যুগের হাওয়া : ঈশিতা ভট্টাচার্য



             সত্যিই  নীপার বিয়েটা হয়ে গেলেই বাঁচি ! যা শুরু করেছে না মেয়েটা ! সবাই একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে ! কি সুন্দর ছিল না মেয়েটা ছেলেবেলায় ! শান্তশিষ্ট , অমায়িক ! সেই মেয়েটা যে  বড় হয়ে এরকম আচরণ করবে , কেউ কি ভেবেছিল ! 

      মা - বাবা আর ছোট ভাইকে নিয়ে সুন্দর সংসার নীপাদের ! বাবা সরকারী কর্মচারী। ছোট ভাই  ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। খুবই ছাপোষা পরিবার। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার পেছনে বেশ ভালই খরচা হয়েছে অনিমেশবাবুর। রিটায়ার - এরও  সময়  এসে গেছে । তাই ভাবলেন তার আগে যদি মেয়েটার বিয়েটা দিতে পারেন ! যেমন ভাবা তেমন কাজ ! নীপা এম এ পাশ করে বসে ছিল চাকরি পাবার আশায়। পাত্র যোগ্যতায় এক হলেও, সে  টিচার। এই পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও নীপার স্বার্থপর স্বভাব বাবা - মার মনে অজানা আতঙ্কের সৃষ্টি করল।

              আসলে ছাপোষা অনিমেশবাবু ভেবেছিলেন নিজেই  যখন পছন্দসই পাত্র ঠিক করেছেন , তখন বিয়ের আয়োজনও নিজের ইচ্ছাতেই করবেন। কিন্তু তার ক্যালকুলেশন এ গোলমাল ছিল , তাই তো মেয়ে সাফ জানিয়ে দিল যে বিয়ের ব্যাপারে " আমার কথাই শেষ কথা"। বাবার অবস্থা জেনেও  কেনাকাটায় কোন কার্পণ্য করা চলবে না বলেও মেয়ে জানিয়ে দিল। এই শুনে অনিমেশবাবু ও তার স্ত্রী সুলেখাদেবী মনে মনে খুবই কষ্ট পান ।  কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলেন  না!  হাজার হোক নিজের মেয়ে বলে কথা ! কিন্তু সহ্যও তো আর হয় না ! কী আর করা!  তাই তো বিয়ের শাড়ী কিনতে দোকানে  নীপা ও তার বাবা - মা গিয়ে  নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কাপড় দেখাতে বললে বাবার কথায় অসম্মতি জানিয়ে  বহুমূল্যের কাপড় দেখাতে বাধ্য করে।  মা-ও মেয়ের আচরণে অবাক হয়ে যায়। নিজের বাবার অবস্থা না বুঝেই নীপা এরকম অন্যায় আব্দার  করায় তারা খুবই  ভেঙ্গে পড়েন। তারা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও সে একেবারে অনড় থাকে নিজের সিদ্ধান্তে। তাহলে কি মেয়েকে কোন শিক্ষাই দিতে পারেননি বাবা - মা হিসেবে ! এই কথাই তাদের মাথায় ঘুরপাক খেতে  থাকে ! 

     একটা সময় ছিল যখন দুটি অজানা এবং অচেনা পরিবার এই বিবাহের মধ্য  দিয়ে একসাথে পথ চলার অঙ্গীকার  করত। তাতে না থাকত আড়ম্বর , না থাকত স্বাধীনতা ! বিয়ের পাত্র বা পাত্রী কেউই নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারত না। বিয়ের আয়োজনে তাদের যোগদানের তো কোন প্রশ্নই ওঠে  না। সেই জায়গা থেকে সরে এসে আজ সবাই এতটাই স্বাধীন হয়েছে যে , পাত্র - পাত্রী নির্বাচন থেকে শুরু করে বিয়ের কেনাকাটা সবেতেই বাবা - মার ভূমিকাকে আমরা অস্বীকারের জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছি।  সবেতেই যখন আমরা স্বাধীন , তাহলে বাবা - মার অবস্থানকেই বা কেন আমরা অগ্রাধিকার দেব ?  নিজেদের জীবন উপভোগ করার নেশায় সবাই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে।  বাবা - মা সহ বড়দের  প্রাপ্য মূল্য দিতে তারা ভুলে যাচ্ছে। আসলে আমরা আমাদের গুরুজনদের ভূমিকাকে নস্যাৎ করে দিয়ে "নিজেরা নিজেদেরটা  ঠিকই বুঝব " এই ব্যাপারটাকে সবসময় প্রাধান্য দিতে চাইছি। তাতে বাবা - মার মনের অবস্থা কি হয় , 'সেটা বোঝার আমাদের অন্তত কোন দায় নেই।' 'গুরুজনদের আশীর্বাদ নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার বদলে আমরা  তাদের কাঁদিয়ে জীবন শুরু করতে চলেছি। ছোট থেকে একটু একটু করে আমাদের  বড় করার পিছনে যাদেরকে কোনভাবেই আমরা অস্বীকার করতে পারিনা , সেই মানুষদুটির অপরাধ কোথায় ? সন্তান মানুষ করার পিছনে তাদের তো একটাই স্বার্থ , তা হল তাদের শিক্ষা পেয়ে ছেলে - মেয়েরা যেন সুখে থাকে , ভাল থাকে ! তার জন্য তারা নিজেদের সব শখ - আল্হাদ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে রাজী থাকে । সেই সন্তান যদি নিজের জীবন শুরু করতে গিয়ে নিজের বাবা - মা কেই অস্বীকার করে , তবে তো কিছু বলার ই থাকে না।'

Post a Comment

Previous Post Next Post