বাহ্যিক : ঈশিতা ভট্টাচার্য

 


     " কি রে লেখাটা শেষ করলি ? " মঙ্কার মা-র এই গলার আওয়াজে আশেপাশের সবাই এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও  মঙ্কার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা। ও কিন্তু ওর  মার এই আওয়াজটা না পেলে  আবার ঠিক নড়াচড়া করতে পারে না। " আদো আদো গলায় মঙ্কা বলে ওঠে একতু বাকি আছে মা ! এখনও বাকি ! আর কতক্ষন ! দাঁড়া আমি আসছি ! " এই বলে পৃথা রান্নাঘর থেকে এক দৌঁড়ে মঙ্কার কাছে পৌঁছে যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল মঙ্কা নার্সারীতে পড়ে আর তার মা পৃথা পেশায় আর্কিটেক্ট। সারাদিন মেয়েকে একেবারেই সময় দিতে পারে না । তার জন্য রাতে ফিরে এসে সে  চিল চিৎকার জুড়ে দিয়ে, সারা পাড়াকে মাথায়  করে মেয়েকে সময় দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। মেয়েকে সব থেকে বেশি আদরই  বল আর প্রশ্রয়ই বল পৃথাই দেয়। ওর বর তন্ময় আছে ব্যাংকে। সময়ের দৌড়ে সেও পৃথার কাছাকাছিই প্রায়। দুজনের কাউকেই বেশি সময় কাছে পায় না বলেই মঙ্কা দিন দিন এত জেদী আর একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছে।

      মা হিসেবে পৃথা মনে করে যে, মেয়েকে কথায় কথায় দামী দামী জিনিস কিনে দিলেই বুঝি মায়ের ভূমিকা শেষ। দেওয়া - নেওয়ার বাইরেও যে একটা বিরাট কর্তব্য মায়ের  আছে , সেটা সে বুঝতেই চায়না ! তাই তো সেদিন পৃথার মা যখন এ বিষয়টা নিয়ে কথা বললেন ,  তখন পৃথা প্রচন্ডভাবে আপত্তি তুলেছিল!  "ওর বক্তব্য , মঙ্কার  যখন যা দরকার , সবই তো ও দেওয়ার চেষ্টা করছে , তাহলে মা হিসেবে ও কি কোনোভাবে মেয়েকে অবহেলা  করছে !" পৃথার মার কথা অনুযায়ী , শুধু জিনিস কিনে  দিলেই  মায়ের দায়িত্ব পালন হয় না, সবসময় পাশে থেকে সব প্রয়োজন মেটানো , যাকে সোজা ভাষায় মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট বলে, সেটাই  হল মায়ের উপযুক্ত ভূমিকা। যা আজকের দিনে পুরোটা সম্ভব না হলেও যতটা সম্ভব আর কী !

          কিন্তু মুশকিল হল এখনকার নতুন মায়েরা যারা আবার বাইরের জগতের সঙ্গে যুক্ত তারা এই তত্ত্ব মানতে রাজী নয়। তাদের কথায় বাচ্চার পাশে থেকে সময় না দিলেও কোনকিছুর অভাব তো রাখা হয় না! তাহলে বাচ্চার  প্রতি অবহেলা হচ্ছে কি করে ? এই যে মঙ্কা দিন দিন জেদী , একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছে , এর কারণ যে ওই একটাই! তার প্রতি মা - বাবার অবহেলার  প্রতিবাদ স্বরূপ ক্ষোভ দেখানো। অনেক বাচ্চাই অনেক রকমভাবে এই ক্ষোভ প্রদর্শন করে। তখন মায়েরা মারধর করে, শাসন করে। এতে বাচ্চা আরও জেদী হয়ে ওঠে। অনেকক্ষেত্রে বাচ্চার মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণও ফুটে ওঠে। 

         বাচ্চার কাছে জিনিসের থেকে মায়ের ভালবাসা, মাকে বেশি সময় কাছে পাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চারা এতকিছু বোঝেনা , সে শুধু বোঝে তার মা তার পাশে কতক্ষন থাকছে ! জিনিস পেতে কার না ভাল লাগে কিন্তু বাচ্চা তার সাথে তার মাকেও  বেশি সময় কাছে পেতে চায় !  হাত বাড়ালেই যেন মাকে পায় ! এই হল শিশুর চাহিদা। কারণ একটি  শিশু মনে করে তার কাছে তার মার থেকে আপন আর কেউ হতেই পারে না। এটা শিশু মনোবিশেষজ্ঞদের  মত। কারণ বাচ্চা জন্মের পরে তার মাকেই আগে চেনে এবং ভালভাবে চেনে। শুধু তাই নয় , সে মায়ের চোখ দিয়ে , মায়ের হাত ধরে বাকি পৃথিবী চিনে নেয়। এটাই নিয়ম। শিশু এই নিয়মের বাইরে যেতেই  চায় না। 

      মায়েদের নিজেদের কাজের বাইরের  পুরো সময়টা বাচ্চার জন্য বরাদ্দ রাখতেই  হবে। যতদিন না পর্যন্ত বাচ্চা মায়েদের কাজের বিষয়টা সম্বন্ধে অভ্যস্ত হতে পারছে , ততদিন মায়েদের একটু কষ্ট করে সময় বের করে বাচ্চাকে দিতে হবে। তবে আরেকটা কথাও ঠিক , মায়েদের এই ওয়ার্ক কালচার বাচ্চাদের ছোট থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মনোভাব তৈরি করে। কারণ যাই হোক না কেন , বাচ্চা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার মাকেই অনুসরণ করে। তাই প্রত্যেক মাকে নিজের বাচ্চার স্বার্থে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে বাচ্চার মধ্যে সেই শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। প্রত্যেক মা-ই  যেন তার বাচ্চার কাছে আদর্শ স্থাপন করতে পারে। এটাই হবে সঠিক মায়েদের ভূমিকা।  নিজেদের বাচ্চার স্বার্থেই বাহ্যিক দিক থেকে তো বটেই অভ্যন্তরীণ ভাবেও মায়েদের তাদের  মনের কাছাকাছি থাকতেই হবে ! ' মা ' সে তো সবার আগে 'নারী' , সে পারেনা , এমন কাজই নেই ! ইচ্ছে করলেই সে সব পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post