তাতানের দিদুন : সায়ন্তনী দাস ধর



         "তাতান, মাসির সব কথা শুনবে। একদম দুষ্টুমি করবে না কিন্তু, ঠিক আছে?" মায়ের কথায় বড় করে মাথা হেলায় তাতান, " হ্যাঁ মাম্মা, আমি তো দুষ্টুমি করিই না..." তাতানকে আদর করে সঞ্জনা অফিসে বেরিয়ে যায়। গাড়িতে বসে একটু একটু মনখারাপ লাগে তার। অফিসে উঁচু পদে কর্মরত সে, প্রচণ্ড ব্যস্ততায় তার জীবন কাটে। বাড়িতে বেশী সময় দিতে পারে না, একমাত্র সন্তানকে রেখে যেতে হয় বাইরের লোকের ভরসায়। এই ব্যাপারটাই তার মনে অপরাধবোধের জন্ম দেয়। রাতুল অবশ্য তাকে বোঝায়, " কাম অন বেবি, আজকাল কোন মেয়ে এত  পড়াশোনা করে ঘরে বসে থাকে? তাছাড়া দুজনে মিলে রোজগার করছি বলেই তো তাতানকে পৃথিবীর সেই সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারছি, যা অনেকেই দিতে অপারগ!" ঠিকই সবই দিতে পারছে তারা তাতানকে, শুধু মায়ের সঙ্গ ছাড়া। নিজেকে বোঝায় সঞ্জনা, যতক্ষণ বাড়িতে থাকে অন্ততঃ সেটুকু সময় তো সে চেষ্টা করে তাতানের সঙ্গে সময় কাটানোর। 

         সঞ্জনাদের সামনের অ্যাপার্টমেন্টটা এতদিন খালিই পড়েছিল। সম্প্রতি একজন প্রৌঢ়া ঐ অ্যাপার্টমেন্টে নতুন এসেছেন, বৈশাখীদেবী। অফিসে বেরনোর মুখে দেখা হয়ে গেল ওনার সঙ্গে। ওনাকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সঞ্জনাকেও তাড়াহুড়োর মধ্যেও ভদ্রতার খাতিরে বলতে হয়,"নতুন এসেছেন বুঝি?" 

" হ্যাঁ গো, তোমার ছেলেটি ভারি মিষ্টি। কি নাম ওর?" বৈশাখীদেবীকে গল্পের মেজাজে দেখে মনে মনে প্রমাদ গোনে সঞ্জনা, " তাতান...মাসিমা, আমার অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, পরে আপনার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করব।" 

অস্বস্তিবোধ করেন বৈশাখীদেবী , " এ বাবা, তোমার দেরি করিয়ে দিচ্ছি .... " সঞ্জনা ঝটপট লিফ্টের দিকে এগোয়। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই উচ্ছ্বসিত তাতান ছুটে আসে," মাম্মা, জান, সামনের অ্যাপার্টমেন্টের দিদুন কি ভাল! আমায় চকোলেট দিয়েছে, আমার সঙ্গে খেলেছে...." এরপর থেকে এমনই ঘটতে থাকে। বৈশাখীদেবী রোজই সঞ্জনার অনুপস্থিতিতে তাদের বাড়িতে আসেন, অনেকটা সময় তাতানের সঙ্গে কাটিয়ে যান- খেলেন, ছড়া শেখান, গল্প বলেন, ঠিক এক প্রকৃত 'দিদুন' এর মত। সঞ্জনা ভাবে, যাক, ভালই হয়েছে। তাতান ভাল সঙ্গী পেয়েছে।রবিবার আয়ামাসিকে ছুটি দিয়ে দেয় সঞ্জনা। সেদিন কেবল তারা তিনজন নিজেদের মত করে সময় কাটায়। সঞ্জনা নানারকম রান্না করে, তাতানের সঙ্গে গল্পগাছা, খেলা করে, বেড়াতে নিয়ে যায়। সবে জলখাবার খাওয়া হয়েছে, এমন সময় বেল বাজল। দরজা খুলতেই সামনে বৈশাখীদেবী, "চলে এলাম, তোমাদের সঙ্গে তো ভাল করে আলাপই হয় নি। অবশ্য তাতানের সঙ্গে খুব ভালো পরিচয় হয়ে গেছে।" তাতান তার দিদুনের গলা পেয়ে একছুট্টে চলে এসেছে, "কি মজা, দিদুন এসেছে, কালকের গল্পটা আজ শেষ করবে তো?" 

বৈশাখীদেবী তাতানকে কোলে নিয়ে আদর করেন,"হ্যাঁ সোনা, নিশ্চয়ই। আর আজ তোমাদের জন্য কি এনেছি দেখ। তুমি তো চিলি চিকেন খেতে পছন্দ কর....বানিয়েছি আজ।" 

সঞ্জনা অস্বস্তিতে পড়ে যায়, " এ বাবা! আপনি শুধু শুধু কষ্ট করলেন কেন?" 

বৈশাখীদেবী যেন একটু ক্ষুন্ন হন," না না! কষ্ট হবে কেন? আমি তো একাই থাকি, তোমাদের দেব ভেবে করা। একা একা রাঁধতে ইচ্ছে করে ,বল?" 

