নার্গিস : অনামিকা রায়



"ধ্যাত!" বলে কাগজটা দলা পাকিয়ে পাশের ওয়েস্টপেপার বক্সে ফেলে দিল দেবস্মিতা। গত দুদিন ধরে ক্রমাগত একটা ড্রেস ডিজাইন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছে না। ইতিমধ্যে পাঁচবার reject হয়ে গেছে তার ডিজাইন। আজ সকাল থেকে উঠেপড়ে লেগেছে সে, আজ তো প্রজ্ঞা ম্যাডামকে দিয়ে ডিজাইন approve করিয়েই ছাড়বে দেবস্মিতা। অথচ সকাল থেকে এখনো অবধি একটা ডিজাইনও তার নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না, প্রজ্ঞা ম্যাডামের পছন্দ হওয়া তো কল্পনাতীত! উফ্, এর মধ্যে মাথাটাও যন্ত্রণা করছে, অবশ্য মাথার আর কি দোষ, সকাল থেকে দুটো বিস্কিট ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি, এখন তারই ফলস্বরূপ এই মাথা যন্ত্রণা! অত সকালে পিজিতে ব্রেকফাস্ট দেয় না আর ব্রেকফাস্টের জন্য অপেক্ষা করার মত সময় দেবস্মিতার ছিল না, সময় এখনও তো তার নেই যে গিয়ে কিছু খেয়ে আসবে।

            হঠাৎ ঠক করে একটা আওয়াজ হতে মুখ তুলে দেখে ঋষি একটা কফির কাপ ডেস্কের ওপর রেখে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। 

"কি ব্যাপার তোর? সেই যে বসেছিস আর তো ওঠার নাম নেই! ফেভিকল্ চিপকে গেছে নাকি?" বলে একটা ছেলেমানুষী হাসিতে সারা মুখ ভরিয়ে ফেললো ঋষি।

ঋষি ছেলেটাকে দেবস্মিতার ভালো লাগে, ঋষিও যে তাকে পছন্দ করে সেটা সে বেশ বুঝতে পারে, যদিও অফিসিয়ালি কেউই প্রপোজ করেনি এখনও। তাই এই ছোট ছোট যত্নগুলো দেবস্মিতার বেশ ভালই লাগে।

"উফ্ বাঁচালি রে! কখন থেকে মনটা কফি কফি করছিল, কিন্তু উঠে যে যাব সে উপায় নেই। Assignment শেষ হয়নি এখনও এদিকে আজ ডেডলাইন! তোর কাজ কতদূর?"

- "শেষ হয়নি মানে? সেই পরশু থেকে করে যাচ্ছিস এখনও করে উঠতে পারিসনি? বুড়ি এবার তোকে চিবিয়ে খাবে!" বলতে বলতে টেবিলের ধার ঘেঁষে পা ঝুলিয়ে বসলো ঋষি। "এত চিন্তা করিস না, ঠিক হয়ে যাবে। সকাল থেকে কিছু খাসনি নিশ্চয়ই, চল আগে খেয়ে আসি। তুই না খেয়ে থাকলে assignment complete হয়ে যাবে না।" দেবস্মিতার মনটা আর্দ্র হয়ে যায়, কিভাবে যে সে না খেয়ে থাকলে এই ছেলেটা ঠিক বুঝে যায়! নাহ্, ঠিকই বলেছে ঋষি, কিছু খেয়ে নিতেই হবে, মাথা ঘুরছে এবার খিদের চোটে!

           ক্যাফেটেরিয়ায় বসে স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করলো, " হ্যাঁ রে, বললি না তো তোর কাজ কতদূর? তোরগুলো তো আবার ramp এর জন্য যাবে!"

মুখটা বিকৃত করে ঋষি উত্তর দিল, "আর কতদূর! যা খাটাচ্ছে বুড়ি, নিজের কোনো পার্সোনাল লাইফ নেই বলে কি আমাদের থাকবে না? Frustrated মা* একটা! এটা নয় ওটা চাই, ওটা পেলে সেটা চাই! শালা আমরা যেন ওর চাকর! দূর দূর, ছেড়ে দিয়ে অন্য কোম্পানি join করে নেবো, দেখিস!"

