতাম কিন্তু বোন নোস জোর করে বোন হচ্ছিস তাই আর মানতে পারছি না। শোন শেষবার সবটা শুনেনে তুই আমার বোন নোস তুই আমার মা বাবার দত্তক সন্তান" বলে ওঠে রিমলি। ঝিমলির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় যেনো,  কোনক্রমে সে বলে ওঠে "কি বলছিস কি" "শোন, যা বলছি একদম ঠিক বলছি। তুই দত্তক সন্তান কার না কার পাপ তার ঠিক নেই, সে আমার সমান সম্পত্তি পাবে আর আমি সেটা বসে বসে দেখবো?" গর্জে ওঠে রিমলি "এই দিদিয়া শোন না আমাকে মারিস না আমার কিচ্ছু চাই না। সব তোরা নে আমার কিচ্ছু চাই না শুধু প্রাণে মারিস না বলে ঝিমলি কাকুতি মিনতি করে ওঠে কিন্তু বরফ গলে না। অর্ক বলে ওঠে "তোকে ছেড়ে দি আর তুই আমাদের কথা সবাইকে বলে দিস পাগল ভাবিস নাকি! ওসব হচ্ছে না মরতে তোকে আজ হবেই বলে টেনে হিঁচড়ে ভাঙা রেলিংয়ের দিকে নিয়ে যেতে চায়। হঠাৎ করে বাতাসের একটা ঠান্ডা ঝলক বয়ে যায় আর অর্ক কারুর ঠাটিয়ে থাপ্পড়ে ছিটকে পড়ে যায়। ঝিমলি অবাক হয়ে দেখে রায়ান দাঁড়িয়ে আছে, গভীর কালো চোখ দুটো অন্ধকারে যেনো জ্বলছে। "এই তুমি এখানে কি করে এলে কতো টাকা চাই বলোতো? এই মেয়েটা আজ মরবে যাই করো বাঁচাতে পারবে না। এমনিও ওর মতো নোংরা রক্তের কেউ মরলে কিছু যায় আসে না " অর্ক ওদিকে গালে হাত দিয়ে বসেই আছে সেদিকে তাকিয়ে কিছুটা ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠলো রিমলি। উত্তরে খোলা গলায় হেসে উঠলো রায়ান, ঝিমলি এখন এই ভাবে রায়ানকে দেখে অবাক হবার সাথে সাথে ভয় ও পাচ্ছে ওরা যদি তার রায়ানেরও ক্ষতি করে সেই ভয়। এই হাসির শব্দে দূরে অনেক গুলো কুকুর কেঁদে উঠলো এক ঝাঁক রাতচরা পাখি উড়ে গেলো। অর্কর আর রিমলির একটু যেনো অদ্ভুত লাগলো শুধু ঝিমলি মনে অনেকটা ভরসা পেলো। রিমলি  আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রায়ান বজ্রমুষ্ঠিতে তার গলা টিপে ধরে মাটি থেকে কিছুটা উপরে শূন্যে তুলে ধরলো, এই দৃশ্য দেখে অর্ক আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। ঝিমলি ছুটে এসে ছাড়াতে গেলো, কিন্তু তার আগেই রায়ান রিমলিকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ঝিমলি এই দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলো তাই দেখে তাড়াতাড়ি রায়ান পরম মমতায় তাকে ধরে ফেলে। তারপর ঝিমলিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নীচে নিয়ে যায় শুধু একবার  তারমধ্যে অর্কর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে যায়। অর্কর চোখে বোবা দৃষ্টি তখন। নীচে এসে রায়ান ঝিমলিকে বিছানায় শুইয়ে দেয় তারপর তার পাশেই বসে থাকে সূর্যের আলো ফোটা অবদি। 

এর কিছুক্ষণ পরই হারান ও অংশু আসে, তারা রিমলিকে মৃত ও অর্ক কে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় পায়। ঝিমলি তখন ও অচৈতন্য , হারান এসে দেখে তার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সকলের বাড়িতে খবর যায়, বাড়ি থেকে সবাই আসার আগেই অবশ্য পুলিশ আসে, এসে নিজেদের নিয়ম মাফিক কাজকর্ম শুরু করে দেয়।  রিমলির মা বাবা এক সন্তানকে হারিয়ে অন্য জনকে আঁকড়ে ধরেন। ঝিমলি বেশ কিছুদিন জ্বরে ভোগে আর জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখতে থাকে এভাবেই এক বছর কেটে যায়। 

