যাত্রাসম্রাট হরিদাসের গল্প : কল্পনা মিত্র


 

আজ যে গাঁয়ের গল্প আমি বলতে চলেছি সেই গাঁয়ের নাম হলো 'সুরসুরি'। আগে বলি ওই শস‍্য শ‍্যামলা গাঁয়ের নাম সুরসুরি কেন হলো। সেই মান্ধাতার আমল থেকে ওই গাাঁয়ের ধনী,দরিদ্র,মধ‍্যবিত্ত, জীবনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ,চির অখুশি,আহত-গম্ভীর,হাসি মুখী, কিপটে, দাঁতখিচুনে,তর্কবাজ ইত্যাদি ইত্যাদি প্রকৃতির বৃদ্ধ -বৃদ্ধা মায় চির রুগ্ন শিশুরা একবার অন্তত "সুরসুরি  লাগছে"বলে হেসে গড়াগড়ি যেত। এই নিয়ে আশপাশের গাঁয়েও বেশ সমালোচনার ঝড় উঠতো। একবার গাঁয়ের জমিদার আর তাঁর প্রায় সমবয়সী পিসি এবং মেজোকর্তার তিন বছরের রুগ্ন ছেলেটা সুরসুরির জ্বালায় হেসেই অস্থির। এই দেখে বৃদ্ধ জমিদার তর্কভূষনের বড় ছেলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁর জমিদারিতে এ গাঁয়ের নাম হবে'সুরসুরি। তাঁর আমল থেকেই গাঁয়ের প্রকৃত নামটা সকলের মন থেকে বেমালুম মুছে গিয়েছিল। গাঁয়ের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল ঘন জঙ্গল। স্বাধীনতার পর জমিদারি প্রথা উঠে গেলেও কিংবা জঙ্গল সাফ করে জনবসতি গড়ে উঠলেও ওই জঙ্গলটা আজও তেমনই আছে। আর দশটা গাঁয়ের কিছু মানুষ যারা গাছপালা কেটে ঘরবাড়ি তৈরী করছিল তাঁরা ওই জঙ্গলে তাঁদের প্রিয় গাছগুলোর বীজ ছড়িয়ে নয় চারা পুঁতে জঙ্গলটার ঘনত্ব বাড়িয়েছিলেন। ওইখানেই দশটা গাঁয়ের মৃত মানুষদের বাস। ওখানে ভূত-পেত্নিদের রাজত্ব আজও রমরমিয়ে চলে।


এবার আসি আসল গল্পে । সুরসুরি গাঁয়ের  সর্বসমেত দশটা গাঁয়ের সকলের কাছে হরিদাসের যাত্রাদলের বড়ই সমাদর। প্রতিটি গাঁয়ে মাসে দুটো করে যাত্রা অভিনয়ের বায়না রাখতে হরিদাসকে  নতুন নতুন যাত্রা লেখায় ব‍্যস্ত থাকতে হয়। ইতিমধ্যে দশটা গাঁ থেকেই তাকে যাত্রাসম্রাট হিসেবে পুরষ্কৃত করা হয়েছে। গাঁয়ের মাতব্বর দুলালকান্তির ছেলে বাসবকান্তির সেই ছেলেবেলা থেকে হরিদাসের যাত্রার ভক্ত। কিবা শীত কিবা বৃষ্টি টিনের ছাউনির তলায় বাঁধানো উঁচু দালানে বসে হরিদাসের দলের যাত্রা দেখায় তার কোনো ক্লান্তি নেই। ক্লান্তি শুধু অঙ্ক কষতে। এই নিয়ে তার মায়ের অভিযোগের অন্ত নেই। ছেলে বড় হয়ে যাত্রা-পালা লিখে যাত্রাদল গড়বে এই কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছে। সেইমতন বড় হওয়ার সাথে সাথে বন্ধুদের নিয়ে দলও গড়ে তুলেছে। কিন্তু হরিদাসের বিপরীতে বাসবকান্তির লেখা পালা আর অভিনয় কোনটাই তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। একদিন বাসবকান্তি বন্ধুদের নিয়ে হরিদাসের কাছে হাজির হয়ে তাকে যাত্রাদল তুলে নিতে বলে। দলের লোকের উপার্জন বন্ধ করতে নারাজ হরিদাস তার কথা কানে তোলেনা। সুযোগ বুঝে একদিন এক শুনশান দুপুরে বাসবকান্তি আর তার সাঙ্গ পাঙ্গরা তাকে বেদম প্রহার করে জঙ্গলে ফেলে আসে। হরিদাস দেখে সেখানে ধবধবে সাদা পোশাকের চর্মশূন‍্য একদল গেছো বানর জটলা করছে।বানর তায় আবার পোশাক পরা! হাসতে হাসতে তার পেটে খিল ধরার অবস্থা। একদল সাদা পোষাকি ওর হাসিকে নকল করে সমবেতভাবে হেসে ওকে মুখভঙ্গী করে ভেঙচে ওঠে। একসাথে এতজনের হাস‍্য আক্রমণে সে একটু হলেও ভয় পেয়ে যায় আর পালাবার উপায় ভাবতে থাকে। হঠাৎ একজন ওর ঠিক মাথার ওপরের গাছের ডালে পা আটকে নিচের দিকে মাথাটা ঝুলিয়ে ওর কানের কাছে মুখ এনে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,-" পছন্দ হচ্ছেনা? দলে এসে দলের স্বজনদের অপছন্দ?"সঙ্গে সঙ্গে অন‍্যগুলোও প্রথমটার মতন গাছটাতে উল্টো ঝোলা ঝুলে বলতে লাগলো,

