পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙল। ভোরবেলায় গঙ্গাঘাটের দৃশ্য অপূর্ব । স্নান সেরে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দিয়ে আমরা রামনগরের রাজার বাড়ি-দুর্গ দেখতে গেলাম ।
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এখনো নাকি রাজা রাস্তায় বের হলে স্থানীয় মানুষজন রাস্তা খালি করে দেয় ।রাজা দুর্গের একপাশে থাকেন, যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ । সেখানে নানা শিকার সামগ্রী, যুদ্ধাস্ত্র, জামাকাপড়, গহনা দেখলাম । এরপর গেলাম অন্নপূর্ণার মন্দির ও সঙ্কটমোচন মন্দিরে। চারদিকে প্রচুর বানর সেনার উপস্থিতি ।তবে তারা কাউকে জ্বালাচ্ছে না ।সেখান থেকে সারনাথের উদ্দেশে রওনা হলাম।সারনাথে বৌদ্ধ স্তূপ আছে।অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ ।বুদ্ধের মন্দিরে অনেকগুলি ঘন্টা আর গমগম শব্দে মন্ত্র ভেসে আসছে। শায়িত বুদ্ধদেব । চারপাশে ময়ূর-কাঠবিড়ালীর দেখা মিলল। প্রচুর বিদেশীদের ভিড়, তারা ফটো তুলতে ব্যস্ত । বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ বিশাল বটগাছের নিচে প্রথম পাঁচজন শিষ্য কে উপদেশ দেন।সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রশান্তি অনুভব করলাম । এরপর আমরা গেলাম বিড়লা মন্দির ও বিখ্যাত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে । মন্দির প্রাঙ্গণ তো অপূর্ব । ঘুরে ঘুরে দেখতে অনেক সময় লাগল । বিশ্ববিদ্যালয় বাইরে থেকেই ঘুরে দেখলাম, বিশাল জায়গা নিয়ে । প্রচুর ঘোরাঘুরি তে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে সন্ধ্যায় আবার সেই গঙ্গার ঘাট।আরতির শেষ পর্ব চলছে, প্রান ভরে দেখে নিলাম । তারপর কিছু কেনাকাটা করলাম, চুড়ি, জর্দা, পানের মশলা এইসব।রাতের ভোজন সেরে সেদিনের মতো বিরতি ।
পরদিন আমরা বেনারস থেকে বেশ খানিকটা দূরে চুনার ফোর্ট দেখতে গেলাম, পথে বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির ।সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন ।সারা দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া নেওয়া হলো, রাস্তা খুব বাজে ছিল,খানা-খন্দে ভরা ।তখন মায়াবতীর রাজত্ব চলছে ।রাস্তার দুপাশে বন্ধুর জমি,রুক্ষ,বাবলা গাছের জঙ্গল, জলের চিহ্ণমাত্র নেই ।ধুলোর ধোঁয়ায় জানলার কাঁচ নামাতে পারছিলাম না ।যেতে যেতেই দেখলাম প্রচুর মানুষ গরুর গাড়িতে নয়তো ট্রাক্টরে চলেছে ।রুক্ষ মাটিতেই কেউ কেউ পরিবার নিয়ে রান্নার আয়োজন করছে।ওরা কোথায় যাচ্ছিল জানি না ।প্রায় দু ঘন্টা কাটার পর বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরের রাস্তা এল। রাস্তার দুপাশে অনেক পুজো সামগ্রীর দোকান ।জলের ব্যবস্থাও আছে ।আমরা জুতো রেখে প্রসাদী নিয়ে রওনা হলাম ।পাথরের সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে যেতে যেতে মনে হলো পাতাল প্রবেশ করছি। অদ্ভুত ব্যাপার, মেন রোডের দুপাশে রুক্ষ জমি দেখেছিলাম অথচ নিচে প্রকৃতির কোমল সজল রূপ । চারদিকে প্রচুর গাছ ।সেখানেই বট,অশ্বত্থ গাছের নিচে মায়ের মন্দির ।পুজো দিয়ে যত নিচে নামছিলাম তত দৃশ্য অপূর্ব হয়ে উঠতে লাগল ।চারপাশে শিউলি গাছের অজস্র শিউলি ফুল ফুটে ঝরে পড়েছে পথের পরেই।সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।অজানা বনফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরপুর পুরো জায়গা ।দূরে পাহাড় ও নীলাকাশ।মনে হলো কোনো গুহা থেকে বেড়িয়ে স্বপ্ন রাজ্যে এসেছি।