লক্ষ্মী অলক্ষ্মী : ঈশিতা ভট্টাচার্য


 

      লক্ষ্মীপুজোর বাজার করতে সবাই গেলেও বাড়ির একমাত্র মেয়ে তৃষা গেলো না। ও অবশ্য কোনকিছুতেই থাকে না। থাকে না  বললে ভুল হবে, থাকতে দেওয়া হয় না। কারণ ওর সদ্য নতুন নামকরণ হয়েছে 'অলক্ষ্মী'।  মনে আছে , ক'মাস  আগের  বিয়ে ভাঙার দিনের কথা। দাদা - বৌদিদের সংসারে যখন সে  এসে পড়েছিল , তখন বৌদিরা তো বটেই , দাদারাও খুবই  অবাক হয়েছিল। অবাক তো হবেই ! ঘরের লক্ষ্মী  আজ যে অলক্ষ্মী তে পরিণত  হয়েছে। 


     এই তো সেদিনের কথা। চাকরী পেয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৃষা নিজেই। সন্দীপ কে বিয়ে করার কথা যেদিন বাড়িতে বললো তৃষা সেদিন  দাদারা আপত্তি তুলেছিল । কিন্তু সন্দীপের মা সেদিন বাড়ি বয়ে এসে বলেছিল , ঘরের লক্ষ্মী কে নিয়ে যাবে বলে সে  নাকি অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছে। এমন মেয়ে নাকি কোথাও তিনি খুঁজে পাবেন না। অথচ আজ কী এমন হলো যে এই লক্ষ্মী  অলক্ষ্মী তে পরিণত হলো ? আসলে লক্ষ্মী বলতে আমরা যা বুঝি , তৃষা তা কোনোদিন ই ছিল না। একে যোগ্যতা সম্পন্না , তায় রোজগেরে। তাই তো সংসারের বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে থাকতে তার খুব ই অসুবিধা হচ্ছিল। তৃষার শাশুড়ী মা তৃষাকে পছন্দ করলেও যত দিন যেতে লাগলো ,  ততই তৃষার এই বেপরোয়া স্বভাব ( তার শাশুড়ী মার মতে ) শাশুড়ী মার থেকে তৃষাকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকলো। 


    তৃষার মনে পড়লো , সেদিনের কথা। যেদিন ওর চাকরীর কল লেটার বাড়িতে এলো , মেজদা অরূপ বলেছিল , সত্যি মেয়ে বটে আমার বোন ! এই বাজারে নিজের যোগ্যতায় ঠিক চাকরী জোগাড় করে নিয়েছে ! যেমন স্বভাবে , তেমনি যোগ্যতায় সবেতেই আমাদের বোন এক নম্বরে ! জানো মা , তোমার মেয়ে আমাদের তিন ভাইয়ের থেকে বেশি রোজগেরে হবে !" শুনে তৃষা হেসে উঠেছিল । সেদিনের ছবিটা একবছরের মধ্যে যে এতটা  পাল্টে যাবে , তা তৃষা ভাবতেও পারে নি।  শুধুমাত্র শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত বলে তৃষা তার দাদাদের কাছেও ব্রাত্য।বেশি রোজগেরে বোনের যে আর কোনো মূল্যই নেই তার নিজেরই বাড়ির লোকেদের কাছেও। মা ও বেশ কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছে যে , মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে অনেক কিছুই মানিয়ে চলতে হয়। নিজের জেদ নিয়ে থাকলে হয় না। চেনা মানুষগুলো হঠাৎ করে অচেনা হয়ে গেলো এবং সেও  লক্ষ্মী থেকে অলক্ষ্মী তে পরিণত হয়ে গেলো। এটাই তৃষা এতক্ষণ ধরে ভেবে যাচ্ছিল। নিজেকে চালাবার মতো ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও তৃষার যদি এই অবস্থা হয় , তাহলে অন্য মেয়েরা এই অবস্থায় থাকলে তাদের পরিণতি কি হবে ?


    আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও যেভাবে সংসার নামক যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ,  সেখানে সামান্য কিছু ভুলচুক হলে পুরুষরা যেখানে সাজা পান না,  সেখানে প্রত্যেকটা কাজের জন্য মেয়েদের এত জবাবদিহি করতে হবে কেনো ? মেয়েরা রোজগার করেও কি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে সবক্ষেত্রে ? সংসারের নিয়ম - কানুন কি শুধু মেয়েদের জন্যই প্রযোজ্য ? আর সেই নিয়ম না মানলেই তাদের কপালে জোটে বিভিন্ন অসম্মান ! যেমন হয়েছে এই কাহিনীর তৃষার সাথে।


   আজ তৃষা শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত বলে , সবাই তার দিকে আঙুল তুলছে। সত্যি যদি সে তৃষা না হয়ে কোনো ছেলে হতো , তবেও কি সবাই তার দিকেই  আঙুল তুলতো ? বিচ্ছেদের মত  ঘটনার জন্য কি মেয়েরাই একমাত্র দায়ী ? সমাজ তথা বাড়ির সব অনুশাসন মেনে চলার দায়িত্ব  কি শুধু মেয়েদের একার ? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত মেয়েদের পাশে তো তার নিজের লোকের ই বেশি করে থাকা দরকার। কারণ যে পরিবেশে একটি মেয়ে ছোট থেকে বড় হয় , তার প্রয়োজন তো সেইসব মানুষেরাই বুঝবে। যে বা যারা ছোট থেকে মেয়েটির পাশে ছিল , তার ভালো মন্দের সাক্ষী তো তারাই হবে। 

   আমাদের সবারই এইধরনের মানুষের পাশে থেকে সাহস জোগানো উচিৎ। এইরকম পরিস্থিতিতে পড়ে একটা মেয়েই সব থেকে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করে। কারণ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বিবাহের সূত্র ধরে একটি মেয়েই কিন্তু নিজের চেনা পরিবেশ ছেড়ে নতুন পরিবেশে যায়। এই বিষয়ে কিন্তু ছেলেরাই সুবিধা ভোগ করে। তাই  বিচ্ছেদের সময়ে মেয়েদেরকেই আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসতে হয় , যা একটা ছেলেকে করতে হয় না। আর সে জন্যই মেয়েদের এত বেশি দুর্গম পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। এরকম পরিস্থিতিতে মেয়েটি যদি তার বাড়ির লোককেও কাছে না পায় , যাদের অবলম্বন করে ও ছোট থেকে বড় হয় , তবে তার আর দুর্গতির শেষ থাকে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post