"এই সুমি, সুমি, প্লিজ একটু খাতাটা দেখা না!"
" চুপ কর মধু, রঞ্জনা আন্টি খুব কড়া...."
" সিরিন, চার নম্বরের উত্তরটা একটু বল না রে...."
" খাতাটা এভাবে রাখছি, দেখে নে।"
" কি ব্যাপার? কথা কিসের?" রঞ্জনা আন্টির ধমকে সবাই তটস্থ হয়ে যায়।
পরীক্ষা শেষ। হল থেকে সকলে একে একে বেরিয়ে আসছে।
" এই যে সুমি হিরোইন, খাতাটা একটু দেখালে তোর জাত যেত?" মধু মানে মধুরিমার মারমুখী চেহারা দেখে সুমি মানে সুমিতা চুপসে যায়। ক্লাসের ভাল মেয়ে সিরিন বলে ওঠে, " মধু, তুই কি জানিস না, এ বছর ফার্স্ট হবে আমাদের সুমি, তোকে উত্তর বলে দিলে ও লাস্ট হয়ে যাবে না?" সকলে হি হি করে হেসে ওঠে। চারদিক থেকে রব ওঠে, " ফাস্টু ফাস্টু....." রাতুল দৌড়ে আসে,"হ্যালো, মহিলামহল, পরীক্ষা কেমন হল?" রণজয়, সায়ন, দেবজিতও এগিয়ে আসে। সকলে মিলে পরীক্ষার আলোচনায় মগ্ন হয়। সকলে মিলে খানিক গল্পগাছা করে যে যার বাড়ির পথ ধরে। সিরিন আর মধুমিতার বাড়ি পাশাপাশি। ওরা একসাথে বাড়ি ফেরে। হাঁটতে হাঁটতে সিরিন বলে,"মধু, এবার একটু পড়াশোনায় মন দে। কতদিন আর আমার থেকে টুকলি করবি?"
" এই শোন, প্লিজ, মায়ের মত জ্ঞান দিস না। ওটা আমার বিষয় নয়, বুঝলি? কোনমতে স্কুলটা শেষ করে আমি বিখ্যাত গায়িকা হব। তুই কেবল কল্পনা কর, ভবিষ্যতে তোর কাছে সাংবাদিকদের ভিড়, 'আচ্ছা, আপনি তো জগদ্বিখ্যাত গায়িকা মধুমিতাদেবীর ছোটবেলার বন্ধু, একটু ওনার ছেলেবেলার কথা বলুন.....' আহা!" স্বপ্নের দুনিয়ায় হারিয়ে যায় মধুমিতা।
" ওরে, মাটিতে আয় বাবা, কাল আপাতত অঙ্ক পরীক্ষা দিতে হবে ভাই তোকে।" সিরিনের কথায় মধুমিতা বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ে, " হে ভগবান! আমার কি হবে? সিরিন, আজ রাতে তোর বাড়িতে থেকে একসাথে অঙ্ক করব। আমাকে বাঁচা।"
সন্ধ্যেবেলাতে মধুমিতা সিরিনের বাড়িতে গেল। অঙ্কে পারদর্শী সিরিন কি সুন্দর করে অঙ্ক বুঝিয়ে দেয় মধুমিতাকে ! " তুই কি সহজ করে অঙ্ক বুঝিয়ে দিস রে! আর স্কুলে পর্না আন্টি কি যে ছাতার মাথা বোঝায়! আমার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।" মধুমিতার কথায় হেসে ফেলে সিরিন, " তুই স্কুলে থাকলেও তোর মন তো অন্য জায়গায় থাকে। তাই বুঝতে পারিস না।" একটু পরে সিরিনের মা এসে দুজনকে কফি দিয়ে যান। মধুমিতা কফিতে চুমুক দিয়ে বলে ওঠে, " আন্টি, তোমার হাতের কফি এক্কেবারে লা জবাব!"
