" আজ কি আর চা পাওয়া যাবে না, নাকি?"
"দাঁড়াও তো, সকাল থেকে চব্বিশ বার কেবল চা আর চা! বলি, আমারও তো বয়স বাড়ছে?"
" কর তো ঐ একই ঘ্যাঁট, মাছ....এত কিসের কাজ তোমার, শুনি?"
"কি! কি বললে? আমি খালি ঘ্যাঁট রাঁধি! তোমার নোলা তো সবসময় লকলক করে। বড়া, ভাজা- এসব করি না?"
" বুড়ি হয়ে আর কিছু না হোক, মেজাজটা বেশ বাগিয়েছ। কি ভাষা! বাপের বাড়ির শিক্ষা এখনও ....."
" কুচুটে বুড়ো! এ ভাষা আমার শাশুড়ির শিক্ষা গো!"
" ধুত্তোর! নিকুচি করেছে সংসারের...."
এই হল অনিমেষবাবু ও রমলাদেবীর দৈনন্দিন পাঁচালি। ওনাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। ছেলে সংসার সাজিয়েছে ভিনরাজ্যে আর মেয়ে তো বিদেশে। ছেলে-বউ, মেয়ে-জামাই, নাতি নাতনিরা অবশ্য নিয়ম করে কথা বলে ফোনে, দেখাসাক্ষাতও হয়- ভিডিওকলে। মাঝেমধ্যে ছেলে মেয়ের কাছেও যান তাঁরা। আর কি চাই মা বাবা হিসেবে? না না ! ওঁরা খুব ভালো আছেন। কিন্তু ঐ খিটকেল বুড়োটাকে নিয়েই হয়েছে রমলাদেবীর যত জ্বালা! আজকাল এমন সব কথা বলেন, পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে যায় রমলাদেবীর! বয়সকালে এই লোকটাই তো কত মিষ্টি করে কথা বলত, রসিক ব্যক্তি যাকে বলে! কত সময় তো সকলের সামনে কি লজ্জায় পড়তে হয়েছে রমলাদেবীকে! হায় রে! বয়স হয়ে গেলেই এমন পাল্টে যেতে হয় বুঝি? বড় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে রমলাদেবীর।
আজ এমনিতেই মনটা তাঁর ভাল নেই। কাল জামাইষষ্ঠী। স্মৃতির সরণি বেয়ে রমলাদেবী পাড়ি দেন অতীতে। শাশুড়িমা যতদিন বেঁচে ছিলেন, সকাল থেকে জামাইষষ্ঠীর আয়োজনে ব্যস্ত থাকতেন রমলাদেবী। তিন ননদ তাদের স্বামী, ছেলেপুলে সহ হাজির হত সকালেই। জলখাবার, মধ্যাহ্নভোজ, বিকেলের ছোট্ট ভোজ সেরে রাতের খাবার নিয়ে তারা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেত। রাতের খাবারের আয়োজন সম্পূর্ণ করে সন্ধ্যে নাগাদ রমলাদেবী ছুটি পেতেন। তারপর তিনি স্বামীকে নিয়ে যেতেন বাপের বাড়িতে জামাইষষ্ঠী পালন করতে। বছরের পর বছর ধরে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। তারপর তো শাশুড়িমা, রমলাদেবীর মা- সকলেই চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। ননদেরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজেদের বাড়িতে তাদের মেয়েদের জামাইষষ্ঠী নিয়ে। বন্ধই হয়ে গেল তাঁদের প্রজন্মের জামাইষষ্ঠী। রমলাদেবীও ব্যস্ত হলেন নিজের মেয়ের বিয়ের পর তার জামাইষষ্ঠী উদযাপনে। কিন্তু বছর দুই পরে মেয়ে বিদেশে পাড়ি দিল। বন্ধ হয়ে গেল রমলাদেবীর জামাইষষ্ঠী পালন। প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ হত, সকলের বাড়িতে সকাল থেকেই হইহই, শঙ্খধ্বনি, আনন্দ উৎসব। তাঁরা দুই বুড়োবুড়ি বসে আছেন নিঃসঙ্গ বাড়িতে। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আজও জামাইষষ্ঠী এলেই রমলাদেবী উদাস হয়ে যান। সারাদিন তাঁর স্মৃতিচারণ- অতীত থেকে বর্তমান।
আনমনে বসেছিলেন রমলাদেবী। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন অনিমেষবাবু। তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেললেন রমলাদেবী। অনিমেষবাবু বলে উঠলেন, " ওগো! শুনছ, আজ তোমাকে রান্না করতে হবে না।"
" কেন? আজ কি উপোস নাকি? একটু আগেই তো কত ঝগড়া করলে, এখন আবার কি হল?" ঝাঁঝিয়ে ওঠেন রমলাদেবী।
"আহা! রাগ করছ কেন? সবসময় আমার খারাপটাই দেখ তুমি। বললাম তো, আজ কিন্তু মোটেই রান্নাঘরে ঢুকবে না।" অনিমেষবাবু বলে ওঠেন।
" যত্তসব ঢং!" বলে চলে যান রমলাদেবী।
"কই গো? কোথায় গেলে? এস।" অনিমেষবাবুর হাঁকডাক শুনে রমলাদেবী খাওয়ার ঘরে আসেন। টেবিলে সাজানো আছে ভাত, ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, তরকারি, মাছ, মাংস, চাটনি, মিষ্টি, পায়েস। কিছুক্ষণ বিস্ময়ে কোন কথাই বলতে পারলেন না রমলাদেবী। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে পেয়ে অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, "একি? এতকিছু খাবার ....কোথা থেকে এল?"
"সব অর্ডার দিয়ে এনেছি, গিন্নি। শুধু পায়েসটা নিজের হাতে বানিয়েছি তোমার জন্য। আজ আমি বৌমাষষ্ঠী করছি।"
অনিমেষবাবুর কথা শুনে গালে হাত দিয়ে বসে পড়েন রমলাদেবী, "তুমি ...তুমি ....বৌমাষষ্ঠী!" হেসে ফেলেন অনিমেষবাবু, "আজ আমি তোমায় পাখার বাতাস করে সামনে বসে খাওয়াব বৌমাষষ্ঠী। এতবছর ধরে তো তুমিই জামাইষষ্ঠী পালন করেছ। আজ না হয় আমিই করলাম।"
রমলাদেবী মনে মনে ভাবেন, নাঃ, তিনিই ভুল ছিলেন, ভালবাসা চিরকাল থেকে যায় ফল্গুধারার মত।