অবদান : সায়ন্তনী দাস ধর


 

একটি বাস্তব ঘটনার ছায়ায় গল্পটি লিখেছি। সকলে সচেতন থাকুন- এইটুকুই ....    


       আজ তিন্নির ভারি মজা। লাফিয়ে লাফিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে সে, একবার মায়ের কাছে, একটু পরেই আবার বাবার কাছে। আনন্দে সে মশগুল। মা মৃন্ময়ী মৃদু ধমক দেয় তাকে, " এক জায়গায় চুপ করে বস না! " এক ছুট্টে তিন্নি চলে যায় বারান্দায়। পাশের বাড়ির জেম্মাকে ডেকে বলে," ও জেম্মা, আজ আমরা পুরীতে বেড়াতে যাচ্ছি। " জেম্মা হেসে বলে," ও মা, তিন্নিসোনা! তাই নাকি! খুব মজা হবে, বল? আমার জন্য কি আনবে? " " এত্তগুলো ঝিনুক আর শাঁখ। " তিন্নির কথা শুনে একগাল হেসে ফেলে জেম্মা। 

        সারা রাত ট্রেন ভ্রমণের পর সকালে পুরী পৌঁছে যায় মৃন্ময়ী ও তুহিন তাদের একমাত্র মেয়ে ছোট্ট মিষ্টি ছটফটে তিন্নিকে নিয়ে। অনেক বছর কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না। অফিসে এত কাজের চাপ তুহিনের! অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে চারদিনের ছুটি পেয়েছে সে। ইচ্ছে আছে পুরীকে কেন্দ্র করে আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলিও ঘুরে দেখবে। হোটেলে পৌঁছে জিনিসপত্র রেখে একটু বিশ্রাম নিল ওরা। কিন্তু বিশ্রামের কি জো আছে ! তিন্নি বাবার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে, " ও বাবা, কখন সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে? চল না,    চ--ল না! " প্রশ্রয়মাখা স্বরে তুহিন মেয়েকে বলে, "যাচ্ছি রে, যাচ্ছি! " একটু পরে দেখা যায় বাবা মায়ের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে চলেছে তিন্নি সমুদ্র দেখতে। সমুদ্রের সামনে এসে তিন্নির সমস্ত বায়না, দুষ্টুমি থমকে যায়। একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে চেয়েই থাকে বিস্তীর্ণ উথালপাথাল জলরাশির দিকে। খানিক পরেই শুরু হয়ে যায় তার প্রশ্নবাণ, "বাবা, এত জল কোথা থেকে এল? এর শেষ কোথায়? ঐ দূরে ওটা কি? জাহাজ? বাবা,  দেখ দেখ, দূরে নৌকো নিয়ে ওরা কারা?...... " ধৈর্য ধরে তুহিন একে একে মেয়ের সমস্ত কৌতুহল মেটাতে থাকে। প্রথমটায় একটু ভয় পেলেও ছোট্ট তিন্নি ধীরে ধীরে শান্ত সমুদ্রের চঞ্চল ঢেউগুলোর সাথে খেলায় মেতে ওঠে। বাবার কোলে চেপে সে চলে যায় ঢেউয়ের গভীরে। মৃন্ময়ী ভয় পায়, " আর যেও না, আমার ভয় করছে। " তুহিনের বলিষ্ঠ হাত মৃন্ময়ীকে সবলে কাছে টেনে নেয়, " আমার ওপর ভরসা নেই বুঝি ! " ঐ সীমাহীন খোলা আকাশ, অন্তহীন জলরাশি আর তুহিনের তীব্র গভীর দৃষ্টি মৃন্ময়ীর মনেও দোলা দিয়ে যায়। সেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তুহিনকে। প্রাণ ভরে সমুদ্রের ওম্  মেখে তৃপ্ত তিনজনেই। সন্ধ্যেবেলায় ঘুরতে বেরোয় ওরা। মৃন্ময়ী টুকিটাকি জিনিস কেনে। তিন্নি বায়না করে মাছ ভাজা খাওয়ার। পেটপুজো হয়। তুহিন একটা গাড়ি ঠিক করে পরদিন আশেপাশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘুরে দেখার জন্য। 

