বাড়িটা বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছিল সৌম্য। যবে থেকে এই বাড়িটার খোঁজ পেয়েছে, কেন জানিনা একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছে সে। কেন যে এমনটা হচ্ছে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। চারিদিকটা ঘুরে ঘুরে মনে হচ্ছে, কল্পনায় যেমনটা ভেবেছিল সবটাই যেন মিলে যায়। বাড়িটার সবকিছুর সঙ্গে আগে থেকেই যেন পরিচিত সে। বাড়ির লোকজনের সঙ্গেও কি? একথা মনে হতে অজান্তেই যেন গলার কাছে একটা পুঁটলি মতো দলা পাকিয়ে এল।
সামনে বাগান। বহুকাল অযত্নে পড়ে রইলেও তাতে অনেক রকমের ফুল ফুটে রয়েছে। তার মধ্যে অবশ্য বেশিরভাগই বুনো ফুল। একটা বেলিলতার ঝোপ দেওয়াল বেয়ে ছাদে উঠে গেছে। প্রচুর ফুল ও কুঁড়িতে ভর্তি হয়ে আছে চারিদিক। আরেক পাশে ঠাকুরদালান। এখানে গ্রামের লোকেরা এখনও নিত্য নৈমিত্তিক পুজো পাঠ করে। সদরদরজা পেরিয়ে উঠোন। দুপাশে সারিবদ্ধ ঘর।সিঁড়ি বেয়ে সে তরতর করে উঠে গেল দোতলায়।
এরমধ্যে লোকজনেরা সাফসাফাইয়ে লেগে পড়েছে। প্রথমে ভেবেছিল পুরাতন বাড়ি, ভেঙ্গে চুরে হয়তো নতুন করে নিতে হবে। কিন্তু দেখার পর মন তাতে সায় দেয়নি। আপাতত সাফসুতরো করে নিলেই চলবে। দুপুরের মধ্যে মিলিও চলে আসবে, বাকিরাও দুএকদিন পরেই আসবে। তাই জোর কদমে কাজ এগোচ্ছিল।
জানালা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বাইরেটায় চেয়ে ছিল সৌম্য।
"দাদাবাবু দেখুন তো এটা কোন কাজের জিনিস কিনা?" ঘুরে দাঁড়াল সে। ছোট্ট একটা কাঠের বাক্স, সুন্দর কারুকার্য করা। সৌম্য হাতে নিয়ে বাক্সটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। ডালাটা খুলতেই সে ভারি অবাক হয়ে গেল। তাতে কয়েকগাছা কাঁচের চুঁড়ি, দুটি ছোট্ট কাপড়ের তৈরি বরবৌ পুতুল ও আরও কতগুলো জিনিসের মাঝে উঁকি দিচ্ছিল একটা ভাঁজ করা কাগজ। সৌম্য কাগজটা হাতে তুলে নিল। ভাঁজ খুলতেই সুন্দর একটা গন্ধ নাকে এল। সৌম্য বুঝতে পারল এটি একটি চিঠি। কিন্তু কোন প্রেরক বা প্রাপকের নাম নেই তাতে। কার না কার চিঠি! পড়া কি উচিত হবে? সৌম্য প্রথম দিকে একটু ইতস্ততঃ করলেও কৌতূহল বশতঃ পড়তে শুরু করল–
প্রিয় সখা,
কেমন আছিস? আমার কথা কি তোর মনে পড়ে? কতদিন হয়ে গেল, তোর সাথে দেখা নেই। এর আগে কখনও তোকে চিঠি লিখব ভাবিনি। সবসময় মনে হয় তুই তো পাশেই আছিস। যেদিন তুই এখান থেকে চলে গেলি, আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। বারবার তুই পেছন ফিরে চাইছিলি। জানি তোরও নিশ্চয় সেই রকমই কষ্ট হয়েছিল! তোর সঙ্গে কাটানো মূহুর্তগুলো যে আমার জীবনের সেরা সময়। সেই অনূভুতি গুলো নিয়েই তো এতদিন বেঁচে আছি। আর দেখ না আজ আমাকেও চলে যেতে হচ্ছে। কত কথাই না বলার ছিল। আর সুযোগ পাব কিনা কে জানে। হয়তো তোকে লেখা এ আমার প্রথম ও শেষ চিঠি। জানিনা তোর হাতে কোনদিন পৌঁছবে কিনা। তবুও দুটো মনের কথা লিখে গেলাম। কত স্মৃতিই মনের মধ্যে ভেসে আসছে। সে সব ভুলি কেমন করে বল? মনে আছে তোর, সেদিন বিনুপিসিদের সঙ্গে রথের মেলায় যাওয়ার কথা। আমাকে কাঁচের চুঁড়ির বায়না করা দেখে, তুই টিফিনের পয়সা জমিয়ে জমিয়ে আমার জন্য চুঁড়ি এনে দিয়েছিলি? সেদিন যে কী আনন্দ হয়েছিল! চুঁড়িগুলো ভেঙে যাবে ভয়ে আমি আর পরিনি। আমার সব প্রিয় জিনিসের মাঝে রেখে দিয়েছি।
