পাত্র চাই : সায়ন্তন গাঙ্গুলী


 


অনিমেষবাবু বছর চল্লিশেক বয়স, সামান্য একটি সরকারি চাকরি করেন। তবে তাই বলে সংসারে অভাব অভিযোগ কিছু নেই। কারণ অভিযোগ করার লোক-ই নেই। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন আর বছর দশেক হলো বাবাকে। ভাই, বোন, কাকা জ্যাঠা কেউই নেই। এখনো পর্যন্ত অবিবাহিত। বাবা মারা যাবার পর দেশের জমিজমা সব বিক্রি করে বিস্তর টাকা ব্যাঙ্কে জমা আছে। তাই অনিমেষবাবুর থাকা খাওয়ার কোনো চিন্তাই নেই। সময় কাটানোর জন্য চাকরিটা করেন, না করলেও কোনো অসুবিধা নেই। 


বাড়িতে অনিমেষবাবু ছাড়া আর আছে বাবার আমলের কাজের লোক জগা কাকা। অনিমেষবাবুর মা মারা যাবার পর বাবা সংসারের প্রতি একেবারেই অনাসক্ত হয়ে পড়েন। এই জগা কাকাই অনিমেষবাবুকে কোলে পিঠে করে মানুষ করে। এই জগা কাকাই এক প্রকার অনিমেষ বাবুর অভিভাবক। 


ফাল্গুন মাসের রবিবারের সকাল, একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছেন। প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে বারান্দায় বসেছেন সকালের চা নিয়ে। জগা কাকা চায়ের সাথে খবর কাগজটাও রেখে গেছে টেবিলে। মেরী বিস্কুট-টা চায়ে ডুবিয়ে দু কামড়ে মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে কাগজটা টেবিল থেকে তুলে চোখের সামনে মেলে ধরতেই একটা গোলাপি রঙের লিফলেট কাগজের ভিতর থেকে বেরিয়ে কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতন হাওয়ায় দোল খেতে খেতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। 

অনিমেষবাবু মুখের সামনে থেকে কাগজটা সরিয়ে মেঝের দিকে তাকাতে দেখলেন গোলাপি রঙের একটি সস্তা মামুলি লিফলেট, কালো কালিতে ছোট ছোট করে ছ'সাত লাইন কিছু লেখা। 


অনিমেষবাবুর এসব ব্যাপারে কোনো উৎসাহ নেই।। নিশ্চয়ই কোনো টিউসানির বিজ্ঞাপন, নয়তো বাড়ি ভাড়া অথবা কোনো আয়ুর্বেদিক আশ্চর্য মলম। মুখ তুলে আবার কাগজে মনোনিবেশ করতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো একেবারে ওপরে মোটা ও বড় হরফে গোটা গোটা করে লেখা

*পাত্র চাই*। 


অনিমেষবাবুর সারা শরীরে কেমন একটা ঝিলিক মেরে উঠলো। অভিভাবক সেভাবে কেউ না থাকায় অনিমেষবাবু আজও চিরকুমার ক্লাবের সদস্য। তবে বয়স চল্লিশের কোঠায় হলেও বিয়ের বয়স এখনো চলে যায়নি। অনেকেই আছে যারা এই বয়সে অথবা এর থেকেও বেশি বয়সেও বিয়ে-থা করে ঘোর সংসারী। 

অফিস থেকে ফিরে সেই একঘেয়ে টিভি দেখা নয়তো জগাকাকার বকবকানি। কাজ থেকে ফিরে প্রিয় মানুষটির সাথে কিছু গল্পগুজব, মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখা। কিছু অন্যরকম খাবারের আবদার করা। পাড়ার রোল সেন্টার থেকে কিছু খাবার আনিয়ে ভাগ করে খাওয়া। আর যদি অবিবাহিত ছোট শালি থাকে তাহলে তো কথাই নেই। ক্রমে ক্রমে বাড়িটাও ভরে উঠবে। খালি খালি দোতলা বাড়িটা মাঝে মধ্যে যেন গিলে খায়। বাড়িটা শান্ত নিস্তব্ধ তবে সেটা যেন শ্মশানের শান্তি শ্মশানের নিস্তব্ধতা। 


কাগজে লিফলেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে যখন পাত্র চাইছে, তখন মনে হয় পাত্রী হয় বয়স্ক নয়তো ডিভোর্সি। অবশ্য অনিমেষবাবুর তাতে আপত্তি নেই। অনিমেষবাবু নিজেও তো বয়স্ক, আর আহামরি এমন কিছু রাজপুত্তুর পাত্র তো নন যে হাজারটা ওজর আপত্তি থাকবে। একজন সহচরী, সহধর্মিনী হলেই হবে। 


এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তেই কেমন যেন পুলকিত হয়ে উঠলেন। আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলেন কে জানে, অবশ্য মুখ বলতে তো দু'টোই। হয় আয়নায় নিজের মুখ নয়তো জগাকাকার মুখ। 

চায়ে আর একটা লম্বা চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে হাতে ধরা কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলে রেখে ঝুঁকে মেঝে থেকে লিফলেট টা তুললেন। ছোট একটা লিফলেট, আনুমানিক ছয় ইঞ্চি বাই দশ ইঞ্চির হবে। নিচের দিকে এক ভদ্র লোকের নাম ও ঠিকানা লেখা। নিশ্চয়ই পাত্রীর বাবা বা পিতৃস্থানীয় কোনো অভিভাবকের নাম ও ঠিকানা।


একদম ওপরে মোটা হরফে লেখা *"পাত্র চাই"*। হাত দিয়ে কপালে পড়া চুলগুলো সরিয়ে ছোট হরফে লেখা ভিতরের কন্টেন্ট-টা পড়তে শুরু করলেন। ভদ্রলোক লিখেছেন... 

_"সবিনয় নিবেদন, আগামী বৃহস্পতিবার দোলপূর্ণিমার দিন আমার বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজার আয়োজন করেছি। আশা করছি প্রায় জনা একশো লোকের সমাগম হবে। সিন্নী হবে, কিন্তু অতটা সিন্নী মাখার কোনো বাসন আমার নেই। ডেকরেটারের কাছ থেকে নিতে ইচ্ছুক নই। কারণ তাদের কাছে আমিষ নিরামিষের কোনো ভেদাভেদ নাই। তাই যদি কোনো সহৃদয় ব্যাক্তির কাছে সিন্নী মাখিবার বড় পাত্র থাকে...."_ 


অনিমেষ বাবুর পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত চিড়বিড় করে উঠলো। রাগের চোটে কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে টেবিলের কোনায় লেগে পড়লো গিয়ে চায়ের কাপে। কিছুটা চা ছলকে এসে পড়লো পাঞ্জাবি টায়। 


রবিবারের সকালের চা-টাই খাওয়া হলো না।


(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Surajit Naba Dutta)

Post a Comment

Previous Post Next Post