এক বছর পর -: এই এক বছরে রিমলির শোকে তাদের মা বাবা এখনও কাতর। ঝিমলি ওনাদের বলেনি সেদিন ঠিক কি হয়েছিল, কি দরকার আরো কষ্ট দিয়ে যে যাবার সেতো আর ফিরবে না সে সব শাস্তির উর্ধ্বে চলে গেছে। অর্কর অবস্থার উন্নতি হয়নি অনেক চিকিৎসার পরও সে এখনও অপ্রকৃতিস্থ। বর্তমানে অর্কর ঠাঁই তাদের বাড়ির একটি ঘর সেখানেই সে থাকে ঘর থেকে বেরিয়ে না, নিজের মনে কথা বলে যায়।

এই এক বছরে ঝিমলির প্রায়ই জ্বর এসেছে আর একটা রাত ও যায়নি যেদিন সে স্বপ্ন দেখেনি। প্রতিদিন একই স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে, দুজন রায়ান একজন অন্যজনকে ছুরি মারছে। এরপরই সব অন্ধকার আর রায়ানের গলা, যদি আমাকে বিশ্বাস হয় একবার সবটুকু বলার সুযোগ দাও, একটিবার ফিরে এসো।

ঝিমলি ঠিক করে নিয়েছে এর একটা বিহিত সে করবে, সবটুকু সে জন্যেই, তাই আজ সে চলেছে সেই অভিশপ্ত বাড়ির উদ্দেশ্যে, বাড়িতে জানে সে মুম্বাই বেড়াতে যাচ্ছে কারণ ওই জায়গায় যাচ্ছে জানলে তাকে কেউ যেতে দিতো না।

আজ আর অর্কদের বাড়ি থেকে নয় ঝিমলি নিজে হারানকে ফোন করে জানিয়েছে তার আসার কথা ও সে গোপন রাখতে বলেছে। 

আগেরবারের মতো হারান ও অংশু সে আসতে ছুটে আসে শুধু আগেরবারের মতো খুশিটা নেই তাদের মধ্যে, যেনো ঝিমলি স্বেচ্ছায় মরতে এসেছে এমন দৃষ্টি তাদের দুজনেরই চোখে। বিকেল হবার সময় বার বার বাবা ছেলে ঝিমলি কে ফিরে যেতে নয়তো তাদের সাথে তাদের বাড়ি যেতে অনুরোধ করে। ঝিমলি তাদের অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে । ক্রমে রাত বাড়ে, আজ আর বাঁশীর সুর নয় রায়ান নিজেই উপস্থিত হয় ঝিমলির সামনে, ঝিমলি আগেই বুঝে গিয়েছিল রায়ান কোনো মানুষ নয় তাই সে আজ ভয় পায়নি হটাৎ করে রায়ানকে দেখে। শুধু তাই না তার নিজের মনে কেমন একটা বিশ্বাস আছে রায়ান তার কোনো ক্ষতি করবে না। রায়ান কিছুক্ষণ তার দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করে, "কেমন আছো জানতে চাইবো না , আমি জানি তুমি কেমন আছো। আমার উপর হয়তো রাগ হয়তো বা ঘৃনাও আছে কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি যে করবে তার এই একই পরিণাম হবে সে তুমি আমাকে যতই ঘৃনা করো না কেনো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আজ দেবো উত্তর না দিয়ে আমি নিজেও শান্তি পাচ্ছিনা যে"

