রঞ্জনী ও মঞ্জরী-দুই বোন। রঞ্জনী বড়। ছোটবেলায় তাদের মা তাদের ছেড়ে অন্যত্র সংসার পেতেছিলেন। বাবা-ই অনেক কষ্টে মানুষ করেছিলেন ওদের। মা চলে যাওয়ার সময় রঞ্জনীর বয়স ছিল বারো/তেরো আর মঞ্জরীর ছয়/সাত। রঞ্জনীই মায়ের মত করে ছোট্ট মঞ্জরীকে সামলেছিল। আজ ওরা বড় হয়েছে। রঞ্জনী স্বনির্ভর। মঞ্জরী সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাবাও এ সংসারের মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছেন, তাও বছর চারেক হয়ে গেল। আজও রঞ্জনীকে মঞ্জরী মায়ের মত করেই ভালবাসে। দিদিকে ছেড়ে থাকার কথা সে কল্পনাই করতে পারে না। আর রঞ্জনী? তার কাছে তার ছোট বোনটি প্রাণাধিক প্রিয়। পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন- সকলেই দুই বোনের ভালবাসা দেখে মুগ্ধ।
"দিদি, দিদি ই ই.....কোথায় গেলি? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। কতক্ষণ ভাতের সামনে বসে থাকব?"
"তোর হাত নেই? খেয়ে নিতে পারছিস না?"
" তুই তো জানিস, কলেজে যাবার সময় তুই খাইয়ে না দিলে আমার ভাললাগে না। আয় না রে...."
মঞ্জরীর কথায় হেসে ফেলে রঞ্জনী, " তোর বিয়ে হলে কি করবি?"
"আমি তো বিয়ে করব না। সারাজীবন তোর কাছে থাকব।" এই বলে মঞ্জরী দিদিকে জড়িয়ে ধরে। রঞ্জনী চটপট ভাত মেখে বোনকে খাওয়াতে শুরু করে, " তা বললে হয়! আর আমার বিয়ের পর কি করবি?"
খাওয়া থামিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মঞ্জরী দিদির দিকে। তারপর কেঁদে ফেলে," তুই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবি? আমি যে তোকে ছেড়ে থাকতেই পারব না। না, তোকে বিয়ে করতে হবে না।"
রঞ্জনী অপ্রস্তুত হয়ে যায়, " দূর পাগল! তোকে ছেড়ে কোথায় যাব? আমি যেখানেই যাই, তোকে নিয়েই যাব।"
"মা ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তুইও চলে যাবি? না না, তোকে কোথাও যেতে দেব না আমি। তুই আমায় কথা দে, তুই বিয়ে করবি না? আমরা কেউই বিয়ে করব না। বিয়ে করে কি হবে? দেখলি না, আমাদের সংসারের কি হল?"
মঞ্জরীর কথায় রঞ্জনী অস্বস্তিবোধ করে," আচ্ছা, আচ্ছা, এখন তাড়াতাড়ি খা তো। আমার অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!"
মঞ্জরী জেদ ধরে," না, আগে তুই আমায় কথা দে, আমরা এভাবেই সারাজীবন বিয়ে না করে দুই বোন একসাথে কাটাব। কি রে বল?"
"এখন এসব কথা থাক, তোরও তো কলেজে দেরি হয়ে যাচ্ছে।" রঞ্জনী কথা ঘোরাতে চেষ্টা করে। তখনকার মত ইতি পড়ে আলোচনায়। যে যার মত অফিসে, কলেজে বেরিয়ে যায়।
অফিসে কাজের ফাঁকে রঞ্জনী বারবার অন্যমনস্ক হয়। মঞ্জরীর কথাগুলো মনের মধ্যে বিপজ্জনকভাবে ঘুরতে থাকে। আজ বলে নয়, এর আগেও যখনই মঞ্জরীর কাছে বিয়ের কথা তুলেছে, মঞ্জরী এমন অস্বাভাবিক আচরণ করেছে, পাগলের মত কান্নাকাটি করেছে। দিদিকে সে কারোর সাথে ভাগ করে নিতে রাজি নয়! এসব ভাবতে ভাবতেই কখন টিফিনের সময় হয়ে গেছে, বুঝতেই পারেনি রঞ্জনী। তার হুঁশ ফিরল অয়নের কথায়, " কি ম্যাডাম, আজ কি খাওয়াদাওয়া হবে না?"
"ওহ্! কটা বাজে? আমার খেয়ালই নেই। চল।" তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে রঞ্জনী। দুজনে ক্যান্টিনে যায়। চুপচাপ খেয়ে চলে রঞ্জনী। অন্যদিন কথার ফুলঝুরি ছোটে তার। আজ একদম চুপ। অয়ন প্রশ্ন করে, "কি হয়েছে সোনা? কদিন ধরেই দেখছি, খুব অন্যমনস্ক, চুপচাপ তুমি। কি হয়েছে আমাকে বলবে না?"
ভেঙ্গে পড়ে রঞ্জনী। সবকিছু খুলে বলে অয়নকে, "মঞ্জরী একদম ভাবতেই পারে না, আমার জীবনে ও ছাড়া অন্য কেউ থাকতে পারে। মঞ্জরী কেবল আমার ছোট বোন নয়, ওকে আমি অনেকটা মায়ের মত করে ভালবাসি। ওকে আঘাত দিয়ে আমি তোমার সঙ্গে নতুন জীবন কি করে শুরু করি? আবার তোমাকে ছাড়া আমার জীবন .....আমি যে কল্পনাই করতে পারছি না গো...."