" মন দিয়ে পড়, মধু, এবারে অঙ্কে আশির উপর নম্বর চাই আমার। নইলে তোকে আর কোনদিন কফি খাওয়াব না, বুঝলি?" আন্টির কথায় মধুমিতা বলে ওঠে," ও বাবা! কফির জন্য জান হাজির! সিরিন ভাল করে পড়া আমায়।"
পরীক্ষা শেষ। স্কুলের বন্ধুরা মিলে পরিকল্পনা হল সিনেমা দেখতে যাওয়ার। নির্দিষ্ট দিনে সেজেগুজে সকলে সিনেমা দেখে, রেস্তরাঁয় খাওয়াদাওয়া করে দারুণ মজা হল। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে সিরিন ও মধুমিতা বাড়ির পথ ধরল। বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ি দশ মিনিটের পথ। হেঁটেই ফিরছিল দুজনে। রাস্তাটা একটু নিরিবিলি থাকে সন্ধ্যের পর। প্রথম বাঁকটা পেরোতেই কোথা থেকে একটা বাইক সাঁ করে এসে ওদের পথরোধ করে দাঁড়াল। বাইক আরোহী জোর করে সিরিনকে বাইকে তুলতে চেষ্টা করল। নরমসরম মেয়ে সিরিন কান্নাকাটি শুরু করল। মধুমিতা অত সহজে হারবার পাত্রী নয়। ক্যারাটে জানা মেয়ে সে। প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে বেশ কটা ক্যারাটের প্যাঁচ কষল সে। তাতেই ভয় পেয়ে বাইক আরোহী পগারপার। সমানে কেঁদে চলেছে সিরিন। মধুমিতা তাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করে বলল," কাল থেকেই আমার সঙ্গে ক্যারাটে ক্লাসে যাবি তুই।" সিরিন পরম ভরসায় জড়িয়ে ধরল তার বেস্ট ফ্রেণ্ডকে।
সেদিন টিফিন পিরিয়ডে রোজকার মতোই গল্প ইয়ার্কি চলছিল। ক্লাসের হ্যাংলা মেয়ে জয়িতা সবারই বাক্স থেকে এটা ওটা নিয়ে খেয়ে বেড়াচ্ছিল প্রতিদিনের অভ্যেস মত। মধুমিতা ও সিরিনও প্রতিদিনের মতোই টিফিন ভাগ করে খাচ্ছিল। সিরিন চিকেন চাউমিন এনেছিল। মধুমিতা এগরোল। মধুমিতা বলল, " ঝটপট খা, ঐ আসছে হেংলুটা। দাঁড়া, আজ একটা মজা করি...." সে এগরোল থেকে সব লঙ্কাকুচি বের করে নিয়ে অল্প চাউমিনের মধ্যে ভাল করে মিশিয়ে দিল। জয়িতা এসে টপ করে খানিকটা চাউমিন মুখে পুরে দিয়েই 'জল জল' বলে ঝালে চেঁচাতে লাগল। সকলে হেসে উঠল, বেশ জব্দ হয়েছে হেংলুটা।
স্কুলে একটি নতুন ছেলে ভর্তি হল, অয়ন। যত দিন যেতে লাগল, দেখা গেল অয়ন পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোতেও তুখোড়। ক্লাসের মেয়েরা অয়নকে পছন্দ করতে শুরু করল। কিন্তু অয়নের বেশি ভাব হল সিরিন আর মধুমিতার সঙ্গে। তিনজনের মধ্যে ভারি বন্ধুত্ব হল। কিন্তু মন বড়ই দুরূহ! মধুমিতা ও সিরিন দুজনেই অয়নকে ভালবেসে ফেলল। যদিও কেউই কারোর কাছে তা প্রকাশ করল না। এদিকে এভাবেই কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। স্কুলজীবন শেষের পথে। একদিন মধুমিতা সিরিনকে বলেই ফেলল নিজের মনের কথা। সিরিন স্তব্ধ, সেও যে....কিন্তু দারুণ খুশি হয়ে সে বলে উঠল, " ওয়াও! ঝটপট নিজের মনের কথাটি অয়নকে বলে ফেল দেখি...." ডানপিটে মধুমিতা জীবনে প্রথমবার লজ্জায় লাল হল।
সেদিন মধুমিতা গিয়েছে সিরিনের বাড়িতে। সিরিন স্নান করছিল। তাই মধুমিতা ওর ঘরে এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল সিরিনের বাংলা খাতার পাতায়, সিরিনের হাতের লেখা না? হ্যাঁ, তাই তো! বারবার অয়নের নামটা লিখে কেটে দিয়েছে সে! মধুমিতার মন ভেঙে গেল। গলার কাছটায় কেমন ব্যথা করছিল। এমনসময় সিরিন এল," কি রে, কখন এলি? অয়নকে নিজের ভালবাসার কথাটা বললি?"
মধুমিতা বাংলা খাতাটা সিরিনের সামনে মেলে ধরে। সিরিন অপ্রস্তুত, " আরে! ওটা এমনি ...ঐ একদিন...." আর কোন কথা খুঁজে পায় না সে। মধুমিতা হঠাৎ হা হা করে হেসে ওঠে," তুই ভালবাসিস অয়নকে। আরে! তুই যা মুখচোরা, তোর মুখ থেকে অয়নের প্রতি তোর ভালবাসার কথা স্বীকার করানোর জন্যই তো এই নাটকটা করলাম আমি। অয়নের প্রতি আমার কোন ভালবাসা নেই রে...."
সিরিন মৃদু হাসে, " আমার কাছে লুকোচ্ছিস! আমার অয়নের প্রতি কোন ভালবাসা নেই।" কিছুক্ষণ দুজনেই এই নিয়ে তর্ক করতে থাকে। হঠাৎ দুজনেই চুপ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সিরিন বলে ওঠে, " এই শোন, কে রে এই অয়নটা? ওর এত ক্ষমতা, দুদিন এসে আমাদের এত বছরের বন্ধুত্বের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করছে!"
গালে হাত দিয়ে মধুমিতাও বলে ওঠে," তাই তো!"
সিরিন বলে," অয়ন ক্যানসেল। আমরা কেউই ওকে ভালবাসব না, ব্যস্!"
মধুমিতা সায় দেয়, " স্কুল শেষ, ওর সঙ্গে যোগাযোগ শেষ। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী।"
সিরিন বলে ওঠে, "আমাদের বন্ধুত্ব জিন্দাবাদ! নিপাত যাক অয়ন।" গলা জড়াজড়ি করে হেসে লুটোপুটি খায় দুই বন্ধুতে।