তোর কী এখনও মনে আছে, পুতুল খেলার সময় যখন আমরা বর বৌ সাজতাম, তুই সবসময় আমার বর হতে চাইতিস। অন্য কেউ বর হলে কেঁদে কেটে হাত পা ছড়িয়ে একশা করতিস। ঠোঁট ফুলিয়ে বলতিস, তুই সবসময় আমারই বৌ থাকবি আর কারো নয়। আমি তো সেটাই মনের মধ্যে লালন এখনও পালন করে চলেছি। কিন্তু তুই কোথায়? যাবার আগে একটিবার যদি দেখা হতো...
তোর কি আজও মনে পড়ে সেইসব দিনের কথাগুলো... রাঙাঠাম্মা, বিনুপিসি আরও সবাই মিলে একসঙ্গে কত মজা করে চড়ুইভাতি করতাম ... আর বেলিগাছের কথা... বাগানের বেলিগাছটা তুই আর আমি একসাথেই তো পুঁতেছিলাম। বলেছিলি,"যেদিন প্রথম ফুল ফুটবে একসাথে সে ফুলের ঘ্রাণ নেবো। ফুলে ফুলে যখন গাছ ভরে উঠবে, সন্ধ্যেবেলায় দুজনে ওখানে বসে থাকব। বেলকুঁড়ির মালা গেঁথে তোর খোঁপায় পরিয়ে দেবো।" সেসব তো স্বপ্নই রয়ে গেল...
এই অসুস্থ শরীরেও রোজ নিজের হাতে জল দিই। বেলিগাছের লতা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এসেছে। প্রথম যেদিন ফুল ফুটেছিল। যাইনি সে ফুলের গন্ধ নিতে। তোকে যে আমি কথা দিয়েছি... এখন গাছ ফুলে ফুলে ভরে থাকে। সন্ধ্যেবেলায় সারা বাগান, বাড়ি, এমনকি আমাদের ঘর গন্ধে ম ম করে। তুইও তো কথা দিয়েছিলি আমাকে....
আর বেশিকিছু লিখতে পারছিনা। ওরা আমায় ডাকছে। একটাই চিন্তা রয়ে গেল। আমি না থাকলে এই গাছের কে যত্ন নেবে? আমি যে ওর সাথে মিশে রয়েছি। তুই চলে যাওয়ার পর ওই তো আমার একমাত্র সঙ্গী ছিল। কত কথা হয় ওর সঙ্গে।ডাক্তার বলেছেন আমি নাকি আর বেশিদিন বাঁচব না। যদি ভালো হয়ে উঠি, তাই তো ওরা আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে চাইছে। আর কী ফিরতে পারব বিনুপিসি, রাঙাঠাম্মাদের কাছে? ওদেরই বা কে দেখবে? বড়বাবুরও তো বয়স হয়েছে। যদি তুই কখনও ফিরে আসিস আমাদের সাধের বেলিগাছের যত্ন নিস। আর সবাইকে দেখাশোনা করিস। আর কি! যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস। ভালোবাসান্তে-
তোরই ...
এখানেই শেষ। কিন্তু,কী আশ্চর্য! সৌম্যর মনে হল এ যে তারই উদ্দেশ্যে লেখা। এই বাড়ির প্রতি তীব্র আকর্ষণ, এই চিঠি তাকে যেন বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এই জায়গায় আসা তো দূরের কথা নামই শুনেছে কিনা কখনও! জানালা দিয়ে দেখল এর মধ্যেই মিলি এসে তদারকি শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটা সত্যিই খুব কাজের। দুদন্ড চুপচাপ থাকতে পারে না। এই বাড়ি নিয়ে যা পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা মিলি ছাড়া সেটা সম্ভবপর হতো না। হঠাৎ ওদের কাজ দেখে সে ওপর থেকেই হায় হায় করে উঠল,"এই থামো.. থামো... ওখানে হাত দিও না। দাঁড়াও আমি আসছি।"
"কিন্তু এই এত্তো এত্তো ঝোপ জঙ্গল রেখে কী হবে!"
