রঙ্গনের গুঞ্জা : সায়ন্তনী দাস ধর



           রোজ দেখতে পাই মেয়েটিকে- নিজের মনে কখনও গাইছে, কখনও নাচছে, কখনও বা আনমনে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে। কখনও কখনও লিখতেও দেখি। পেনটা মাঝেমধ্যে দুই ঠোঁটের মাঝে রেখে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় ঐ নীল আকাশের গহনে। আর তখন .....তখনই আমার বুকে ঝড়! জানি না, ও কে! কোনদিন দেখিনি ওকে এর আগে! সরকার-বাড়িতে এই প্রথম দেখলাম। খুব ইচ্ছে করে, ওর কাছে যাই, আলাপ করি, কিন্তু .....আমার আঠেরো বছরের হৃদয় সাহস সঞ্চয় করতে পারে না। 

           আমাদের এই পাহাড়ি অঞ্চলে খুব বেশি লোকজন থাকে না। মোটামুটি সবাইকেই চিনি। ওর পরিচয় জানার জন্য মন আমার ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সুযোগ এসে গেল হঠাৎই। সেদিন বিকেলে গিয়েছিলাম পাগলা ঝোরায়। এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। পাহাড়ি জঙ্গলের মাঝে ঝর্ণাটি কুলকুল শব্দে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে বয়ে চলে। প্রায়ই চলে আসি এখানে। সেদিনও গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে পৌঁছতেই আমার হৃদস্পন্দন এক মূহুর্তের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মেয়েটি একটি পাথরের উপর বসে, পা দুখানি ঝোরার জলের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত। মনে হচ্ছিল সময় যেন থমকে গেছে অনন্তকালের জন্য। মেয়েটি যেন নিছক সাধারণ মেয়ে নয়, প্রকৃতিকন্যা। কি এক ঘোরের মধ্যে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। এমনসময় মেয়েটির চোখ পড়ল আমার উপর। চমকে উঠল সে, কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে, " ওহ্, তুমি! আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তা, তুমি রোজ এখানে আস বুঝি?" 

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, " আমায় চেন তুমি?"

মেয়েটি: "হ্যাঁ, তোমাকে তো রোজই দেখি, আমার দিকে অপলকে চেয়ে থাক।"

আমি: " তু....তুমি ....মানে না....আ....আমি...দেখি না।" ভয়ে লজ্জায় ঘেমে যাচ্ছিলাম, আমি যে ধরা পড়ে গিয়েছি!

মেয়েটি: " বাব্বাঃ! তুমি তো দেখছি ভারি লাজুক। পাহাড়ি ছেলেরা এমন হয় বুঝি?"

আমি মনে মনে বলি, পাহাড়ি ছেলেরা এই ঝোরাটার মতোই পাগল হয়। কাউকে ভালবাসলে তাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায় এমনভাবে .....কিন্তু তুমি কি তখন আমার সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে?

কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারি না আমি। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। যা কথা বলার, আমার হয়ে আমার চোখই বোধহয় বলছিল! মেয়েটি সেই তীব্রতায় যেন লজ্জা পেল, তাড়াতাড়ি বলে উঠল," আমার নাম গুঞ্জা। আমি দিদির শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছি। তোমাকে দেখেছি আমি রোজই। একা একা থাক, তোমার বন্ধু নেই?"

আমি: " না, আমার তেমন কোন বন্ধু নেই। একা থাকতেই ভালবাসি। আমার নাম রঙ্গন।"

             ব্যাস্, এভাবেই শুরু হল আমাদের বন্ধুত্ব। আমরা দুজনেই আলাদা আলাদাভাবে এই পাগলা ঝোরার কাছে চলে আসতাম। কবে যে বন্ধু থেকে আরও গভীর সম্পর্কে দুজনেই জড়িয়ে গেলাম, বুঝতেই পারিনি! সাক্ষী রইল ঐ পাহাড়, ঝর্ণা আর জঙ্গল। সারাদিন ধরে অপেক্ষা করতাম কখন বিকেল হবে! কখন গুঞ্জাকে কাছে পাব! কেটে গেল অনেকগুলো দিন। একদিন দেখলাম, গুঞ্জা চুপচাপ। অন্যান্য দিন কত কথা বলে! " কি হল, গুঞ্জা? আজ কথা বলবে না?" দেখি, আমার গুঞ্জার মায়াবী চোখে জল টলটল করছে। হঠাৎ গুঞ্জা জড়িয়ে ধরল আমায়, "কাল যে আমায় চলে যেতে হবে, গো। তোমাকে ছেড়ে কি করে থাকব আমি! তুমিও শহরে চল। ওখানে পড়াশোনা করবে।" আমি আদরে ভালবাসায় অনেক কষ্টে শান্ত করলাম ওকে," তা কি করে হয়, গুঞ্জা? এ পাহাড় ছেড়ে যে আমার যাওয়ার কোন উপায় নেই।"

গুঞ্জা কাঁদতে কাঁদতে বলল," কেন কেন? তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? নিষ্ঠুর তুমি..."

আমি: "কেঁদো না, গুঞ্জা। তুমি বোঝো না, তোমার চোখের জল আমায় কতটা অসহায় করে তোলে? আমার বুকের ভেতরে কতটা যন্ত্রণা হয়? আমার উপায় নেই, গুঞ্জা। নইলে কি তোমায় ছেড়ে আমি ...." 

গুঞ্জা: "তাহলে কেন আমায় একা পাঠিয়ে দিচ্ছ?"

আমি:" কারণ আমার অধিকার নেই এই পাহাড় ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার। আমি যে....."

গুঞ্জা: " বল, বল, তুমি....? কেন যেতে পারবে না?"

 আমি:" আমার সোনা গুঞ্জা, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না, লক্ষ্মীটি। আমি আর কিছু বলতে পারব না। কিন্তু আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, এখানেই সারা জীবন অপেক্ষা করব আমি তোমার জন্য। তুমি তো আসবে মাঝেমাঝে এখানে, তাই না?"

     আর কিছু না বলে গুঞ্জা আমার বুকে মাথা রাখে। আমি ভাল করে জড়িয়ে ধরি ওকে। কিছুতেই চোখের জলটা আটকাতে পারছি না। ওকে যে কিছুই বলতে পারলাম না, আমি যে এ জগতের কেউ নই। কয়েক বছর আগে এক গভীর রাতে পাহাড়ি ধসে আমার বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। পরিবারের লোকেদের সাথে আমিও যে বাড়িতে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলাম সে রাতে!

Post a Comment

Previous Post Next Post