সঞ্জনা ভদ্রতাবশতঃ বলে ওঠে," তাহলে আজ আমাদের সঙ্গে দুপুরে একসাথে খাবেন।" 

বৈশাখীদেবী সঙ্গে সঙ্গে রাজিও হয়ে যান," বেশ, তুমি বলছ যখন...." তারপর তাতানের হাত ধরে তার ঘরে চলে যান। সঞ্জনা বোকার মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। রাতুল ছেলের সাথে এতক্ষণ খেলছিল, খেলাটা বন্ধ হয়ে যেতে তার রাগ হয়ে যায়, " কি দরকার ছিল সঞ্জনা, ওনাকে একেবারে দুপুরে নেমন্তন্ন করার?" "আরে! রান্না করে নিয়ে এসেছেন, একা থাকেন, তাই ভদ্রতার খাতিরে বলেছিলাম ...." সঞ্জনারও  বিরক্ত লাগছিল, আবার খারাপও লাগছিল বৈশাখীদেবীর জন্য। সারাদিন উনি তাদের বাড়িতেই কাটালেন সেদিন। দুপুরে একসাথে খেতে বসে বললেন, "কতকাল পরে.... একা নয়, অনেকের সঙ্গে বসে খাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে।" সারা দুপুর তাতানের সঙ্গে সময় কাটালেন, সঞ্জনার সঙ্গে গল্প করলেন। বিকেলে উনি চলে যাবার পর রাতুল বলে উঠল," রাতের খাবারটাও তো খেয়ে যেতে বলতে পারতে!" সঞ্জনা বলে," যাঃ! অমন করে বোলো না.... একা থাকেন তো,  এই বয়সে একটু সাহচর্য চান, আর কি!" এরপর থেকে এমনই হতে থাকে। সারা সপ্তাহ দুপুরবেলায় বৈশাখীদেবী  তাতানের সঙ্গে সময় কাটান, কখনও কখনও ওকে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যান, রান্না করে ওকে খাওয়ান। তাতানের বাড়ির খাবারটা পড়ে থাকে, আয়ামাসি অনুযোগ করে সঞ্জনাকে। তাতানও তার নতুন এই সম্পর্ক পুরোপুরিই উপভোগ করে। দিদুন বলতে সে অজ্ঞান! মায়ের কাছে বায়না করে, "মা, আমি আর আয়ামাসির কাছে থাকব না, দিদুনের কাছে থাকব।" সঞ্জনা বোঝায় তাকে," লোকের বাড়িতে অমন রোজ থাকা উচিত নয়।" তাতান চুপ করে যায়, কিন্তু বোঝা যায়, তার কষ্ট হচ্ছে। সে যে ওনাকে 'বাইরের লোক' বলে ভাবতে পারে না, সত্যি সত্যিই 'দিদুন' ভাবে। ছুটির দিনগুলোতেও উনি এটা সেটা রান্না করে নিয়ে চলে আসেন সঞ্জনাদের অ্যাপার্টমেন্টে। অনেকটা সময় কাটান ওদের সঙ্গে।  মাঝেমাঝে নানারকম ফলও কিনে নিয়ে আসেন; বলেন, " সঞ্জনা, তুমি সারা সপ্তাহ চাকরি কর, এত পরিশ্রম কর, নিজের প্রতি একটু যত্ন নাও। এই ফলগুলো খেও। আর আমি তো বসেই থাকি, অফিস থেকে ফিরে আবার রান্না করতে হয় তোমাকে, আমি রাতের খাবার মাঝেমাঝে দিয়ে যাই?" সঞ্জনা ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে," না না, মাসিমা, কেন? আমি তো করি, কোন অসুবিধা হয় না।" 

         বৈশাখীদেবীর এই আগ বাড়িয়ে সবকিছু করা, সারাক্ষণ তাদের সংসারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা- এসব সঞ্জনা ও রাতুলের কাছে ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে ওঠে। একজন বাইরের মানুষ যদি তাদের সংসারের প্রতিটি ব্যাপারে ঢুকতে চান, তা মেনে নেওয়া কঠিন হয় বৈকি। শেষপর্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্তটা তারা নিয়েই ফেলে। রবিবার এল। বৈশাখীদেবীও কয়েকটি পদ রান্না করে নিয়ে এসে বেল বাজালেন তাদের অ্যাপার্টমেন্টে। সঞ্জনা দরজা খুলতেই একমুখ হাসি নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, "এসে গেলাম।" সঞ্জনা শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল,"মাসিমা, কিছু মনে করবেন না, আপনি রোজ এভাবে রান্না করে আনেন, তাতানকে নিয়ে যান- এসব রাতুলের একদম পছন্দ নয়। আমার বলতে খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু...." 

ওনার মুখ নিমেষে কাল হয়ে গেল। একটাও কথা না বলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে গেলেন। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সঞ্জনা। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না, এতটা খারাপ ব্যবহার সে করতে পারে! নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল, ভাবছিল, একবার গিয়ে বৈশাখীদেবীর অ্যাপার্টমেন্টের বেলটা কি বাজাবে? এমনসময় রাতুল এল," প্রবলেম সলভড্?" 

