আঃ! আজ শরীরটা বড় আনচান করছে। ভাল লাগছে না। রোদ্দুরটাও তেমন কড়া আজ, মাথার চাঁদি যেন ঝলসে যাচ্ছে। উঃ.......
চারিদিক থেকে আওয়াজ উঠল, আরে রে রে গেল গেল.......কে যেন ধরে ফেলল আমায়। পড়ে যেতে গিয়েও বেঁচে গেলাম। সবাই ধরাধরি করে রোয়াকটায় নিয়ে গিয়ে বসাল আমায়।
"কি হইল কাকা? মাথা ঘুইরে গেসে নাকি?"
রতনের কথায় লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, "না না, ঐ একটু....." সবাই মিলে ভারি বকাবকি শুরু করল আমায়। ওদের কি করে বোঝাই, না বেরোলে খাব কি! আমার কি বসে খাওয়ার কপাল! আছে তো একখানা হাতে টানা রিকসা, তারও অবস্থা ভাল নয়, অনেকটা আমারই মত। অত টাকা কই যে নতুন কিনব? কোনমতে সারিয়ে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছে।
বাবন বলল," কাকা, আজ তোমার শরীরটা ভাল নেই। বাড়ি চলে যাও।"
রতন , বাবন এরা সবাই আমার মতই হাতে টানা রিকশাচালক। আমাকে বড় ভালবাসে। বয়স হচ্ছে আমার, ওদের মত অত খাটতে পারিনা আজকাল। অথচ এককালে লোকজন নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চক্কর দিয়েছি সারা কলকাতা। লোকে ভালবেসে বলত, এ রিকশা নয়, ঘোড়ার গাড়ি।
কোনমতে বাড়িতেই ফিরে এলাম। অসময়ে আমায় দেখে কুসুম অবাক চোখে তাকাল," কি গো! কি হল? ফিরে এলে যে?"
আমি: হ্যাঁ গো, নুটুর মা। ফিরেই এলাম। এমনিই...ইচ্ছে করছিল না রিকশা চালাতে আজ....
কুসুম: সত্যি কথা বল, বলছি....নিশ্চয়ই মাথা ঘুরে গেছিল, তাই না? আমায় মিথ্যে বোলো না।
কুসুম তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল," শরীরের আর কি দোষ? রোজগারপাতি কম, ঠিকমত খাবার জোটে না...."
জলটা খেয়ে একটু ভাল লাগছে এখন। কুসুমটা বড্ড চিন্তা করে আমায় নিয়ে...একটুতেই ডাগর চোখদুখানি জলে ভরিয়ে ফেলে। পাগল একটা!
ঐ চোখের টানেই তো ভেসে গিয়েছিলাম একদিন। মা বাবার অমত ছিল, ও যে বিধবা ছিল। আবার একটা একবছরের বাচ্চাও ছিল। কিন্তু ওকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারিনি। ওকে নিজের করে নিলাম, ওর একরত্তি বাচ্চাটাকেও। গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম এই শহরে। প্রথম বড় শহরে পা দিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে সংসার গুছিয়ে নিলাম। তখন হাতে টানা রিকশার খুব কদর। কষ্টেসৃষ্টে কিনে নিলাম এই রিকশা। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নুটুকে লেখাপড়া করালাম। নুটুও বড্ড ভালবাসে আমায়, আমায় ও নিজের বাবা বলেই মানে। আর আমি তো ওকেই নিজের ছেলে ভেবে কাটিয়ে দিলাম প্রায় গোটা জীবনই। বড্ড বাপ-ন্যাওটা ছেলে আমার। এখন একটা দোকানে হিসেব দেখার কাজ করে। কতবার বলেছে, আমায় রিকশা চালানো ছেড়ে দিতে...কিন্তু এই দুঃসময়ের সঙ্গী রিকশাটার ওপর যে বড্ড মায়া জন্মে গেছে আমার। 'রিকশা চালাব না' ভাবলেই বুকের মধ্যে কি যেন হারিয়ে ফেলার ব্যথা হয়। তাছাড়া ওর উপরেই বা কত চাপ দেব? কুসুম, নুটুর মত এই রিকশাটাও কবে থেকে যেন আমার আপনজন হয়ে উঠেছে!
"কি গো, শুয়ে শুয়ে এত কি ছাইপাঁশ ভাবছ? শরীরটা এখন ভাল লাগছে?" কুসুম উদ্বিগ্ন মুখে আমার মাথায় হাত বোলায়।
" আমায় নিয়ে বড় চিন্তা তোমার, তাই না নুটুর মা?" আমার কথায় রাগ করে কুসুম, " এ জগতে তুমি ছাড়া আর আছেটা কে আমার, শুনি? সব বিসর্জন দিয়ে তোমার হাত ধরে যে বাঁচতে শিখেছি গো। হ্যাঁ, নুটু আছে, কিন্তু স্বামীর জায়গা কি ছেলে নিতে পারে?"
" জান কুসুম, আজকাল বড় চিন্তা হয়। শুনছি, লেখাপড়া জানা বড়মানুষেরা কিসব প্রতিবাদ-টতিবাদ করছে, হাতে টানা রিকশা তুলে দেবে বলছে। আরও বলছে, এতে নাকি আমাদের মত মানুষের অপমান হচ্ছে। " আমার কথায় কুসুম গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে," ও মা গো! এ আবার কি অনাছিষ্টির কথা! নিজের খুশিতে মনের আনন্দে তুমি স্বাধীনভাবে রোজগার করছ....আর রিকশাই তুলে দেবে?"
" অনেকে তো আজকাল সেজন্যই এই রিকশায় চড়তে চায় না, বিশেষ করে আমার মত একটু বয়স্কদের রিকশায়। কিন্তু তাতে যে আমার মত রিকশাওয়ালাদের রোজগার ক্রমশ কমেই যাচ্ছে, আমরা বেকার হয়ে যাচ্ছি- এসব নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই কিন্তু। কোথায় ভাবলাম, এতদিন একা সংসার টেনেছি, এবার নুটু আর আমি মিলে আরও সচ্ছলতা আনব পরিবারে! হায়, আমার তো রোজগার আজকাল নেই বললেই চলে। সেই তো নুটুকে একাই সংসার টানতে হচ্ছে। আমাদেরকে তো কেউ জিজ্ঞেস করল না, আমরা কি চাই! আমাদের অপমান, সুখ, সুবিধা নির্ধারণ করার অধিকার আমাদেরই নেই। গরীব মানুষের কথার কোন গুরুত্বই নেই!" একটানা এত কথা বলে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। শরীরটা আবার খারাপ লাগছে। নাঃ! শুয়ে পড়ি একটু।
বিষন্নতা মাখানো ঐ মায়াবি চোখে তাকিয়ে থাকে কুসুম। আমার কষ্ট, যন্ত্রণা বুঝতে পারছে সে, কিন্তু কিছু করতে অপারগ। আমার পাশে বসে আমার মাথায় ওর ভরসার হাতখানি বুলিয়ে দেয় সে। আঃ! সব বিরূপতার মাঝে এই তো আমার আশ্রয়।