"ফুলভর্তি গাছ কাটা উচিত নয়। দেখছিস না গাছ আলো করে কেমন ফুল ফুটে রয়েছে? তাছাড়া ভালোই তো সন্ধ্যেবেলায় এর গন্ধ আমাদের মন ভালো করে দেবে।"
মিলি মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও মেনে নিল কথাটা।
সৌম্য অনেক অনুসন্ধান করেও এই চিঠির মালিকের হদিশ করতে পারলনা। সন্ধ্যেবেলায় মন্দিরে পূজারী এলে তাঁর কাছে গিয়ে বসল।
"আপনি কতদিন এখানে আছেন।"
"সে তো বলা মুশকিল। আমরা তো বংশপরম্পরায় এই মন্দিরে পূজা করে আসছি।"
"তাহলে তো এখানকার সবই জানেন আপনি?" এই বলে সৌম্য সব বলতেই তিনি বললেন,"দেখুন, বিভিন্ন সময়ে এখানে অনেক লোকজন এসে থেকে গেছে। তাই নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে... হ্যাঁ, একটি মেয়ের কথা মনে পড়ছে। তাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি হয়েছিল। শেষে বড়বাবু তাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। তবে সে আর ফিরে আসে নি। মনে হয় মারা গিয়েছিল। পরে শুনেছি সে কর্কটরোগে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু সেতো অনেকদিন আগের কথা। আমারই তখন যুবক বয়েস। বলতে গেলে এই বাড়িটা একরকম অনাথ আশ্রমই ছিল। যার যখন থাকার দরকার পড়তো বড়বাবু তাদের আশ্রয় দিতেন। বড়বাবুরা তো কোনদিনই এখানে স্থায়ী ভাবে থাকেননি। পুজোর সময় আসতেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। ছেলেরা আর দায়িত্ব নিতে চাইল না। অনেককাল এভাবে পড়েছিল। আপনারা বাড়িটা নিয়েছেন। ভালো কথা। নতুন করে আবার সবকিছু করার চেষ্টা করছেন। খুব ভাল উদ্যোগ। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।" এই বলে বৃদ্ধ আরতির ওম মাথায় ছুঁইয়ে দিলেন।
মেয়েটির কথা ভেবে সৌম্যর মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। পায়ে পায়ে হেঁটে কখন যে এসে একসময়ে বাগানের বেঞ্চে বসেছে খেয়ালই নেই।
"সৌম্য এই বেলকুঁড়ির মালাটা একটু খোঁপায় পরিয়ে দিবি?" চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, মিলি হাসিমুখে এগিয়ে আসছে। সৌম্যর পাশে সে ধপ করে বসে পড়ল।
"একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। কী সুন্দর গন্ধে চারিদিকটা ম ম করছে! রোজ সন্ধ্যেবেলায় এখানে এসে বসব..."
সৌম্যর মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। তার মানসপটে যে কিশোরী মেয়েটির মিষ্টি মুখের ছবি ভেসে আসছিল, মিলির মুখে যে তারই প্রতিচ্ছবি।
সৌম্য বেলিগাছটার দিকে তাকালো। কী অপূর্ব ও প্রাণবন্ত! চাঁদের আলোয়...থোকায় থোকায় ফোঁটা সাদা ফুলগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন খই ফুটছে। কোন একসময়ে দুটো কিশোর কিশোরী কত স্বপ্ন ও আশা নিয়ে গাছটিকে পুঁতেছিল। তার কুঁড়িগুলো মালা হয়ে, এক প্রেমিকের হাত ধরে প্রেমিকার খোঁপায় শোভা পাচ্ছে। বদলে যায় হয়তো অনেককিছুই, কিন্তু ভালোবাসার ধরন, এর প্রকাশ সবকিছু একই থাকে। শুধু খোলশটাই যা বদলায়, আসলে ভেতরে ভেতরে কোন একটা জায়গায় আমরা হয়তো সবাই এক।