ভোর সাড়ে তিনটে। চরাচর নিস্তব্ধ। রাতের এঁটো বাসনগুলো রমা উঠনে বসে মেজে নিচ্ছে। দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাপেরবাড়িতেই ওর বাস। আসলে দীনু জন্মানোর পরেই ওর বাপটা অন্য একটা মেয়ে মানুষের সাথে ভেগেছে। রমা ভেবেছিলো এরপর দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে ওর শ্বশুর বাড়িতেই থেকে যাবে। তবে ভাশুর-দেওরদের জ্বালায় সেই পাট চুকিয়ে বাপেরবাড়িতে এসে হাজির হলো। তবে তিনটে পেট চালানোর ব্যবস্থা ওকে নিজেকেই করতে হলো।
চাকরিটা যদিও ওর দাদাই খুঁজে দিয়েছে এই বাড়িতে আসার পর। রমার বড় মেয়ে পিঙ্কী ক্লাস এইটে পড়ে আর সাধন পড়ে ফোরে।
দাঁত মেজে,রমা মুখ ধুয়ে নেয়। ডাবর লালের কোটো টায় সংসারের জীর্ণতার ছাপ স্পষ্ট। এই সময়টায় ওর বড্ডো তাড়াহুড়ো থাকে। চা টা কোনমতে গিলে নিয়েই ও ছুটতে থাকে স্টেশনের দিকে। চারটে পনেরোর লক্ষীকান্তপুর-শিয়ালদা লোকাল ধরবে। ও এই ট্রেনেরই ডেলি প্যাসেঞ্জার। লক্ষী, শম্পা, মণিকা, তারা ওরাও যায় এই ট্রেনে। ওদের সবার কজের জায়গা আলাদা। কেউ ধুপকাঠি কারখানায়, কেউবা পুরনো জামা কাপড়ের বদলে নতুন বাসন বিক্রি করে বেড়ায়। রমা চানাচুর তৈরি করে, মিলন দাসের চানাচুর। ওর সাথে আরও জনা সাতেক মহিলা কাজ করে। ছাঁকা তেলে ঝুরিভাজা থেকে চানাচুর প্যাকেট করা সব কাজ ওরা একা হাতে সামলায়। রমা অভিজ্ঞতায় নতুন হলেও মিলন দাস ওর একটু বেশি কদর করে। নইলে টিফিনের সময় কি আর রোজ রোজ বাইরে বেড়াতে নিয়ে যায়। সবাই সব বোঝে। আর সবাই যে ওকে হিংসে করে সেটাও রমা বোঝে।
মিলন দাস লোকটার স্বভাব-চরিত্র যে খুব খারাপ তেমন নয়, ওর বউটা অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে আছে আজ সতেরো বছর হল। মেয়েটাও বড় হয়েছে কলেজে পড়ে। রমাকে দেখে তাই আর ও লাভ সামলাতে পারেনি। রমার পান পাতার মতন মুখখানাই ওর জীবনের কেতু। আসলে ওর মুখের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। চোখ দুটো যেন সবসময় কথা বলে । ছোটবেলায় ওর প্রেমিক বলেছিল- "জানিস তোর এই মুখ দেখলে অনেকেই তোর প্রেমে পড়বে"। তবে এতকিছুর পরেও রমার বরটা কেন যে ওদেরকে মাঝ পথে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল সেটা ও কিছুতে বুঝে পায়না। হয়তো সে ওর থেকেও আরো সুন্দরী। যাকগে যা এসব পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে আর লাভ নেই।
মিলন কখনো রমাকে বিয়ে করবে না। কখনো ওর ছেলেমেয়েদের দায়িত্বও নেবেনা। তবে রমা নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে জানে।
ট্রেন থেকে নেমে ও সোজা কারখানার দিকে হাঁটতে থাকে। তাড়াতাড়ি পা চালায়। কারখানার কাজ শেষ করে আজ টিফিনের পর মিলন দাস ওর বাড়িতে নিয়ে যাবে। এখন থেকে আর কারখানায় নয়, রমা কাজ করবে মিলন দাসের বাড়িতে। কারখানা থেকে কত প্যাকেট মাল বাড়িতে আসছে, দোকানে বেরিয়ে যাচ্ছে এইসব হিসেবে রাখাই হবে এখন থেকে ওর কাজ। সাতশো টাকা বেশি দেবে। কারখানার ভ্যাপসা গরমে কাজ করার থেকে ঘরের মধ্যে পাখার তলায় বসে এই কাজ করা ঢের ভাল। তাই রমাও আর আপত্তি করেনি। আসলে রমাকে চোখের সামনে নিজের কাছে রাখতেই এত কাণ্ড। আজকাল জিনিসপত্রের যা দাম। তার ওপর রোজ রোজ বাইরে ঘোরার খরচা অনেক। রমা এসব ভালোই বোঝে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। কাজ শেষ করে ওরা যখন বাড়ি যাওয়ার দিকে পা বাড়ালো তখন সূর্য মাথার ওপর একেবারে তাণ্ডব করছে। রাস্তার ধারে একটা বেঁটেখাটো লোক বেশকিছু আখ নিয়ে বসেছেবসেছে; আখের রস বিক্রি করছে। রমার ওদিকে চোখ যেতেই ও বলে উঠলো- "আখের রস খাবে মিলন দা? চলো না"।