দেবস্মিতা চুপ করে গেল, প্রজ্ঞাপারমিতা সান্যাল, Nargis Fashion House এর অন্যতম কর্ণধার। দেবস্মিতা ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ার সময় থেকেই এনার ফ্যান, তাই যখন নার্গিসে চাকরিটা পেয়েছিল তখন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল। কিন্তু এখন প্রতিদিন মোহভঙ্গ ঘটছে তার, এত খুঁতখুঁতে মহিলা সে আজ অবধি কোথাও দেখেনি। সবার আগে অফিসে আসেন, সবার শেষে বেরোন। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম ঘটতে দেখেনি সে এই কয়েকমাসে। সাথে সেইরকম মেজাজ, কেউ ওনাকে হাসতে দেখেনি, হাসা তো দূর কোনো কথা সোজাভাবে বলতে পর্যন্ত জানেন না উনি, সব কথা ঘুরিয়ে এমনভাবে শুরু করেন যে সামনের জন বুঝেই পায় না আসলে উনি কোন পয়েন্টে গিয়ে থামবেন। তবে দেখতে উনি চোখধাঁধানো এটা মানতেই হবে, ওনার বয়স যে চল্লিশ পার করে পঁয়তাল্লিশ ছুঁইছুঁই সেটা ওনাকে দেখে কেউ বলবে না, সমস্ত রকম পোশাকে স্বচ্ছন্দ, কোনো উগ্র প্রসাধনী নেই এমনকি পাকা চুলে রং অবধি করেন না। অবশ্য ওনার কাঁচা পাকা চুল যেন ওনাকে আরো ব্যক্তিত্বময়ী, আরো সুন্দরী করে তোলে, অনেকটা সেই ইন্দিরা গাঁধীর মত।

"এই ঋষি, ওনার হাজব্যান্ড কোথায় রে? ডিভোর্সী নাকি? কোনোদিন ওনার হাজব্যান্ডকে দেখিনি।" দেবস্মিতা একটু কৌতূহলী হলো।

- "আরে না না ডিভোর্সী না, ওনার হাজব্যান্ড থাকেন প্যারিসে, ওখানে Nargis এর হেডকোয়ার্টার। বছরে দুবার ছুটি নেয়, গরমকালে বুড়ি যায় আর শীতকালে বুড়ো আসে। তখন বুড়ি অফিসমুখো হয় না। সব বড়লোকি ব্যবস্থা বুঝলি! তবে ব্যবস্থাটা ভালো, সারাবছর অন্যের সাথে লটরপটর করে বছরে দুবার সতীসাধ্বী সাজা!"

দেবস্মিতার আর শুনতে ভালো লাগছিল না, ঋষি ছেলেটার এই এক দোষ, রেগে গেলেই প্রজ্ঞা ম্যাডামের চরিত্র নিয়ে টানাটানি করে। উনি স্বামীছাড়া একলা থাকেন বলে অফিসের সবাই কানাঘুষো করে কিন্তু দেবস্মিতার ভালো লাগে না এইসব। প্রজ্ঞা ম্যাডাম ভীষন কড়া, মেজাজি, খুঁতখুঁতে কিন্তু তাই বলে তাঁর চরিত্র নিয়ে আলোচনা ভীষন বাড়াবাড়ি মনে হয়।


"এটা কি ডিজাইন? তোমার কি কোনো সেন্স নেই, এগুলো কি হয়েছে? নাকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে gossip করার পর আর সময় থাকে না যে মাথা খাটিয়ে ডিজাইন বানাবে? So substandard!" বলে ডিজাইনের খাতাটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন প্রজ্ঞাপারমিতা সান্যাল।

কান্না পেয়ে গেল দেবস্মিতার, সারাদিনের খাটনির ফসল এগুলো, হতে পারে সেগুলো পছন্দ হয়নি তাই বলে এরকমভাবে বলতে হবে? সবাই ঠিকই বলে, ইনি এমপ্লয়ীদের নিজের slave ভাবেন। চুপ করে অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শুনতে পেল প্রজ্ঞা ম্যাডামের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, "আমার আজকের মধ্যে ফাইনাল ডিজাইন চাই তাই এখানে দাঁড়িয়ে time waste না করে just go and do your work!" এতগুলো কথা বলার সময় একবারের জন্যও নিজের ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে দেবস্মিতার দিকে দেখেননি প্রজ্ঞাপারমিতা।

দেবস্মিতা একবার ঘড়িটা দেখলো, সন্ধ্যে সাতটা বাজে। এখন যদি নতুন করে বানাতে বসে তাহলে আজ শেষ হবে কিনা সন্দেহ! অনুনয়ের সুরে বলে ওঠে, "ম্যাম কাল এসে করে দিলে হবে না?"