-" লড়তে পারিস তো লড়ে দেখা

আমরা শ'য়ে শ'য়ে আর তুইতো একা।"


হরিদাস প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। সে দুহাতে চোখ চাপা দিল। ওরা নাকিসুরে আরও জোরে ছড়া কাটতে লাগলো। কান ঝালাপালা হরিদাস কানে চাপা দিতে গেল। একটি মেয়েলি সুরেলা নাঁকি গলা বললো-"মানুষের বাচ্ছা হোস তো আমাদের মতন উল্টো ঝুলে দেখা।"এবার যাত্রাসম্রাটের মানে আর মনে লাগলো। ভয় ভুলে সে বললো,-"কেন? মানুষের বাচ্ছা হয়ে তোমাদের মতন ঝুলে দেখাবো কেন?"পেত্নি বললো,-"কারণ আমরা মানুষের বাচ্ছা বলে।" হরিদাস না হেসে পারলো না।  সাদা চাদরে আবৃত জনা দুই তার সামনে এসে দাঁড়ালো,

-"তুমি দেখছি নেহাতই অশিক্ষিত। মানুষের পূর্ব পুরুষরা যতক্ষণ সমাজ সংসার গড়ে তোলেননি তাঁরা কি ছিলেন জানোনা দেখছি।!"কয়েকজন চর্ম মাংসহীন মচ্ মচ্ করে গাছের ডাল ভেঙ্গে ছড়ির মতন হাতে নিয়ে তাকে ঘিরে ধরলো আর দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ছড়ি নাড়তে নাড়তে বললো,-" জানিস না মানুষদের পূর্ব পুরুষ বানর ছিল? মৃত‍্যুর পর আমরা সভ‍্য সমাজ থেকে বেড়িয়ে আবার আমাদের আসল চেহারায় স্বাধীন ভাবে গাছে গাছে বিচরণ করবো বলে এই জঙ্গলে আস্তানা গড়ি। আমাদের বিশেষত্ব,অন‍্য মৃত‍্যু পরবর্তী জীবের মতন উলঙ্গ থাকিনা। প্রকৃতির চাঁদ থেকে দিদিঠাকুরণ আমাদের ধবধবে সাদা পোশাক পাঠিয়ে দেন। কথাটা শেষ হতেই ধবধবে সাদা পোষাকের ভূত পেত্নিগুলো দাঁত বেড় করে সুর করে করে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করলো। হরিদাস মনে মনে এই ভূতদের জীবন নিয়ে পালা ভাবতে লাগলো। এই হট্টগোলে থেকে বেড়িয়ে কোন নিড়িবিলি জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা হতেই সে নিজেকে সবচাইতে উঁচু তালগাছের মাথায় আবিষ্কার করলো.... জঙ্গলের বাইরে তখনও সন্ধ‍্যে জাঁকিয়ে বসেনি। কি করে এমনটা সম্ভব হলো এই ভাবনার সাথে সাথে এতো উঁচু গাছ থেকে পরে যাওয়ার সম্ভাবনার আশংকায়  এদিক-ওদিক দেখতে গিয়ে নিজেকে জঙ্গলের ঝোপের মধ‍্যে পরে থাকতে দেখলো। ততক্ষণে কিছু ভূত আর পত্নি ভাসতে ভাসতে ওর পাশে এসে হাততালি দিয়ে বললো,-" তুই তো দেখছি বাচ্ছাদের ভয় পাওয়ানোর ভূত'একানড়ে'র পদবী নিতে চাস.. ! হাঃ হাঃ!!" হরিদাস কোন উত্তর দিল না শুধু দেখলো ওর শরীরের দিকে ও ভেসে যাচ্ছে। অন‍্য ভূত গুলোও মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ওর সঙ্গ নিল। পথিমধ‍্যে উল্টোদিক থেকে আরও একদল ভূত-পেত্নি এসে হইচই করে বলে উঠলো,-" আমরা 'সুরসুরি'র মাতব্বরের বুড়ি পিসিকে সুরসুরি দিয়ে মস্করা করতে যাচ্ছিলাম, ঝোপের মধ‍্যে এই নবাগতর শরীরটাকে ক্ষতবিক্ষত দেখলাম! এ সদ‍্য এসেছে,এখনও দাহ হয়নি তাই কঙ্কালসারও নয়,শরীরটা চিনতে পেরে বড্ড কষ্ট হচ্ছে,কি মারটাই না মেরেছে।"