রমার কোন আবদার মিলন ফেলতে পারেনা। মেয়েটার মধ্যে না একটা জাদু আছে। কোন আবদার করলে কিছুতেই না করা যায় না।
দু গ্লাস আখের রস খেয়ে দুজনে আবার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
মিলন দাসের বাড়িটা খুব একটা গোছানো নয়। বাড়ি পৌঁছেই রমা সেটা দেখলো।
বাড়িতে বউ অসুস্থ। কেইবা বাড়ি গোছাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ওর মনে একটা অদ্ভুত সাধ জাগলো। এরকম একটা সংসার যদি ও পেত তাহলে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতো সংসারটাকে। সংসার করার সাধটা বোধহয় ওর মেটেনি এখনো। অফিস ঘরটার উল্টোদিকে একটা ঘর রয়েছে। ওটা মিলন আর ওর স্ত্রীর ঘর। অফিস ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালেই ও ঘরের খাটটা দেখতে পাওয়া যায়। ওই খাটেই বকুল শুয়ে রয়েছে আজ সতেরোটা বছর। রমার খুব মায়া হলো ওকে দেখে। বেচারা এতগুলো বছর ধরে মরে বেঁচে আছে।
একদম প্রথমে বাঁ দিকটা প্যারালাইজড হয়েছিলো। তারপর সেই যে শয্যাশায়ী হলো আর উঠে দাঁড়ালো না।
মিলন দাস এতগুলো বছর ধরে স্ত্রীর সেবা করে গেছে চোখ কান বুজে। মেয়েকে বড় করেছে। নিজের সব দায়িত্বই পালন করেছে। তাই এখন ও নিজের জন্য বাঁচবে। অন্তত রমার সাথে আলাপ হওয়ার পর থেকেই ওর এমনটা মনে হয়।
সমস্ত কাজকর্ম বুঝে নিয়ে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল রমার। ৮টা ১২র ট্রেনটা ধরতেই হবে নইলে আরো দেরী হয়ে যাবে। আসলে কাল থেকে এবাড়িতে ওকে একটু সকাল সকালই আসতে হবে। রান্নাবান্না করে তারপর কারখানার কাজে হাত দেবে। সেই কথাই হয়েছে।
লেডিস কম্পার্টমেন্ট তিল ধরানোর জায়গা নেই। কোনোমতে ভিড় ঠেলে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ঝোড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল গুলোকে এক কাছে করে খোঁপাটা শক্ত করে বাঁধলো।
একটার পর একটা স্টেশন পেরোচ্ছে। কত লোক নামছে কত লোক উঠছে। দেখতে দেখতে ট্রেন থামলো লক্ষীকান্তপুরে। এটাই শেষ স্টেশন। রমা স্টেশন থেকে বেরিয়েই সোজা মতিদার গুমটি থেকে পাঁচশো আলু, আড়াইশো পেঁয়াজ আর চারটে ডিম কিনে নিলো। ভাতটা পিঙ্কী রোজই রেধেঁ রাখে। আজও বোধহয় তাই করবে। বাড়ি ফিরে রমাকে একটা পদ রাঁধতে হয়। ডাল, ডিম ,সোয়াবিন যা হোক একটা।
বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়েই রমা রান্নায় বসলো। আজ বহুদিন পর ওর বেশ আনন্দ হচ্ছে। তবে এটা কিসের আনন্দ সেটা ও জানেনা। হয়তো সাতশো টাকা বেশি পাওয়ার আনন্দ। আবার অন্যের সংসার সামলানোর আনন্দও হতে পারে। সে যাই হোক রান্না করতে করতেই ও ঠিক করে নিচ্ছে কালকের সারাদিনের কোন কাজ কখন ও কিভাবে করবে। মিলন দার জন্য ওর পছন্দের পটল চিংড়ি রান্না করবে। তবে বৌদির জন্য কী করবে সেটাইও বুঝে পাচ্ছে না_ কিন্তু মিলন দার বউকে নিয়ে ও খামোকা এতো কেন ভাবছে!
