অমিত চলে যাওয়ার পর বেশ অনেকগুলো দিন চলে গেলো। কি করে যে দিনগুলো কেটে গেলো বুঝতেই পারলো না তৃষা। অমিতের চলে যাওয়া , ওর অফিসে যোগ দেওয়া এইসব মিলিয়ে প্রায় অনেকগুলো দিন। আগে একটা দিনও তৃষা অমিত কে ছাড়া থাকেনি। মনে আছে, একবার অমিত অফিসের কনফারেন্স এ ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিল মাত্র দুদিনের জন্য। তৃষা প্রায় নাওয়া- খাওয়া ভুলে বসেছিল। দুদিন বাদে অমিত ফিরে এসে তৃষার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বলেছিল আমি যখন থাকবো না , তখন কতদিন বসে থাকবে ? আর আজ প্রায় দুমাস হয়ে গেলো , অমিত নেই। ও ছাড়া তৃষা কি করে আছে ? আর এটা কি করে সম্ভব হলো ? এটাই আজ রবিবারের সকালে বসে ভাবছিল তৃষা। এমন সময়ে মোবাইলটা বেজে উঠলো। কলার এ নামটা দেখে মনটা মুহূর্তে খারাপ হয়ে গেলেও , কিছু তো করার নেই। যতই হোক, মা তো , ছেলের মৃত্যু খবরে মাথা খারাপ তো হবেই। এইরকম সাত - পাঁচ ভেবে ফোনটা ধরতেই ওপার থেকে ভেসে এলো পরিচিত গঞ্জনার সুর। বলি , আমার ছেলেটাকে তো খেয়েছো, তা আমার কি ওই বাড়িতে ঠাঁই মিলবে , নাকি তোমার বিশেষ কোনো অসুবিধা আছে ? কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তৃষা বলে উঠলো , এ তুমি কি বলছো মা ! তোমার ছেলের বাড়ি , তুমি থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। তা কবে আসবে মা ? বলতো আমি গিয়ে নিয়ে আসি। না না তার আর দরকার নেই । আমি কাল ই আসছি।
বলতে গেলে অমিত চলে যাওয়ার পরে এই প্রথম শাশুড়ীমা এবাড়িতে আসছেন। কারণ অমিতের চলে যাওয়াটা এতটাই অকস্মাৎ ছিল যে , শাশুড়ীমাকে এনে দেখানোর মত সাহস তৃষার হয়নি। ছোটননদ অদিতি বার কয়েক এব্যাপারে কথা বললেও , তাতে খুব একটা কাজ হয় নি। আসলে ফোনের বার্তালাপে শাশুড়ীমার ক্ষুব্ধতার কথা মাথায় রেখেই তৃষা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। হাজার হোক অমিতের চলে যাওয়া তার কাছে যে কত বড় ক্ষতি , শ্বশুরবাড়ির লোক না বুঝলেও , এতো প্রমাণিত সত্য। বাইরের সকলের সামনে নিজের শ্বশুরবাড়ির লোকের অপমান আটকাতেই তৃষার এই নীতি গ্রহণ। আসল কথা হলো তৃষাকে সামনে পেয়ে শাশুড়ীমা যে বাণী বর্ষণ করবেন , তা একদিকে যেমন তৃষার কাছেও অসম্মানের , ঠিক তেমনি শাশুড়ীমার ও অপমান। এইসব সাত - পাঁচ ভেবেই তৃষা সেদিন যে ঠিক নীতিই নিয়েছিল , সে সম্বন্ধে তৃষা নিশ্চিত।
রবিবার মানেই অন্যরকমভাবে দিনটা কাটানো , এই ছিল আগের রুটিন। কিন্তু না , আজ তৃষা ঠিক করেছে মার কাছে যাবে। অনেকদিন যায়নি। তাই সে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিচ্ছে। অমিত চলে যাওয়ার পর এই প্রথম মা-র কাছে যাবে। মা অনেকবার বললেও ওর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
মা-র কাছে গিয়ে অনেকদিন পর বেশ শান্তি পেলো। আসলে বিয়ের একবছরের মধ্যে অমিত চলে যাওয়ায় সবাই এমনভাবে ওকে দায়ী করছিল , যে ও একেবারে কোণঠাসা হয়ে উঠছিল। কেউ কেউ আবার বলা শুরু করেছিল , নিশ্চয়ই অন্য কোনো সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কারণেই তৃষা নাকি এই সম্পর্কর প্রতি যত্নশীল ছিল না , তাই আর কি .... ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঁচ বছর ধরে নিজেদের চেনা - জানার পরে এই বিয়ে ! একজন আরেকজনকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখতো। এইরকম যেখানে সম্পর্কের বাঁধন , সেখানে নিজের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য তৃষা অমিতকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে , এটা ভাবা বোধহয় একটু বেশিই বাড়াবাড়ি মনে হয় ! আসলে কিছু মানুষের কাজ ই হলো অন্যের বিষয়ে অযাচিতভাবে মাথা ঘামানো।
পরের দিন যথারীতি শাশুড়ীমা এসে হাজির হলেন। প্রথমটায় ছেলের শোকে চুপচাপ থাকলেও তৃষা অফিস থেকে ফেরা মাত্র ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বৌমার ভূমিকা নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিলেন । তাঁর বক্তব্যে বারবার উঠে এলো ছেলের প্রতি বৌমার অবহেলার কথা। অনেক্ষন সবকিছু হজম করার পর তৃষা এবার মুখ খুললো। বললো , মা তুমি কতটা কী জানো জানিনা , আমি সবসময় তোমার ছেলেকে বলেছি , শরীরের কোনো অসুবিধা হলেই আমায় বলতে। আমি চিন্তা করবো , তুমি ভাববে এইসব ভেবে ও আমাদেরকে মানে আমাকে কিছুই বলেনি। রাতে যে প্রায়ই বুকে ব্যথা হতো , ও এইসব ব্যাপার সবই নিজের মধ্যে চেপে রেখেছে। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে গেছে। যখন আমি খুব রাগারাগি করেছি তখন নানাভাবে আমার সাথে মজা করেছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তুমি তো জানো মা, তোমার ছেলে ভীষণ চাপা স্বভাবের। জানি তোমরা সবাই আমাকে দোষারোপ করবে , সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কথাতো তুমিও মানবে যে, আজ তোমার ছেলে চলে যাওয়াতে সবথেকে বেশি ক্ষতি তো হলো আমার !