এতক্ষণে নিজের ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে দেবস্মিতার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন প্রজ্ঞাপারমিতা, তারপর হিমশীতল কণ্ঠস্বরে তীব্র শ্লেষের সাথে বলে উঠলেন, "salaryটা মাসের শেষদিন না দিয়ে পরের সপ্তাহের কোনো একদিন দিলেও তো চলে নাকি? চলে না, না? খালি কাজের সময় পরেরদিন মনে পড়ে যায়! কেন আসো কাজ করতে? Fancy? শখ?"

চোখের জল মনে হয় সত্যিই আর ধরে রাখা যাচ্ছে না, সারাদিন প্রায় না খেয়ে না বিশ্রাম নিয়ে একমনে কাজ করেছে সে আর তার পুরস্কার এই ভৎর্সনা! আগুন জ্বলে উঠলো দেবস্মিতার মনে, কি ভেবেছেন উনি? বস্ বলে যা খুশি বলে অপমান করা যায়? ঠিক আছে দেবস্মিতাও দেখিয়ে দেবে, কাজটা তার কাছে শখ নয়। চোখের জল সামলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে এলো সে এবং সারারাতের ঐকান্তিক চেষ্টায় ভোরবেলা সেই ডিজাইন শেষ করে প্রজ্ঞা ম্যাডামের কেবিনে ডিজাইন গুলো রাখতে গিয়ে বিস্মিত চোখে দেখে ম্যাডাম এখনও অফিসে! দেবস্মিতাকে দেখে কোনো ওজরআপত্তি না শুনে নিজের গাড়িতে তাকে তার পিজির সামনে নামিয়ে দিয়ে যখন ম্যাডাম বলে উঠলেন, "Take the day off and join back tomorrow" দেবস্মিতার যেন নিজের কানকে বিশ্বাস হয়নি। প্রজ্ঞাপারমিতা সান্যাল একটা ধাঁধা হয়েই রয়ে গেলেন!


এরপর দেখতে দেখতে একটা গোটা বছর পার হয়ে গেল "Nargis" এ দেবস্মিতার। কত কি যে সে দেখে ফেললো এই একবছরে! ঋষি, যাকে নিজের সবচেয়ে কাছের ভেবেছিল, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিল যাকে নিয়ে সে দেবস্মিতাকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতার অভিজ্ঞতা উপহার দিয়ে গেল। তারই ডিজাইন চুরি করে তাকেই parasite আখ্যা দিয়ে "নার্গিস" এর প্যারিসের অফিসে চলে গেল। কেউ পাশে দাঁড়ায়নি, মুখে ফাঁপা সহানুভূতি দেখালেও আড়ালে তাকে নিয়ে হেসেছে, সে অসহায়ের মত শুধু দেখেছে। মা বাবাকে বললে তার কেরিয়ারের পূর্ণচ্ছেদ ঘটিয়ে দিতেন তাঁরা তাই তাদেরকেও বলতে পারেনি সে। এমতাবস্থায় নিজেকে কাজে ডুবিয়ে দেওয়া ছাড়া দেবস্মিতার কাছে আর কোনো রাস্তাই খোলা ছিল না। তবে এই একবছরে একটা ব্যাপারের কোনো পরিবর্তন হয়নি প্রজ্ঞাপারমিতা সান্যালের বদমেজাজ আর দুর্ব্যবহার! এই একবছরে কত ডিজাইনের rejection আর কত অপমান সে সহ্য করেছে তার ইয়ত্তা নেই, একবছর না হলে সে "নার্গিস" ছেড়ে যেতেও পারবে না তাই মুখ বুজে সব সয়ে যাচ্ছে সে। মাঝে মাঝে মনে হয় প্রজ্ঞা ম্যাডামের কোনো ব্যক্তিগত বিদ্বেষ আছে তার উপর, নাহলে ঋষির ডিজাইন চুরির ঘটনাটা ম্যাডামকে জানানোর পর ম্যাডাম অত্যন্ত বিদ্রুপের সুরে বলে উঠেছিলেন, "প্রেমাস্পদকে এটুকু উপহার দেওয়াই যায়, তাই না? এখন আমায় বলে কি হবে, তখন প্রেম প্রেম খেলতে ব্যস্ত ছিলে আর সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তোমায় tissue paper এর মত use করে ফেলে দিয়ে চলে গেল বলে আমার কাছে কাঁদুনি গাইতে এসেছ? আমি কি করবো শুনে? যাও নিজের কাজ করো, তোমার বোকামির গল্প শোনা ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে।" অপমান সেদিন যে কি তীব্রভাবে বেজেছিল মনে তা শুধু দেবস্মিতা জানে।