মালটা সরে গেলে ওরই তো রাস্তা পরিষ্কার হবে। এইনা রমার বড় দোষ; বড্ড বেশি তাড়াতাড়ি মায়ায় জড়িয়ে যায় মেয়েটা। মন তো নয় যেন রেলগাড়ি একবার ভাবতে শুরু করলে আর সহজে থামতে চায় না-বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলে উঠলো কথাগুলো। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করেই ওরা তিনজনেই শুয়ে পড়লো। এই সময়টা ওদের তিনজনেরই বড্ড ব্যক্তিগত। মা-মেয়ে-ছেলে তিনজনেই ওরা সারাদিন যা করেছে সব গল্প করে। তবে পিঙ্কীটা আজকাল একটু বেশি চুপ থাকে। রমার ফোনটা হাতে পেলেই খুট খুট করে। মেয়ে বড় হচ্ছে। মেয়ের মনে অন্য রঙিন গল্পরা বাসা বাঁধছে। রমা সবই আন্দাজ করে কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। এই কিছু না বলাটা ওর আর একটা বদ অভ্যেস। এই করেই ও নিজের সংসারটা শেষ করলো। নইলে দীনেশ যে একটা অন্য মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সেটা টের পেয়েও চুপ থাকে। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে ও যে কখন ঘুমিয়ে পড়লো টেরই পেল না।
মিলন দার বাড়িতে আজ রমার প্রথম দিন। সকালবেলাতে গিয়েই রান্নাবান্নার কাজ টা সেরে ফেলেছে। এখন হিসেব করছে। কত প্যাকেট মাল কারখানা থেকে এলো,কত প্যাকেট দোকানে যাবে। এইসব। আজ বকুলের জন্যও শিঙি মাছের পাতলা ঝোল রেধেঁছে। বকুল কোন শক্ত খাবার খেতে পারে না। ওকে সবকিছুই গলিয়ে খাওয়াতে হয়। ভাতটা ঝোল দিয়ে ভালো করে চটকে গলিয়ে নিয়ে বেশ কায়দা করে ওকে খাইয়ে দিলো রমা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে যায়। রমা আর মিলন একসাথে খেতে বসেছে। পটল চিংড়িটা খাসা রেধেঁছে। বেশ তৃপ্তি করে খেলো মিলন। বহুদিন ও এত ভাল রান্না খায়নি।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে রমা অফিস ঘরে গেল। বাকি কাজ শেষ করতে। হঠাৎ করেই মিলন এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে। রমার গোটা শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেল। এই অনুভূতিটা ওর বেশ লাগে। দীনেশ চলে যাওয়ার পর এসব তো হারিয়েই গেছিলো ওর জীবন থেকে। তবে দীনেশ এর সাথে মিলনের কোন তুলনাই চলে না। দীনেশের ভালবাসা ছিল অভ্যেসের বশবর্তী;তাতে কোন টান ছিল না। কিন্তু মিলনের ভালোবাসার টান রমা উপেক্ষা করতে পারেনি। যতদিনে এগিয়েছে ওর ওপর নির্ভরশীলতা ততোই বেড়েছে। আসলে ওরা দুজনেই দুজনের কাছে স্বস্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে।
রমা আদুরে গলায় বলে উঠলো- "জানোতো মিলনদা সংসার করতে না এখনো আমার খুব ইচ্ছে করে"।