তোমার কোল খালি হলো ঠিকই। তবু তোমার মা ডাক শোনা তো বন্ধ হলো না। কিন্তু আমার? যার হাত ধরে এই বাড়িতে আমার পরিচিতি, সেই নেই। আমার আর কি রইলো বলো ? আমার এখন সাতাশ বছর বয়স। এখনও পুরো জীবনটাই বাকি। আমি একা একা কি করে থাকবো ? আর কাকে নিয়েই বা থাকবো ? তোমরা হয়তো অন্য কিছু বলবে ! কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার ছেলের জায়গায় আমি আর কাউকেই বসাতে পারবো না। এতগুলো কথা একদমে বলে তৃষা অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো।
এতক্ষণে শাশুড়ী অনিতা দেবীর হুঁশ ফিরল। এতক্ষণ ছেলেবউয়ের কথা শুনতে শুনতে সত্যি তার ছেলের ওপরে রাগ হচ্ছিল এই ভেবে যে , সত্যি তো, কেনো শরীরের অসুবিধার কথা বউয়ের কাছে চেপে রাখলো! মার না বয়স হয়েছে , কিন্তু বউ ? তাকে তো অবশ্যই বলতে হতো ! আজ যে সবই গেলো। এই বয়সী একটা মেয়ে সত্যি তো সারাটা জীবন কি করে কাটাবে ? এইসব অনেক কিছু ভেবে তিনি তৃষাকে বুকে টেনে নিলেন। এই প্রথম তৃষা শাশুড়ীর বুকে মাথা রেখে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো। অনিতা দেবী তৃষাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন আর বললেন তোমার কোনো দোষ নেই ' মা ' । আমার ছেলেটারই যত দোষ। আমি এবং আমরা সবাই তোমাকে না বুঝে অনেক কথা শুনিয়েছি। পারলে ক্ষমা কোরো। এখন থেকে তুমি আমার বৌমা নও , আমার মেয়ে। আমার মেয়েদের মতোই তুমিও আমার আরেকটা মেয়ে। তিনি বাকি জীবনটা এবাড়িতে কাটিয়ে দেওয়ার কথাও এ প্রসঙ্গে বললেন। তৃষাও সত্যি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। একা একা থাকার যন্ত্রণাতো ঘুচলো। তৃষা এতে খুব খুশি।
অনেকক্ষেত্রে এধরনের ঘটনা ঘটলেও তার শেষটা সবসময় এমন নাও হতে পারে। আসলে আমরা কোন কিছুকেই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারিনা। ধরতে গেলে নিজেদের মতো করে সব বিষয়গুলোকে জটিল করে ফেলি। তারপরে সমাধানের কথা ভাবি। যথারীতি জটিল জিনিসের সমাধান করা তো আমাদের কাজ নয়। ফলে সব ক্রোধ গিয়ে পড়ে বাড়িতে আসা নতুন মানুষটির ওপরে। কারণ আমরা সবসময় বাড়ির বউকে অপরাধী ভেবেই চলি। তার কোনো কথা শোনার আমাদের কোনো দায় থাকে না। অনেকক্ষেত্রে বউ কোনো ঝামেলায় পড়লে আমরা প্রায়শই খুশি হই। বাড়ির বউকে ভুল বোঝা এটা যেনো আমাদের অভ্যাসের মতো। সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে অন্য বাড়ি থেকে আসা অপরিচিত মেয়েটি , যে পরিচিত হতে এসেছে , তাকে বরণ করার সাথে সাথে তার মনটাকেও বরণ করতে হবে। অর্থাৎ তার মনটাকে জয় করতে হবে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ই। তাকে ভরসা জোগাতে হবে , যেকোনো ব্যাপারে তার পাশে থাকার অঙ্গীকার করতে হবে। যাতে সেই অপরিচিত মেয়েটি খুব শীঘ্রই পরিচিত হয়ে উঠতে পারে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে।