পথ খুব সরু,একজনের চলার মতো।সীতাকুন্ডের পাশে একটু বসলাম ।এখানেও চারদিকে বানর ও হনুমান ।ওদের জন্য ছোলাভাজা নিলাম। মনে হলো জীবনে কোনো সমস্যা বা চিন্তা নেই ।পাথরের টিলার ওপর ছাই মেখে সাধু বাবাজিরা বসে আছে ধুনি জ্বালিয়ে ।কেউ কেউ পয়সা, চাল,আলু দিচ্ছে ।তাদের ভ্রুক্ষেপই নেই ।এরা কেন সংসার ছেড়ে কৌপীন পরে বসে আছে জানি না ।বোধিলাভের জন্য বোধহয় ।যাইহোক আবার আমরা ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলাম। হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম বলাই বাহুল্য ।এবার দুপুরের খাওয়া সেরে চুনার ফোর্টের দিকে রওনা হলাম । সেটা সম্ভবত মীর্জাপুরের দিকে ।পাহাড়ের ওপর দুর্গ বানিয়েছিলেন রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান , দশম শতাব্দীতে। চুনার ফোর্টের একাংশ সাধারণের জন্য খোলা, বাকি অংশে সেনাবাহিনীর ট্রেনিং হয় শুনলাম। ভেতরে বিরাট গভীর কুয়ো নির্মান করিয়েছিলেন রাজা ।এত উপরে রুক্ষ ভূমিতে কুয়োর জল দেখে অবাক হলাম। ফোর্টের কাছাকাছি কিছু বসতি আছে।তারা গাইডের কাজ করে ও দেহাতি ভাষায় কথা বলে। দেখলাম সেই যুগে বন্দীদের কিভাবে মাটির তলায় গোপন কুঠুরিতে রাখত,আলো প্রবেশ করে না। যখন ছাড়া পেত অন্ধ হয়ে যেত। এখানে কোনো মিউজিয়াম নেই, কিন্তু দেওয়ালে কান পাতলে ইতিহাস কথা বলে ওঠে। সরু খাড়া সিঁড়ি দিয়ে ভারী লোহার বর্ম-পোশাক পরে ভারী তরবারি নিয়ে রাজারা কিভাবে যাতায়াত করতো সেটাই ভাবছিলাম ।প্রচুর শক্তিধর ছিল সন্দেহ নেই ।তুলনায় এ যুগের জীবন অনেক সরল। বহু নিচে গঙ্গা নদী দেখতে পেলাম ।লোক বোঝাই একটা নৌকা যাচ্ছে ।জঙ্গলঘেরা নিচের দিকে পাথরের তৈরী ভাঙ্গা একটা ঘর দেখলাম, ওখানে নাকি মৃত্যু দণ্ড দেওয়া হতো । মুন্ডু কেটে ছুড়ে গঙ্গায়। ফোর্টের মাঝখানে কোনো মন্দির ছিল যেখানে একবার হোলির সময় রাজকন্যা কে কোনো পাঠান সুলতান অপহরণ করেছিল ।একটা কুঠুরি দেখাল গাইড যেখানে রাজা বিক্রমাদিত্যের দাদা স্বেচ্ছায় সমাধি নিয়েছিলেন। সবমিলিয়ে রোমাঞ্চে ভরা অভিযান ছিল আমাদের । বিকেলের রোদ পরে যাওয়াতে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ।পথে এক জায়গায় মার্বেলের তৈরি নানা ধরনের শিল্প সামগ্রী বিক্রি হচ্ছিল দেখে এক জোড়া হাতি নিলাম।যার পেটে আরেক টা ছোট্ট হাতি।অসাধারণ শিল্প কলা ।ঝাঁকুনি দিতে দিতে জঘন্য রাস্তায় গাড়ি চলল। প্রায় রাত সাড়ে আটটায় পৌঁছালাম ।একেবারে রাতের খাবার খেয়ে নিদ্রার দেশে।
পরদিন ছিল আমাদের ফেরার ট্রেন।তাই সকালে একটু আয়েশ করে উঠে স্নান সেরে খেয়ে ওখানকার বাঙালি টোলায় দুর্গাপুজো দেখতে পেলাম । বাংলা কথা শুনে আনন্দ হলো।দুপুরে নিরামিষ থালি ও রাবড়ি খেয়ে হোটেলে এসে সব গুছিয়ে নিলাম।সন্ধে সাতটা নাগাদ ট্রেন ছিল। স্টেশনে যাবার পথে আবার সেই ভয়ানক ব্যাপার ।ছোট ঘিঞ্জি রাস্তায় গুঁতোগুতি করে সবাই চলছে । আমরা অটোতে। সামনেই দুটো ষাঁড় লড়াই করছে।চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম ।কিভাবে স্টেশনে এলাম জানি না ।প্ল্যাটফর্মে লোকে লোকারন্য।বসার জায়গা নেই। এক জায়গায় কাগজ পেতেই বসলাম ।সময় পেরিয়ে গেলেও ট্রেনের দেখা নেই । ততক্ষণে এক ষাঁড় বাবাজি এসে হাজির ।আমরা চটপট জিনিসপত্র নিয়ে খাবারের দোকানের পাশে দাঁড়ালাম। সবাই রাতের খাবার নিল, আমার খাওয়ার ইচ্ছে হলো না, তাই খাবারের থালি টা একজন ঘুমন্ত ভিখারীর পাশে রেখে দেওয়া হলো ।ততক্ষণে ট্রেন এসে গেছে ।সবাই দুর্গা দুর্গা বলে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।।