--" চল্ চল্ দেখি।"হরিদাসকে নিয়ে সকলে ওদিকেই গেল,দেখলো, হরিদাস প্রশ্ন করে সমস্ত কাহিনি শুনলো। ওকে ওখানেই বসতে বলে ভূতের দল পায়ে হেঁটে মাতব্বরের বাড়ির দিকে গেল।


বাসবকান্তি দাওয়ায় বসে বন্ধুদের সাথে গরম গরম  কড়াইশুঁটির কচুড়ি আর আলুর দম খাচ্ছিল। বুড়ি পিসিঠাম্মা খুপড়ি ঘরে শুয়ে তা দেখছিলেন আর লোভ দিচ্ছিলেন। একটা পেত্নি একটা চিমটি কাটাতে বুড়ি যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো। ভূতেরা ওর কানে কানে বললো,-" কদিনের মধ‍্যে তো আমাদের কাছেই যাবি,তাই,যাওয়ার আগে তোর হাসিমুখ দেখবো বলে সুরসুরি দিতে এসেছিলাম আমরা।"

-"তালে,চিমটি দিলে কেন?

-"তোর ওই লাল্টু নাতিটা মানুষ খুন করে বসে বসে কচুড়ি খাচ্ছে!"

-"ওর মা ওকে খাওয়াচ্ছে, আমার কি দোষ?"

-"ওটাকে হাজতে পোরার ব‍্যবস্থা কর। মানুষ খুনের দায়ে ওর ফাঁসি চাই। না হলে মরার পর তোকে বস্ত্রহীন হয়ে কীট-পতঙ্গ ভূতেদের সাথে থাকতে হবে, আর, এখন,চিমটি খা।"

-"না -না,আমি গরম কচুড়ি আর আলুর দম খেতে চাই"ফোকলা দাঁতে বুড়ি কাঁদতে লাগলো।

-" যা বল্লাম করবি, তালে,কচুড়ি আর সুরসুরি দু-ই-ই পাবি।"

-"করবো লিশ্চয় করবো, কথা দিলাম।"

প্রায়োন্ধকার রান্নাঘরে পাতা উনুনে তেলের কড়া চাপিয়ে বুড়ি ঝি কচুড়ি ভাজছিল আরেক ঝি বেলছিলো। সবার অলক্ষে অশরীরি ভূত বাহিনী  রান্নাঘর লণ্ডভণ্ড করে সব কটা কচুড়ি মুঠোর মধ‍্যে লুকিয়ে ফেললো। ফেরার পথে বুড়িকে একটা খাইয়ে প্রাণ ভরে সুরসুরি দিল। লণ্ডভণ্ড রান্নাঘর আর কচুরি উধাওয়ের হাহাকারের সাথে বুড়ির খিলখিলি হাসি মিলিত শব্দের জগাখিচুড়ি অবস্থার বাতাবরনণে ভূত-পেত্নি যে যার মুখে কচুড়ি পুরে লাফাতে লফাতে বেড়িয়ে গেলো।


   পিসি ঠাম্মি আর মায়ের প্রশ্নের চাপে পরে বাসবকান্তি তাদের কাছে হরিদাসকে বেধড়ক মেরে জঙ্গলে ফেলে এসেছে এই কথা স্বীকার করতেই তার মা স্বামী দুলালকান্তিকে বললো,-" খুনের দায় ছেলের ফাঁসি হবে! তুমি ডাক্তার নিয়ে গিয়ে হরিদাসকে যে কোনো উপায় বাঁচাও।" 