মিলন বললো-"আজ থেকে নতুন একটা সংসারই তো সামলাচ্ছো তুমি রমা। হ্যাঁ আমি জানি;এটাকে পুরোপুরি নিজের করে মেনে নিতে পারছ না তুমি, কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি যা চাও তা এজীবনে আমার পক্ষে তোমাকে তা দেওয়া সম্ভব নয় রমা।
বকুল অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমার গোটা জীবনটাই বদলে গেছে। দায়িত্ব পালনের তপস্যা করে গেছি আজীবন। তারপর একদিন তুমি এলে; আমার তপস্যা ভাঙলো।"
"অনেকক্ষণ হয়ে গেল; যাই বৌদিকে একটু দেখে আসি" -এই কথাটা বলেই রমা উঠে চলে গেল ওঘরে।
মিলন একটু অবাক হলো।
আসলে এটা রমার আরো একটা বদ অভ্যাস। কোন কথা পছন্দ না হলে; বিরক্তি হলে ও ঠিক এই ভাবেই সেটা প্রকাশ করে।বকুলের দু চোখ দিয়ে জল গড়াতে দেখে ওর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো। মনে হয় ও কিছু বুঝতে পেরেছে। ঠিক যেমন রমা পেরেছিলো ওর ঘর ভাঙ্গার বেলায়। হঠাৎ করেই রমার মনে হলো ও বোধহয় বকুলের বিশ্বাস ভাঙছে। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করতে শুরু করল ওর। জীবনে এই প্রথম বোধহয় ওর এই রকম অনুভূতি হচ্ছে।
বাড়ি ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত এই নিয়ে ভাবলো।
-ও বোধহয় পাপ করছে।
-ঘর ভাঙতে যাচ্ছে কারোর।
-না_না; এটা ও কিছুতেই করতে পারে না! ঘর ভাঙ্গার জ্বালা যে কি তা ওর থেকে ভালো আর কেইবা জানে?
রাত পেরিয়ে ভোর হলো। সারা রাত একটুও ঘুমাতে পারেনি মেয়েটা। ভাবা যায় যে কাজ নিয়ে একদিন আগে পর্যন্তও উত্তেজনা-আনন্দের শেষ ছিলো না;এখন তার জন্য ঘুম উড়েছে। মনের মধ্যে বিস্তর দ্বন্দ্ব চলছে।
এমন সময় হঠাৎই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলো।
-মিলন দা! তাও আবার এতো সকালে!
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিলন চাপা গলায় বলে উঠলো-বো বো বকুল আর নেই রমা।একটু আগেই ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তুমি পারলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। কথা গুলো যন্ত্রের মতো বলেই ফোনটা কেটে দিলো।
এসব কি শুনছে রমা। কাল যে মানুষটাকে নিজে হাতে ও খাওয়ালো;আজ কি না সে নেই। যার জন্য ও এতো কিছু ভাবছিলো সেই কিনা............!
বাড়ি থেকে বেরোতে আর এক মুহুর্ত দেরি করলোনা ও। বকুলের ওই কান্না ভেজা মুখটা বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। একটা কথাই সমানে ভেবে চলেছে ও তো বকুল কে ঠকাতে চায়নি; ও তো বকুলের সংসার ভাঙতোনা।তাও কিসের অভিমানে চলে গেল বকুল।
বকুলের সংসার আজ রমার হয়েও পুরোপুরি ওর হলো না। চাওয়া পাওয়ার হিসেবে টা বোধহয় এমনই হয়; মিলেও মেলে না।
রমা সবই আন্দাজ করে;কিন্তু মুখে কিছু বলে না..........!
তারিখ-০৮/০৬/২২