দরজা বন্ধ করে সঞ্জনা বলল," না গো, খুব খারাপ লাগছে আমার। উনি একা থাকেন, আপনজন কেউ সেরকম নেই, আমাদের ভালবেসে ফেলেছিলেন। আর আমরা এভাবে  ....."

রাতুল বলল," দেখ সঞ্জনা, উনি একা মানুষ, মাঝেমধ্যে গল্পগাছা করতে এলেন, আমরাও গেলাম, বিপদে আপদে পাশে থাকলাম - ঠিক আছে। কিন্তু উনি আমাদের সংসারে নাক গলাচ্ছিলেন, সব ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছিলেন- এটা তো কাম্য নয়, তাই না?" সঞ্জনার মন ঠিক সায় দিতে চায় না যেন। ছুটির দিনটায় কেমন যেন তাল কেটে গেল। 

           পরের সপ্তাহে একদিনও বৈশাখীদেবী  এলেন না সঞ্জনাদের অ্যাপার্টমেন্টে। সঞ্জনার নিজেকে খুব অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। সে ঠিক করল, রবিবার তাতানকে নিয়ে ওনার অ্যাপার্টমেন্টে যাবে। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল ঘটনাটি। অফিস থেকে ফিরতেই আয়ামাসি সঞ্জনার হাতে একটি খাম ধরিয়ে বলল, "উল্টোদিকের মাসিমা তো বাড়ি ছেড়ে  চলে গেল গো, বৌদি। তোমাকে এটা দিতে বলেছে।"

সঞ্জনার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, " কি! কি বলছ! কোথায় চলে গেলেন?" তাড়াতাড়ি খামটা খুলতেই একটি চিঠি: 

স্নেহের সঞ্জনা, 

                    আমারই ভুল। তোমাদের সংসারে একজন বাইরের মানুষ হয়ে জোর করে ঢুকে পড়েছিলাম। কিন্তু কি ই বা করার ছিল আমার? বেশ কয়েক বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় আমার মেয়েকে হারিয়েছিলাম। মেয়ের ইচ্ছে অনুযায়ী দেহদান করি। ঐ একই সময়ে তুমিও নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলে হৃৎপিণ্ডের সমস্যা নিয়ে। আমার মেয়ের হৃৎপিণ্ড তোমার শরীরে প্রতিস্থাপিত হয়। তুমি নতুন জীবন লাভ করলে। মেয়ের শোক সইতে না পেরে তোমার মেসোমশাই কদিনের মধ্যেই আমায় একা ফেলে রেখে এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। আমার বেঁচে থাকার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আত্মহত্যা যে মহা পাপ। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল, আমার মেয়েটা তো তোমার মধ্যে বেঁচে আছে আজও। অনেক খোঁজখবর করে তোমার ঠিকানা জোগাড় করি। তোমাদের উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্ট কিনে নিই। তোমাকে পেয়ে আবার বাঁচার ইচ্ছে ফিরে এল। মনে হত, নিজের মেয়ে, জামাই, নাতিকে নিয়ে আমার ভরা সংসার। তোমায় কোনদিন বলতে পারিনি সবটুকু। পাছে আমায় ভুল বোঝ! কিন্তু তোমরা অনধিকার চর্চা ভেবে আমায় দূরে ঠেলে দিলে। না না, তোমাদের দোষ নেই। আমি তো সত্যিই তোমাদের কেউ নই। আর তোমাদের বিরক্ত করব না। অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। শরীরের যত্ন নিও। ভাল থেকো। ফলটা  খেও কিন্তু , তুমি তো খেতে চাও না। 

                          ইতি ....(কি লিখব বুঝতে পারছি না)

             সঞ্জনা হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। এত বড় ভুল করে ফেলল সে! 

অনেক দূরে একটি বাড়িতে এক সর্বহারা মানুষ বসে আছেন। সামনে পড়ে ঘুমের ওষুধের অনেকগুলো পাতা। মানুষটি বিড়বিড় করছেন," আর বেঁচে থাকতে পারছি না, কার জন্য বেঁচে থাকব?" হঠাৎ বাইরে কচি গলার ডাক," দিদুন, দিদুন ....তুমি কোথায়? দেখ আমরা এসে গেছি ...." সঙ্গে সঙ্গে বেলটা বেজে উঠল অধৈর্যভাবে। তাতানের গলা? অবিশ্বাস নিয়ে বৈশাখীদেবী ছুটে গেলেন। দরজা খুলতেই তাতান ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর কোলে। সঞ্জনাও জড়িয়ে ধরল তাঁকে," তুমি যে আমার আরেক মা। আমি তোমার মেয়ে। কিচ্ছুটি না বলে এভাবে কেন চলে এলে? কত কষ্টে তোমাকে খুঁজে পেলাম। এবার থেকে তুমি আমাদের সাথেই থাকবে।" বৈশাখীদেবী মেয়ে ও নাতিকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। এত সুখও তাঁর কপালে ছিল!

Post a Comment

Previous Post Next Post