   চাঁদনি রাতে জঙ্গলের গাছগুলোর মাথায় ভূত পেত্নির মেলা। সব্বাই যাত্রাসম্রাট মৃত হরিদাসের মুখে ওর কীর্তির কথা শুনে অভিভূত। হরিদাস জানালো -" ইচ্ছা আছে পলজন্মে ভূতেদের নিয়ে পালা লিখবেো।  এই প্রাণহীন জগতেও পালাসৃষ্টি করে তোমাদের নিয়ে এমনই চাঁদনি রাতে যাত্রা অভিনয়ের ব‍্যবস্থাও করবেো।" হঠাৎ ওরা দেখলো জঙ্গলের ধারে অনেক আলো জ্বলছে হরিদাসের ক্ষতবিক্ষত শরীর জঙ্গল থেকে বেড় করে ওই আলোর মধ‍্যে আনা হলো। হরিদাস গুণে দেখলো সাতজন ডাক্তার তার শরীরের ওপর ঝুঁকে চিকিৎসা করতে ব‍্যস্ত। ভূত-পেত্নির মুখের ওপর যেন ঝাঁকে ঝাঁকে কালো মেঘ জড়ো হল। এভাবে অনেকবার কেউ কেউ ভূত হতে হতে ফিরে গেছে নিজের জীবনে। হরিদাস আজকেই এসে এই ঘন জঙ্গলের ভূতের রাজ‍্যে ভূতোপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বুদ্ধিধারী মানুষ, খুনের দায়োদ্ধারের জন‍্য জনপ্রিয় হরিদাসকে বাঁচাতে তৎপর! ওরা বললো -"তোমাকে ফিরতে হবে বন্ধু, তুমি তবে ফেরার পরেও যাতে আমাদের জন‍্য ভাবো প্রকৃতির কাছে এমন উপায় চেয়ে নেবো। তুমি ফিরে গেলেও তোমার দলে আমাদের যাত্রা করার সুযোগ করে দেবে কথা দাও।"  হরিদাস কিভাবে তার যাত্রায় ভূতের চরিত্রে ওদের অভিনয় করার সুযোগ করে দেবে এই ব‍্যাপারে তারা সবাই মিলে দ্রুতবেগে পরামর্শ সেড়েও ফেললো।

ভূত-পেত্নিরা দল বেঁধে কায়াহীন হরিদাসকে তার শরীরে প্রবেশ করিয়ে বিদায় জানিয়ে ঔগেল।


শহরে এবং গাঁয়ে যাত্রাসম্রাট হরিদাসের জনপ্রিয়তা ক্রমশঃ বেড়েই চললো। প্রতিমাসে পূর্ণমার দিনকয়েক আগে থেকে উপচে পরা দর্শকের সামনে নিয়মিত  ভূত-পেত্নি-দত‍্যি-দানোদের নিয়ে  নতুন নতুন যাত্রাভিনয় হয়। কয়েক রাত্রি জেগে কলা-কুশলীদের নিয়ে  দত‍্যি-দানো চরিত্রের রিহার্সাল চলেও। সে সময় সেখানে ছায়া-কায়াহীন ভূত-পেত্নির দল উপস্থিত থেকে চুপটি করে অভিনয় শিখে নেয়। আসল অভিনয়ের দিন কলা-কুশলীদের একটা বন্ধ ঘরে ঘুম পারিয়ে ভূত-পেত্নিরা মঞ্চে এসে তাদের নির্বাচিত চরিত্রের অভিনয় করে। যাত্রা আরও প্রাণবন্ত হয়। অভিনয় শেষে তৃপ্ত মনে ওই কায়াহীন আত্মারা ঘন জঙ্গলে নিজেদের ডেরায় ফিরে উৎসবে মেতে ওঠে।


   বাস্তব জগতে হরিদাসের মন থেকে কয়েকঘন্টার জন‍্য ছায়া-কায়াহীন সঙ্গীদের সাথে কাটানো সত‍্যটা মুছে গেলেও তাদের জীবনযাত্রা আর সংলাপগুলো কোন এক যাদুবলে তার কলমের ডগায়  প্রাণ পায়। আর কলা-কুশলীরা ভূতের চরিত্রে অভিনয় না করেও তাদের নিয়মিত বেতন থেকে বঞ্চিত হননা। উপরন্তু অভিনয়ের সময় তাঁরা যে ঘরবন্দী ছিলেন সে কথাওবেমালুম ভুলে যান। 

 এইভাবে 'সুরসুরি'গাঁয়ে শান্তিপ্রিয় রসিক ভূতেদের আনাগোনা বহাল তবিয়তে আজও বজায় আছে। 

Post a Comment

Previous Post Next Post