বারাণসী দর্শন : অর্পিতা গাঙ্গুলী


 

প্রতিদিনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো কোথাও ঘুরে আসা। এইরকম ইচ্ছে থেকেই একবার পুজোর সময় বেনারস যাত্রা করেছিলাম ।কাশীধাম যাত্রার মাহাত্ম্য না বুঝেই নিছক বেড়ানোর আনন্দে বেড়িয়ে পড়া । দুর্গাপুর থেকে রাতে বিভূতি এক্সপ্রেস ধরে রওনা হলাম । সাথে ছিল কচিকাঁচারা। পরদিন সকালে বেনারস পৌঁছালাম। স্টেশনের বাইরে এসেই অদ্ভুত রোমাঞ্চ হলো । আগে থেকেই আমাদের লজ্ বুক করা ছিল। সেটা দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছাকাছি । একটা গাড়ি ভাড়া করে সেখানেই গেলাম।রাস্তা হিসাবে যেটা পেলাম তা অবর্ণনীয় ।কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই ।যে যেখান দিয়ে পারছে যাচ্ছে ।সকলেরই ইচ্ছা মাঝরাস্তা দিয়ে যাওয়ার ।গাড়ি, অটো, সাইকেল, রিক্সার মাঝে বিশালকায় ষাঁড় ও হেঁটে চলেছে ।সে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা । যাইহোক লজ্ এ পৌঁছে আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে আশপাশ ঘুরে দেখার জন্য বেড়োলাম।উদ্দেশ্য দুপুরের ভোজন টাও সেরে নেবার। যেহেতু পুরো উত্তর ভারত জুড়ে সে সময় নবরাত্রি চলছিল এবং কাশী তে প্রায় আমিষ খাবার পাওয়া যায় না আগেই শুনেছিলাম, তাই বাচ্চাদের বুঝিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে গেলাম। বলাই বাহুল্য খাঁটি ঘি য়ের তৈরি পুরি আর নানা রকম তরকারি খেলাম।সবচেয়ে ভালো লেগেছিল রাবড়ী । সেখানে অনেক বিদেশি পর্যটকদের দেখলাম । তারা কপালে তিলক কেটে নিরামিষ খাবার খাচ্ছে অক্লেশে । চারপাশে নানা ধরনের প্রচুর দোকান ।পানের আর চুড়ির দোকান বেশি ।আর গলির কথা কি বলব! গলি তস্য গলি ,সরু গলি।এরকম কোথাও দেখিনি ।কথায় আছে বেনারসের শাড়ি, চুড়ি, গলি, পান আর ঘাটের তুলনা হয় না ।প্রত্যেক গলি তেই বিশাল দেহি ষাঁড় ঘুরে বেড়াচ্ছে ।যাইহোক সন্ধের আগেই আমরা পৌঁছালাম বিখ্যাত দশাশ্বমেধ ঘাটে। সিনেমায় যেমন দেখেছি অবিকল তেমনি ।জয়বাবা ফেলুনাথ ছবির কথা মনে পড়ে গেল ।বড় বড় ছাতার নিচে অনেকের জমায়েত ।এখানেই কি কোথাও অপুর বাবা হরিহর রামায়ণ পাঠ করতেন! সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে আমরা গঙ্গা মাইয়ার বুকে নৌকা ভাড়া করলাম ।নৌকায় বসে মন্দিরময় কাশী-বেনারসের অপূর্ব রূপ দেখে মনে হচ্ছিল এটাই বোধহয় স্বর্গ ।এখানে প্রচুর ঘাট রয়েছে ।অসি ঘাট থেকে মণিকর্ণিকা ঘাট অবধি ঘুরলাম। মণিকর্ণিকা ঘাটের চিতার আগুন কখনো নেভে না -- জনশ্রুতি এমন ই। অনেক ঘাট, দুর্গের মতো হাভেলি, গঙ্গা জলে অস্তমিত সূর্যের লালিমা যেন অপার্থিব জগতে টেনে নিয়ে যায় । সন্ধ্যের সময় আবার ঘাটে এসে দাঁড়ালাম।মনোকামনা জানিয়ে গঙ্গার বুকে প্রদীপ জ্বালিয়ে পাতার ছোট নৌকা তে ছেড়ে দিলাম ।প্রবল স্রোতে উত্তর বাহিনী গঙ্গার বুকে সেগুলি ভেসে বেড়াতে লাগল । আকাশভরা তারার আলো আর প্রজ্জ্বলিত দীপের আলো মায়াময় জগতে নিয়ে গেল ।তার মধ্যেই শুরু হলো গঙ্গারতি।বেজে উঠল ডমরু ।সুদর্শন দীর্ঘ দেহী যুবকেরা শঙ্খ বাজিয়ে, চামর দুলিয়ে গমগমে মন্ত্রোচ্চারনে শুরু করল আরতি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য । পুরো ঘাট ভিড়ে ঠাসা । বিদেশি পর্যটক ছাড়া ভক্ত মানুষের ঢল তো রয়েছেই, সবকিছু ছাপিয়ে বিরাজ করছেন বাবা বিশ্বনাথ ।দেবাদিদেব মহাদেবের ভূমি হলো কাশীধাম।ঔরঙ্গজেব বিশ্বনাথের মন্দির ধ্বংস করার পর রাণী অহল্যা বাঈ হোলকার মন্দির নতুন করে নির্মান করেন । সেই স্থাপত্য আরো আধুনিক ও সুন্দর হলো সম্প্রতি ।কতকাল থেকে মোক্ষ লাভের জন্য এখানে মানুষের আসা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কৃচ্ছ সাধন তার কথা না বললে অনেক কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যায় । অনেক ট্রাস্ট আছে এইসব অসহায়, বিতাড়িত মানুষদের সাহায্যের জন্য ।আশ্রম ও রয়েছে প্রচুর ।তবে ভিতরে কি চলে জানা নেই ।এখনো ধর্মের নামে, জাত পাতের নামে যে ব্যভিচার চলে তা সহজে নিবৃত্ত হওয়ার নয়। আরতি দেখে আমরা বেনারসি শাড়ির কারখানা দেখতে গেলাম। কারিগর রা প্রত্যেকেই এক একজন শিল্পী ।অসীম নিষ্ঠা নিয়ে সন্তানের মতো যত্নে শাড়ি বুনছেন । সত্যিই কুর্নিশ করবার মত।রাতের খাবার খেয়ে লজে ফিরে সেদিনের মতো বিরতি নিলাম।

(চলবে)

Post a Comment

Previous Post Next Post