রায়ানের কথা - আমরা যমজ ভাই ছিলাম আমি আর মার্ক। মার্ক ছোটো থেকেই বদসঙ্গে পরে।অনেক বার জেলেও যেতে হয় শেষে ড্যাডি ওকে সব সম্পত্তি থেকে disowned করেন। অনেকদিন মার্কের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়না। আমি তখন এখানে , একদিন রাতে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, হটাৎ করে মার্ক আসে। আমি ওকে দেখে খুশিই হই, ওকে খাবার বানিয়ে দিই। হটাৎ করেই বৃষ্টির মধ্যে মার্ক বলে বাগানে একটা দরকারি জিনিস রয়ে গেছে সেটা তক্ষুনি আনতে যেতে হবে। বলে আমি আর মার্ক বাগানে যায়। হঠাৎ করে আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে মার্ক আমার পিছন থেকে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয় তার পর বলতে থাকে এরপর আমার পরিচয়ই ওর হবে আমি নেই কেউ জানবে না তার সাথে আরো কয়েকবার কোপ মারে।শেষে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ে যাই তখন বাগানের এক প্রান্তেই আমাকে পুঁতে দেয়, আমার নিজের ভাই এটুকু দেখে না আমি তখনও বেঁচে আছি। এরপর জঙ্গলে যায়, সেখানে নিজের রক্তমাখা পোশাক ছুরি সব পুঁতে দিয়ে আসে আর নিজের ডান হাতের বুড়ো আংগুল নিজেই কেটে ফেলে যাতে করে সই না মিললেও কেউ সন্দেহ না করে। এরপর বাকিটা তো জানো, কেউ জানে না রায়ান আর নেই, সবাই মার্ককেই  আমি ভাবতে থাকে, বিশ্বাস করো যে অত্যাচার করতো, যে আমার লিসার মৃত্যুর কারণ সে আমি না সে মার্ক। লিসা বুঝতে পেরেছিল তাই নিজের উপর ঘেন্নায় নিজেকে শেষ করে দেয়, মার্কের মুখোশ খোলার চেষ্টা না করে। আর আমি, আমি অপেক্ষা করতে থাকি কবে আমার লিসা আবার ফিরবে। শেষ অবদি লিসা ফেরে কিন্তু তার ক্ষতি কেউ করতে চায় তাই আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।

এই অবদি বলে রায়ান থামে ও অবাক হয় একজোড়া নরম হাত তাকে বাহুবন্ধনে বেঁধে ফেলেছে দেখে। লিসা ওরফে ঝিমলি তখন অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে, অন্য কেউ না জানুক সে জানে রায়ানের লিসা সে ছাড়া অন্য কেউ নয়। 

দশবছর পর: আজ আটবছর হলো ঝিমলি তার বাবার ব্যবসায় যোগ দিয়েছে কলেজ পাশ করেই। আর এই আট বছরে সে প্রথম কাজ করেছে অর্কদের বাগানবাড়িটা কিনে নেওয়া। লেপচুঙ্গে চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য একটা ছোট হসপিটাল ও ওখানকার বাচ্চাদের জন্য স্কুল তৈরি করেছে ঝিমলি রায়ানের দেখা স্বপ্নের মতো।আজও প্রতি শুক্রবার সে ছুটে আসে এখানে রায়ানের জন্য যদিও সবাই জানে স্কুল আর হসপিটালের দেখাশোনার জন্য কিন্তু আসল সত্যি টা শুধু ঝিমলি জানে। আজও প্রতিবার এখানে এলে রায়ান আসে, যদিও মুখে বলে বিয়ে করে নিতে নিজের জীবনে এগিয়ে যেতে তবুও কোনো বার কোনো কারনে কোনো সপ্তাহে না যেতে পারলে, পরের সপ্তাহে গেলে ঝিমলির জন্য একজোড়া অভিমানী গভীর কালো চোখ অপেক্ষা করে, তখন অনেক কষ্টে সাহেবের মানভঞ্জন করতে হয়। অনেক কষ্টে মান ভাঙ্গে কাজেই ওই বিয়ে করে নিতে বলার কথা যে কথার কথা সে ঝিমলি ঢের জানে।

এই অবদি লিখে লেখা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন অদ্বিতীয়া ওরফে ঝিমলি ওনার ফ্লাইটের দেরী হয়ে যাচ্ছে, আর  ফ্লাইট মিস হয়ে দেরী হলেই একজনের রাগ ভাঙ্গাতে হবে ভেবে মুচকি হেসে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেলেন। ওনার গন্তব্য "রায়ান সাহেবের স্কুলের" উদ্দেশ্যে, হ্যাঁ, এই নামেই রায়ানের স্বপ্নের স্কুল আজ পরিচিত। রায়ান স্বপ্নেও ভাবেনি তার নিজের নামে স্কুল পরিচিত হবে, ভেবেছিল লিসা ওরফে ঝিমলি বা অদ্বিতীয়া সে যে তার রায়ানের ছায়া।

আমাদের চোখের সামনে এরম অনেক গল্প থাকে যারা অসাধারণ হয় নিজের নিজের মতো করে। কিছু কিছু ভালোবাসা এরম হয় যা একজন্মে শেষ হয়না। আশাকরি রায়ান আবার সশরীরে তার ঝিমলির কাছে ফিরে আসুক , অন্য নামে কিন্তু ফিরুক আবার।তারা একহোক এই আশা রাখি ঈশ্বরের কাছে।

 ~~~~~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~~~~~~~

Post a Comment

Previous Post Next Post