" শান্ত হও। তুমি আমার উপরে একটু ভরসা কর।" অয়নের কথায় একটু হলেও স্বস্তিবোধ করে রঞ্জনী।
কলেজে আজ সারাদিন মেজাজ গরম ছিল মঞ্জরীর। সে ঠিক বুঝতে পারছে, আবার একটা বড় ঝড় আসতে চলেছে তার জীবনে। সত্যিই দিদি কি কাউকে ভালবেসেছে? বিয়ে করতে চলেছে? দিদির বিয়ে ....স্বামী.....সন্তান.....উফ্! আর ভাবতে পারছে না মঞ্জরী। দিদির জীবনে তার তো কোন জায়গাই হবে না আর! কি নিয়ে বাঁচবে সে! সে যে একা হয়ে যাবে! আরেকবার মাতৃহারা হবে! চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যায় সে। কে ঐ লোক যে তার দিদিকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে? নাঃ! এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। চোখের জল মুছে মন শক্ত করে মঞ্জরী, দিদিকে কারোর হতে দেবে না। দিদি শুধু তার। প্রয়োজনে দিদির জীবন থেকে ঐ লোকটাকে.......
রবিবার। অয়ন এসেছে রঞ্জনীদের বাড়িতে। মঞ্জরীর চোখ জ্বলে ওঠে, এই সেই লোক! কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। অয়ন মঞ্জরীর সঙ্গে অনেক গল্প করে। নানারকম মজার মজার গল্প করে সবাইকে মাতিয়ে দেয়। এরপর থেকে প্রায়ই অয়নকে দেখা যায় রঞ্জনীদের বাড়িতে। মাঝেমাঝে তারা তিনজনে মিলে কাছাকাছি বেড়াতেও যায়। এভাবেই কেটে যায় বেশ কয়েক মাস। ধীরেধীরে মঞ্জরীর সঙ্গে অয়নের বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে রঞ্জনীর অনুপস্থিতিতেও অয়ন এসে মঞ্জরীর সঙ্গে গল্প করে। অয়ন যখন নিশ্চিত যে মঞ্জরীর মন জয় করতে পেরেছে, রঞ্জনীর সঙ্গে বিয়েতে সে কোনরকম বাধা সৃষ্টি করবে না, তখনই ঘটে ভয়ানক কাণ্ডটি।
অয়ন খুন হয়। জানা যায়, কোন এক বিশেষ বিষ তার শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে, হয়তো খাবারের মাধ্যমে। এর প্রভাবেই তার মৃত্যু ঘটেছে। এরপর থানা....পুলিশ....তদন্ত....দুই বোনেরও ডাক পড়ে। কিন্তু কিছুতেই খুনি ধরা পড়ে না।
বছরখানেক পর। এক ছুটির দিন। বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে রঞ্জনী ও মঞ্জরী। দুজনের মুখেই অদ্ভুত প্রশান্তি। মঞ্জরী মনে মনে ভাবে," আঃ! অবশেষে আজ মুক্তি। আমার আর দিদির মাঝে আর কেউ থাকবে না।"
রঞ্জনী মনে মনে ভাবে, জীবন আরও একবার তাকে শেখাল, মানুষ কত বিশ্বাসঘাতক হয়। তার মা, অয়ন ....সবাই একই পথের পথিক। অয়ন তাকে ভালবাসল, মঞ্জরীকে বোঝানোর অছিলায় শেষে মঞ্জরীর সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তুলল! তারপরই তো অনেক ভেবেচিন্তে সে ঐ পরিকল্পনা করল। অয়ন প্রায় রোজই আসত তাদের বাড়িতে। অনেক খুঁজে রঞ্জনী ঐ বিশেষ বিষ জোগাড় করেছিল। আর প্রত্যেকদিন অয়নের খাবারের সঙ্গে একটু করে মিশিয়ে দিত। ব্যাস্, উদ্দেশ্য সফল। মা বিশ্বাসঘাতকতা করেও বাবার ঔদার্যে পার পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বারবার তাদেরকে সবাই ঠকাবে! এ তো চলতে পারে না। সে প্রতিশোধ নিয়েছে। আর কাউকে ভালবাসার ভুল করবে না সে। বাকি জীবন বোনকে নিয়েই কাটিয়ে দেবে সে। পরম মমতায় রঞ্জনী মঞ্জরীকে কাছে টেনে নেয়।
অলক্ষ্যে বিষন্ন হাসি হাসেন করুণাময় ঈশ্বর। অয়ন সত্যিই একমাত্র রঞ্জনীকেই ভালোবাসত। এ তো দুই বোনের মানসিক ভয়- মঞ্জরীর প্রিয়জনকে হারানোর ভয় অর্থাৎ মনোফোবিয়া আর রঞ্জনীর সন্দেহপ্রবণ মানসিকতা অর্থাৎ ফোবিয়া অফ বিট্রেয়াল । এই দুইয়ের জাঁতাকলে পড়ে বেঘোরে প্রাণ চলে গেল এক নিরীহ প্রাণবন্ত যুবকের।