বাবা মাকে রেখে আসতে সত্যি মন চাইছিল না অরিত্রর। কিন্তু অগত্যা ! অর্থনৈতিক চাপ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে , এছাড়া কোন উপায়ই ছিল না তার। প্রাইভেট ফার্মের চাকরী ! কোনমতে দিন গুজরান ! বাচ্চার খরচ আর স্ত্রী মনিদীপার ফরমাশ মেটাতেই নাজেহাল অবস্থা। তার ওপরে মা - বাবার সঠিক খেয়াল রাখা ! একদিক থেকে ভালোই হয়েছে বলে মনে করছে সে। মাসী - মেসোর গ্রামের পরিত্যক্ত বাড়িটা ভাগ্যিস ছিল ! না হলে যে কি হত ! এইসব ভাবতে ভাবতে রবিবারের দুপুরে চোখটা প্রায় লেগেই গিয়েছিল। হঠাৎ ঘুম ভাঙলো মনিদীপার গলার আওয়াজে। 'দেখো কে এসেছেন !'
'কে এসেছে , বলতে বলতে অরিত্র ডাইনিং রুমে এসে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সামনে এ কি দেখছে ও ! মা - বাবা দুজনেই দাঁড়ানো। এ কি তোমরা এলে কেন মানে কি করে ? কি করে আবার ! ট্রেনে করে। এই বলতে বলতে অরিত্রর মা সোফায় বসেই পড়লেন। শোন্ বাবু , এই বলে অরিত্রর বাবা যেন কি একটা বলতে উদ্যত হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ওর মা শুরু করলেন, দেখ্ বাবু তুই আমাদেরকে যতই বুঝিয়ে দিস্ না কেন, আমরা মানে তোর বাবা আর আমি কিন্তু সঠিক কারণটা ঠিক ধরতে পেরে গেছি। হঠাৎ করে কেন তুই আমাদের তোর মাসীর বাড়িতে রেখে এলি !
সত্যি বলতে গেলে তুই তো আমাদের একমাত্র ছেলে! তোর দরকারে আমরা যদি তোর পাশে না থাকি , তবে কে থাকবে বল ! তাই অনেক ভেবে চিন্তে বাড়িটা বিক্রি করেই দিলাম , বুঝলি ! '
অরিত্র অনেকক্ষণ মা - বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এবার জিজ্ঞেস করেই ফেললো , ' তোমরা ঠিক কী বিষয়ে কথা বলছো মা ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এই কথা শুনে মা - বাবা দুজনেই মিটি মিটি হাসতে থাকলেন ! একটু পরে হাসি থামিয়ে মা-ই প্রথম মুখ খুললেন। বললেন , 'আরে বোকা ছেলে , তুই যে কারণে আমাদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে ছিলিস , সেই কারণটা বুঝতে পেরে আমরা গ্রামের বাড়িটা বিক্রি করে চলে এলাম।'
মা - বাবাকে এখান থেকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার প্ল্যানটা অবশ্য মনিদীপারই ছিল। কিন্তু সেই প্ল্যানটা মা - বাবা কী করে ধরে ফেললো , সেটা ভেবেই অরিত্রর খুব লজ্জা করছিল। সে লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে মাকে বলে উঠলো , 'মা, গ্রামের বাড়িটা তো মাসীর , সেই বাড়িটা তোমরা বিক্রি করলে কিভাবে আর কেনই বা করলে ! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! ওই বাড়ি তো মাসীমনির ! এইবার অরিত্রর বাবা মুখ খুললেন। বললেন, তোর মাসীর বাড়ি হলেও , মাসী মারা যাওয়ার আগে তোর মাকে বাড়িটা লিখে দিয়ে গিয়েছিল। বহুদিন বাড়িটা এমনিই পড়ে ছিল। তোর এই অবস্থার কথা ভেবে তোর মা বাড়িটা বিক্রি করার কথা বললেন। ব্যস , যেমন ভাবা তেমন কাজ ! তোকে বা বৌমাকে জানালে পাছে তোরা আপত্তি তুলিস ! তাই একেবারে কাজ সেরেই এলাম। মার কথা শুনে অরিত্র ও মনিদীপা দুজনে খুবই লজ্জা পেল। ওরা দুজনেই মা - বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল আমাদের ভুল হয়ে গেছে বাবা। আসলে টাকা পয়সার চিন্তায় আমাদের মাথা কাজ করছিল না। তাই আর কী ! ঠিক আছে , ঠিক আছে। শোন্ মা - বাবার কাছে কোন কিছু লুকোতে নেই। মা বাবাই পারে সব দিক থেকে ছেলে - মেয়েকে উদ্ধার করতে। আর আমাদের সব কিছু তো তোদেরই। তোদের দরকারে যদি কাজে না লাগি তো আর কবেই বা লাগব ? '
'যাক একদিক থেকে ভালই হলো, কী বল ? এখন থেকে আমরা সবাই মিলে ঠিক আগের মত একসাথে থাকতে পারব। দাদুভাই, চল আমরা একটু ঘুরে আসি। এই বলে অরিত্রর বাবা নাতি বুবাইকে নিয়ে বেড়াতে বেরোলেন।'
দেখতে দেখতে অরিত্রর ছেলেও এখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। মা - বাবা গত হওয়ার পরে অরিত্র আর মনিদীপা খুবই একলা হয়ে গেছে। মা - বাবা মাথার ওপর ছিলেন , নিশ্চিন্ত থাকা গেছিল , কিন্তু তারপর যা হয় আর কী ! কিছু সমস্যা হলেই তাঁদের কথা মনে হয় ! কিন্তু কী আর করা ! নিজেরাই যখন সেই মা বাবার জায়গায় , তখন সমস্যার সমাধান তো সেই জায়গা থেকেই করতে হবে। সেই কথা মনে করেই তারা চলতে থাকে।
একদিন হঠাৎ বুবাই মানে অরিত্রর ছেলে চাকরী পেয়ে বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে। সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পরে বাড়িতে যখন সে জানালো , তখন অরিত্র ও মনিদীপা খুবই কষ্ট পেল এই ভেবে যে , তারা গোড়া থেকে কিছুই জানতে পারল না! আগে থেকে জানতে পারলে তারা বাধা তো দিত না ! তাহলে বুবাইয়ের এই আচরণ কেন ! এতে তারা একদিকে যেমন কষ্ট পেল , ঠিক তেমনি তাদের মা - বাবার সঙ্গে ঘটানো ঘটনার কথাও মনে পড়ে গেল। তাতে দুজনে খুবই মানসিক যন্ত্রণা পেল। এতে অবশ্য অরিত্র ও মনিদীপা একটা ব্যাপার বেশ বুঝতে পারল যে, তারা তাদের মা - বাবার সাথে যা ঘটিয়েছিল সেটাই তাদের জীবনেও ফিরে এল।