              কাল অ্যানুয়াল ফাংশন "Nargis" এর, designer of the year ও design of the year নির্বাচিত হবে এবং যে যে জিতবে তার প্যারিসের অফিসে যাওয়ার সুযোগ হয়ে যাবে। বলাই বাহুল্য, সবাই এই সুযোগ নেওয়ার জন্য উদয়াস্ত খাটছে, সারাদিন প্যারিসের অফিস নিয়ে আলোচনা চলছে সাথে ম্যাডামের হাজব্যান্ড যিনি প্যারিসের অফিস দেখাশোনা করেন তাকে নিয়ে জোর জল্পনা চলছে। ম্যাডামের হাজব্যান্ড মিঃ দেববর্মণ রীতিমত হ্যান্ডসাম সেইজন্য মেয়েদের উৎসাহটা একটু বেশীই। কিন্তু এতসব উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দেবস্মিতা যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, বিষন্নতা আর হতাশার কুয়াশায় ডুবে থাকা এক নির্জন দ্বীপ! এখানে থেকে আর কোনো লাভ নেই, এই একবছরে তার কেরিয়ার এক চুলও এগোয়নি, এগোবে কি প্রজ্ঞা ম্যাডামের তো দেবস্মিতার কিছুই পছন্দ হয় না, না তার ডিজাইন আর না তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে ল্যাপটপে resignation letter type করায় মন দিল, আর নয় এখানে, ইভেন্টের দিনই last hour এ resign করবে সে। এক বছরের contract শেষ হয়ে যাচ্ছে তার, আর এক মুহূর্তও সে থাকবে না এখানে। নিজের হৃদয় ভাঙার আওয়াজ, রোজকার অপমান, নিঃসঙ্গতার ব্যঙ্গ আর সহ্য করতে পারছে না সে। কিছুই তো করতে পারলো না সে, না কারোর মন জয় করতে পারলো না কেরিয়ার বানাতে পারলো, তার চলে যাওয়াই শ্রেয়, অন্য কোথাও নতুন করে শুরু করবে হয়তো। মনে একরাশ মন খারাপের মেঘ জমা হয়েছে, সেই সমস্ত মেঘকে জড়ো করে নিজের ডিজাইনের খাতার পাতায় ছড়িয়ে দিল দেবস্মিতা, চলেই তো যাবে সে আজ নাহয় একদম মনের মত ছকভাঙা কিছু সৃষ্টি করে যাবে! অতঃপর ছয় ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে দেবস্মিতার খাতার পাতায় ভরে উঠলো, "মেঘবারির কথা"!!!


প্রায়ান্ধকার হলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে নিজের কানকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না দেবস্মিতা। Employee of the year award এর জন্য তখন ঘোষণা হচ্ছে দেবস্মিতা বসুর নাম, অগুনতি ফিসফাস আর গুঞ্জনের মধ্যে রোশনি পাশ থেকে ঠেলা মারার ফলে যেন সম্বিৎ ফিরল তার। কোনরকমে স্টেজে উঠে অ্যাওয়ার্ড নিয়ে নিচে নামতে না নামতেই চমকের দ্বিতীয় ঝাপটা খেলো সে, Design of the Year "মেঘবারির কথা" নামটা শুনে। কি করে সম্ভব, ওগুলো তো তার মনের খেয়ালে আঁকা "যা খুশি তাই" এর কোলাজ, প্রজ্ঞা ম্যাডাম কি করে approve করলেন? শুধু approve নয় একেবারে অ্যাওয়ার্ড দিয়ে দিলেন? তার মানে সে পারে, সে মিছিমিছি যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ইসস বড্ড ভুল হয়ে গেছে তার, এক্ষুনি একবার ম্যাডামের কাছে যেতে হবে, resignation mail টা পাঠিয়ে দিয়েছে সে!

