" ও তপনদা একটা চা দাও তো ! এই বলে বিবেক একটা হাঁক দিল। আরে কি খবর বল প্রতীকদা ? কবে এলে ? এই তো পরশু রাতে। বৌদি , টিনা ওরাও এসেছে তো ? আরে , হ্যাঁ হ্যাঁ সবাই এসেছে। না এসে উপায় আছে ! কেন গো জেঠিমার শরীর ঠিক আছে তো ! হ্যাঁ হ্যাঁ , সব ঠিক আছে। তাহলে ! আসলে সারা পৃথিবীতে যা শুরু হয়েছে , মা তো চিন্তায় অস্থির ! তাই ভাবলাম যে, মা-র অস্থিরতা না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরেই আসি। আর যাই বলিস না কেন, আমি ওই সবার মত কেরিয়ারের পিছনে দৌঁড়াই না। তখন ভাল সুযোগ পেয়েছিলাম। দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। এখন এখানেই কিছু জুটিয়ে নেব ! কি বলিস ! আরে নিশ্চয়ই । তোমার ডিগ্রী আছে , বিদেশে এতদিনের কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে , সবই কি বৃথা নাকি ! যাই বল আর তাই বল, জেঠিমাকে তো তোমাকেই দেখতে হবে ! কতদিন আর একা একা থাকবে বল ? না না এটা তুমি একদম ঠিক করেছ !"
দুজনের এই আলাপচারিতার মাঝেই এল যুদ্ধের প্রসঙ্গ। হঠাৎই বিবেক বলে উঠল " আচ্ছা
প্রতীকদা এই যুদ্ধের কি কোন দরকার ছিল ? এই, এই, তুই একটা দামী কথা জিজ্ঞেস করেছিস ! আসলে কি বলতো আমরা বড্ড বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজেদের জাহির করতে শুরু করেছি। সবসময় আমাদের মাথায় একটা কথাই ঘোরে। আর সেটা হল, ' আমিই ' শ্রেষ্ঠ ! আর সেটার প্রমাণ দিতে গিয়েই এই যুদ্ধ। তাতে কার কি ক্ষতি হল , কত মানুষ চলে গেল , এইসব কিছু কারোর মাথায়ই আসে না। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা নিজেকে জাহির কর ! একেই মারাত্মক এই ভাইরাস গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যাকে অর্ধেক করে দিয়েছে প্রায়! তার মধ্যে আবার যুদ্ধ ! আচ্ছা একটা কথা বল, গত দু বছর ধরে আমরা যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছি , সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সবাই সবার পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে মানুষকে বিপদে ঠেলে দেওয়ার এই যে জঘন্য মানসিকতা , সত্যিই একে ধিক্কার জানাই ! আমার একেক সময় কি মনে হয় বলতো , আচ্ছা আমরা মনুষ্যজাতি নিজেদের বিরাট উন্নত বলে যে মনে করি , কথাটা কি ঠিক ? আমার মত বলব প্রতীকদা ? অবলা যে জীব জন্তুগুলো আছে , তারা আমাদের থেকে অনেক উন্নত ! তারা আর যাই হোক নিজেদের ক্ষিধে মেটানো ছাড়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল জন্তুদের ওপর আক্রমণ করে না। এমনও দেখা যায় যে সবল এবং দুর্বল সকলেই একসঙ্গে ঘোরাফেরা করে এবং একজনের বিপদে সবাই মিলে ঝাঁপিয়েও পড়ে। কিন্তু আমাদেরকে দেখো , রাস্তায় কেউ বিপদে পড়লে বা অসুস্থ হলে আমরা দেখেও না দেখার ভান করি। বিপদে সাহায্য করা তো দূরে থাক ! আমরা এমনই উন্নত যে , আমাদেরকে একত্রিত করার জন্য ধরাধামে আবির্ভূত হলেন মা দুর্গার পরিবর্তে মারাত্মক ' করোনা '। কিন্তু তাতেও আমাদের চৈতন্য হল না। আমাদের মাথায় ঘুরছে সেই ধ্বংসের পরিকল্পনা ! তাই তো একটু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই আমরা যুদ্ধে মেতে গেলাম ! আসলে কি বলতো বিবেক , আমরা মানুষেরা এত উন্নত বলে নিজেদের মনে করি যে, আমরা যখন - তখন যা খুশি করতে পারি ! আমরা কারোর সাথে ছলনা করতে পারি , প্রতারণা করতে পারি , আমরা কাউকে ঠকাতে পারি , অন্যকে পড়ে যেতে দেখে হা-হা করে হেসে উঠতে পারি এবং সর্বোপরি কারণে - অকারণে যুদ্ধ ঘোষণা করে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারি। "
"একেক সময় কি মনে হয় বলোতো প্রতীকদা, মানুষ না হয়ে যদি পশু হতে পারতাম , তাহলে বেশ হত ! অনেকে আবার কি বলোতো , কেউ অমানবিক আচরণ করলে তাকে পশু বলে সম্বোধন করে ! আরে বাবা নিজেরা কি ! তার ঠিক নেই , পাশের লোককে পশু বলা ! কি বলবি বল ! কিছু বলার নেই। সব কিছু শুধু দেখতে থাকো আর উন্নত হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ কর ! ছোটবেলায় রচনা লিখতে গিয়ে প্রথমেই লিখতাম , মানুষ হল এক উন্নত ও বুদ্ধিমান প্রাণী ! আর এখন লিখতে হবে মানুষ হল এক নির্বোধ ও অনুন্নত প্রাণী ! ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় , আদিম যুগে মানুষ বন্য প্রাণী থেকে যখন আস্তে আস্তে মানুষে উন্নত হচ্ছে , তখন বিভিন্ন ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে মারপিট করত। কোনো কিছুর ভাগাভাগি নিয়ে চরম জায়গায় পৌঁছাত। আমরা সেই জায়গা থেকে নিজেদের চেষ্টায় নিজেরা নিজেদেরকে অনেক উন্নত জায়গায় নিয়ে গেছি। কিন্তু ভয় একটাই আমরা আবার আদিম যুগে ফিরে যাব না তো ? "