ফজরের নামাজ সবে শেষ হয়েছে। নিয়ামত মিঞা মসজিদের বাইরে পা রাখতেই একটা বিকট শব্দ ও অস্ফুট আর্তনাদে চমকে উঠল।
"ইয়া আল্লা কী সর্বোনাশ হইল গো। ও চাচা, ও ভাইসব চলেন দেখি আগায়ে।"
"মা, জন্মদিনে পায়েস রাঁধবে না। ও মা, মাগো।" ধুচমুচ করে ওঠে মল্লিকা। ছেলেটা নিজেমুখে পায়েস খেতে চেয়েছে। আর অভিমান নেই। রান্নাঘরে গিয়ে শুধু পায়েস নয়। সবরকম আয়োজন করতে থাকে সে।
এখনও ভোরের আলো ফোটে নি। অমল সব দেখে শুনেও কিছু বলল না। করুক এই একটা দিনই তো সে স্বাভাবিক থাকে। কুড়ি বছর ধরে মল্লিকাকে সামলানোর সাথে সাথে ঘরকন্নার সব কাজই তো করছে সে।
খবরটা সেদিন বাজারে গিয়েই শুনেছিল অমল। একটি পিকনিক বাস ফেরার পথে নাকি কুয়াশার অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে পদ্মায় পড়ে যায়। শুনেই আঁতকে ওঠে। টুকুল তো...
কাল তাদের শত বারণ সত্ত্বেও টুকুল পিকনিকে বেরিয়ে যায়। মল্লিকারও একদম ইচ্ছে ছিল না। "যাসনে বাবা। কাল যে তোর জন্মদিন।"
"তো কী হয়েছে আমি তো রাতের মধ্যেই ফিরে আসব। সবাই যাচ্ছে! তোমাদেরই শুধু দুঃশ্চিন্তা।" শোনেনি।
বাজারের ব্যাগ ফেলে পড়িমরি করে ছুটে গিয়েছিল অকুস্থলে।
"ওই একটা... দুটো... তিনটি... ঐ যে আরও আছে..." নিয়ামতরা রুদ্ধশ্বাসে গুনতে থাকে। পদ্মার পাড়ে অসংখ্য লোকের ভয়ার্ত ও উৎসুক মুখ পেরিয়ে অমল যখন এগিয়ে যায়, শোনে কয়েকজনকে প্রথমদিকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গেলেও পরে আর...
সে ছুটে হসপিটালে যায়। তারপর আবার পদ্মাপাড়ে। কিন্তু দুদিন ধরে ডুবুরিরা তল্লাশি চালিয়ে আরও অনেক মৃতদেহ উদ্ধার করলেও টুকুলকে পাওয়া যায় নি। কোথায় ভেসে গিয়েছে!
আশায় বুক বাঁধে ওরা। টুকুল ঠিক ফিরে আসবে। মল্লিকা ভাবে, ভোরের স্বপ্ন কি মিথ্যে হবে।
অমল এখন আশা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু মল্লিকা! ওতো নিজের মধ্যেই নেই। আজও টুকুলের জন্মদিনে পায়েস রেঁধে অপেক্ষা করে।
অমল আজ একটু দেরি করেই উঠল। প্রতিবছর এই দিনটিতে মল্লিকা খুব চেঁচামেচি করে। তাই আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখে।
"এটা নেই ওটা নেই। ছেলেটাকে যে জন্মদিনে একটু ভালমন্দ রেঁধে খাওয়াবো তার উপায় নেই। তুমি বাবা! এতটুকু দায়িত্ব যদি থাকে।"
অমল হাসে। দায়িত্ব! তার মতো দায়িত্ব কে কবে পালন করেছে?
প্রথম দিকে অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছিলো মল্লিকাকে। ডাক্তার বললেন," একটা বাচ্চা নিয়ে নিন। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
এই বয়সে সেটা সম্ভব! তাছাড়া মল্লিকার শরীরের যা অবস্থা। তাই অনাথ আশ্রম থেকে ছোট্ট টুবাইকে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু মল্লিকা মেনে নিতে পারল না। "কে ও? ও তো আমার টুকুল নয়।"
অগত্যা তাকেই সবকিছু সামাল দিতে হয়েছে।
বিছানা ছেড়ে বাইরে এল অমল। বেশ ঝলমলিয়ে রোদ উঠেছে। রান্নাঘরের দিকে যেতেই সে অবাক হয়ে গেল। একী দেখছে!
টুবাইকে সামনে বসিয়ে মল্লিকা আদর করে খাওয়াচ্ছে। মুখে তার ঝলমলে হাসি।
আজ অনেকদিন পর হাসতে দেখল মল্লিকাকে। অমলকে দেখে সে বলল,"ওগো, তোমাকে বলেছিলাম না? ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়! দেখো সত্যিই আজ টুকুল এসেছে।"