             পরদিন ভোরবেলা ওরা বেরিয়ে পড়ে, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান প্রাণ ভরে উপভোগ করে। তিন্নি তো আনন্দে আত্মহারা! দুপুরে ওরা হাজির হয় লিঙ্গরাজ মন্দিরে। ওরা জানতে পারে, লিঙ্গরাজ মন্দিরে ভোগ খাওয়ানো হয়। মৃন্ময়ী বলে, "ভগবানের প্রসাদই আজ আমাদের ভাগ্যে। এখানেই তবে দুপুরের খাওয়া সেরে নেব।ভগবানের ভোগ তো সবসময় কপালে লেখা থাকে না। " পরম ভক্তিতে ভগবান দর্শন করে ওরা। মৃন্ময়ী করজোড়ে প্রার্থনা জানায়," আমার স্বামী সন্তানের মঙ্গল কোরো। আর কিছু চাই না আমি। "

 মূল মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে ওরা ভোগ খাওয়ার জন্য এগোয়। তুহিন হাত ধুয়ে ভোগ কোথায় দেওয়া হয় সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে যায়। মৃন্ময়ী তিন্নিকে নিয়ে হাত মুখ ধুতে যায়। তিন্নিকে হাত মুখ ধুইয়ে ওকে বলে," এখানে দাঁড়া, আমি হাত ধুয়ে নিই।" হাত মুখ ধুয়ে মেয়ের দিকে ফিরতেই মৃন্ময়ীর বুক কেঁপে ওঠে। তিন্নি সেখানে নেই!!! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না মৃন্ময়ী! তিন্নি যতই ছটফটে হোক না কেন, একা একা কোথাও চলে যাওয়ার মেয়েই নয় সে। এদিক ওদিক খোঁজ করেও কোথাও মৃন্ময়ী তাকে দেখতে পায় না। ততক্ষণে তুহিনও চলে এসেছে। " তিন্নি তোমার কাছে গেছে? " মৃন্ময়ী অধীর আগ্রহে প্রশ্ন করে। হতবাক তুহিন আশ্চর্য হয়ে বলে, " তিন্নি আমার কাছে কিভাবে যাবে? ও তো তোমার কাছে ছিল! " কান্নায় ভেঙে পড়ে মৃন্ময়ী।লোকজন জড়ো হয়ে যায়। সকলে মিলে খুঁজতে থাকে তিন্নিকে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কোন হদিস মেলে না তার। মৃন্ময়ী কিছুতেই বুঝতে পারে না, ঐটুকু সময়ের মধ্যে তার একরত্তি মেয়েটা কোথায় উধাও হয়ে যেতে পারে! বিশ্বাস করতে পারে না সে, এমন অমঙ্গল তার জীবনে ঘটতে পারে! ভগবানের কাছে এসেছে সে। কি এমন পাপ সে করেছে যে এত বড় শাস্তি ভগবান তাকে দিচ্ছেন! নাঃ, আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, মাথা কাজ করছে না। তুহিন পাগলের মত মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমন অসহায় অবস্থায় আগে কখনও পড়েনি তারা। পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থায় পৌঁছেচে মৃন্ময়ী। হঠাৎ কে যেন তার পিঠে টোকা দেয়। একটি মেয়ে তাকে ইশারায় সামনের দীর্ঘ সিঁড়ি পথটির দিকে যেতে বলে। পাগলের মত সেদিকে দৌড়োয় মৃন্ময়ী। হতবাক তুহিনও অনুসরণ করে মৃন্ময়ীকে। সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা ওপরে উঠে আসে দুজনে। জায়গাটা নির্জন। আর সেখানেই তারা আবিষ্কার করে তিন্নিকে, একটি লোক তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে দুর্বোধ্য ভাষায় কিসব বলতে বলতে তিন্নির হাত ছেড়ে দিয়ে কোথায় যেন প্রায় পালিয়েই যায়। আর বেশি কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না তুহিন ও মৃন্ময়ীর। তারা তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে। অদ্ভুতভাবে তিন্নি কিন্তু ভাবলেশহীন মুখে চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। মৃন্ময়ী তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর তিন্নির যেন বোধশক্তি ফিরে আসে। মাকে জড়িয়ে ধরে সে। তুহিনদের সঙ্গে বেশ কিছু লোকজনও সেখানে এসেছিল। তারা বলাবলি করতে থাকে, " এখানে তো বাইরের কেউ আসে না। এই চত্বরে মন্দিরের পুরোহিত ও মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত লোকজনেরা থাকে। তিন্নি এখানে এল কি করে! " তুহিন ও মৃন্ময়ী তিন্নিকে নিয়ে ফিরে আসে মূল মন্দিরের কাছে। তিন্নির চোখে মুখে জল দেয়। মেয়েটা যেন কেমন চুপ হয়ে গেছে। বারবার জিজ্ঞাসার পর তিন্নি বলে, " আমি তো জানি না, ওখানে কি করে গেলাম! আমার কিছু মনে নেই। " তুহিন থানা পুলিশের কথা তুললে আশেপাশের লোকজনেরা তাকে ভয় দেখায়, "ওসব করতে যাবেন না। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন, বিপদে পড়ে যাবেন। " ঘটনার আকস্মিকতায় তুহিনও থমকে যায়। মৃন্ময়ীও আর ঝামেলা বাড়াতে চায় না। মেয়েকে ফিরে পেয়েছে, এই যথেষ্ট! বেড়ানো অসম্পূর্ণ রেখেই তারা ফিরে আসে হোটেলে। হোটেলের মালিক পুরো ঘটনা জানার পর ধীরে ধীরে বলেন, " আপনারা অতি ভাগ্যবান! লিঙ্গরাজ মন্দিরে এমন ঘটনা এর আগেও শোনা গেছে। সারা ওড়িষায় এমন অনেক বড় বড় মন্দির আছে, যেখানে আজও গোপনে দেবদাসী প্রথার চল আছে। এই কারণেই কন্যাসন্তান চুরি হয় আজও। আমি এরকম অনেক চুরির ঘটনা শুনেছি। কিন্তু চুরি হয়ে যাওয়ার পর আবার ফেরত পাবার ঘটনা এই প্রথম শুনলাম আপনাদের কাছে! " তুহিন বলে ওঠে, "কিন্তু এত বড় অপরাধ হয়ে চলেছে, কোন প্রতিকার হচ্ছে না?" ম্লান হাসেন ভদ্রলোক, " সবাই সব জানে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। অনেক বড় বড় মাথা জড়িত এর মধ্যে। " এই বলে চুপ করে যান তিনি। হঠাৎ তিনি বলে ওঠেন, " কিন্তু ঐ মেয়েটি না থাকলে তো আপনারা তিন্নিকে খুঁজেই পেতেন না। যে জায়গায় ওকে পেয়েছিলেন, সেখানে তো বাইরের কেউই যায় না। আপনারাও যেতেন না। "তাই তো! সত্যিই, মেয়েটি না থাকলে আজ আমাদের যে কি সর্বনাশ হত! তখন তিন্নিকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, মেয়েটির আর কোন খোঁজই নিই নি।" হোটেল মালিক বলেন, "মেয়েটিকে আপনারা খুঁজলেও আর পেতেন না, বোধহয়। ও গোপনে আপনাদের জানিয়ে দিয়েছে, তিন্নি কোথায় থাকতে পারে। প্রকাশ্যে এলে ওর বিপদ হত........হয়তো ঐ মেয়েটিও ভুক্তভোগী। তাই আর একটি মেয়েকে বাঁচাল। জানি না......" মৃন্ময়ী মেয়েকে বুকে চেপে ঐ অজানা অচেনা মেয়েটির জন্য নীরবে প্রার্থনা জানায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post