               হন্তদন্ত হয়ে প্রজ্ঞা ম্যাডামের কেবিনে গিয়ে দেখে ম্যাডাম ল্যাপটপে কিছু করছেন। দেবস্মিতা ঢুকতেই অন্যান্য দিনের মতোই ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন, "resignation এর কারণটা কি জানতে পারি?"

কাঁচুমাচু মুখে দেবস্মিতা বলে উঠলো, "আসলে আমার কোনো ডিজাইন তো আপনার পছন্দ হয় না তাই ভাবলাম এখানে থাকার যোগ্য আমি নই। কিন্তু আজ অ্যাওয়ার্ড..."

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা দেবস্মিতার চোখে চোখ রেখে বলে উঠলেন, "অ্যাওয়ার্ড পেয়ে মনে হলো তুমি যোগ্য? আমি যদি বলি তুমি যোগ্য বলেই এখানে এতদিন তোমায় রেখে দিয়েছি?"

"কিন্তু আমার ডিজাইন তো আপনি বেশীর ভাগ reject করেন, আজ অবধি একটা অ্যাওয়ার্ড পাইনি আমি, কোনো ইভেন্টে আমার ডিজাইন সিলেক্ট করেননি আপনি, তাহলে কিসের যোগ্য আমি?" অস্থির কণ্ঠে দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করে।

প্রশ্নটা শুনে হাল্কা হেসে চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা বলে উঠলেন, "এতদিন তোমার ডিজাইন reject করেছি কারণ সেগুলো একটাও তোমার ডিজাইন নয়। সেগুলো কতগুলো lifeless rules follow করা আঁকিবুকি ছিল। এভাবে designer হওয়া যায় না, তোমার ডিজাইন তোমার গল্প বলবে, যেটা আজকের ডিজাইনে ছিল। তাই সেই ডিজাইন এত সুন্দর, এত জীবন্ত ছিল যে আমি award দিতে বাধ্য হলাম। Employee of the Year award এর কারণ তোমার অধ্যবসায়, তোমার attitude. শত rejection, শত heartbreak এর পরেও লড়ে গেছো, রাতদিন এক করে পড়ে থেকেছো। You have that fire girl and I like it. ওই rejection গুলো না হলে আজ "মেঘবারির কথা" তৈরী হতো না যে!"

সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে দেবস্মিতার। এতদিন যাকে দেখলে বিরক্ত হয়েছে, বিতৃষ্ণায় যার নাম নিত না সে, "বুড়ি", "frustrated মা*" বলতো যাকে, শেষের দিকে যাকে মনে মনে "s***" অবধি বলেছে সে আসলে তাকে তৈরী করছিল! নিজের নির্বুদ্ধিতায় আর সামনের মানুষটার উদারতায় তার মাথা যেন আপনা থেকেই শ্রদ্ধায় ঝুঁকে গেল!

"Excuse me! আমার একটা মিটিং আছে তাই আমায় তো বেরোতে হবে। Congratulations once again for the awards. আর resignationটা আমি নিলাম না। Enjoy your day!" বলে ল্যাপটপ গুছিয়ে নিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা বেরোনোর উদ্যোগ করতেই কৃতজ্ঞতায় বুজে আসা গলা কোনোমতে পরিষ্কার করে নিয়ে দেবস্মিতা বলে উঠলো, 

"Thank you so much Ma'am. কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। I just wanna be like you!"

কথাটা শুনে দেবস্মিতার চোখে চোখ রেখে এক পা এগিয়ে এসে একটা মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলে প্রজ্ঞাপারমিতা বললেন, "Like me? আবার সেই একই ভুল করছো? জীবনে কিছু করতে গেলে, নিজের পরিচয় বানাতে গেলে কারোর মত হলে হয় না, নিজের মত হতে হয়। Be the real you, cherish yourself because people will adore you only when you'll love yourself. তাই অন্য কারো মত নয়, নিজের মত হও! অন্যকে নয় নিজেকে ভালোবাসো! Be the original version of You!" বলে কেবিনের দরজা খুলে দৃপ্ত পদক্ষেপে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন প্রজ্ঞাপারমিতা সান্যাল। সেই ব্যক্তিত্বময়ীর দিকে দেখতে দেখতে দেবস্মিতার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো, "Be the Nargis"!


---------------- সমাপ্ত -------------------------------

Post a Comment

Previous Post Next Post