হাওড়া থেকে পুরী এক্সপ্রেস ধরে পরের দিন সকালে ওরা সমুদ্র শহর পুরী তে পৌঁছল। ভ্রমণ পিপাসু এই মানুষগুলোর সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দি ? অরূপ বাবুর কথা তো আগেই বলেছি। ওনার স্ত্রী পরমা , বড় মেয়ে গীতিকা এবং ছোট মেয়ে ঋতিকা।
পুরী তে পৌঁছে কিছুক্ষণ হোটেলে কাটিয়ে ওরা সমুদ্রস্নান করতে চলে গেলো। গীতিকা বরাবর ই খুব চনমনে স্বভাবের। কথাবার্তাও ভালোই বলে। তুলনায় ঋতিকা অনেকটাই শান্ত স্বভাবের। সমুদ্রস্নানে গিয়ে গীতিকা এতটাই উচ্ছসিত হয়ে পড়লো , যা জিৎ এরও নজর এড়ালো না। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি , জিৎ , পুরো নাম ইন্দ্রজিৎ। ও এসেছে ওর বাবা - মার সাথে পুরী বেড়াতে। ওইদিন ই সকালে। গীতিকার চনমনে স্বভাব ওকে গীতিকার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। ইতিমধ্যে দুই বাড়ির বাকি সদস্যদের মধ্যে আলাপচারিতা শুরু হয়ে যায়। জিৎ এর মা ও গীতিকার স্বভাবের খুব ই প্রশংসা করে। এইভাবে স্নানপর্ব মিটিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে যায়। দুপুরে শুয়ে গীতিকার কথা ভাবতে গিয়ে জিৎ এর মনে এলো পুজোয় সপ্তমীর দিন কলেজ স্কোয়ারে একটি মেয়েকে তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখে তার চোখ আটকে গিয়েছিল , সে তো এই গীতিকাই। এই কথা মনে হতেই ওর মনটা ছটফট করে উঠলো ওর সাথে কথা বলার জন্য।
এদিকে গীতিকাও মনে মনে দুপুরের দেখা ছেলেটিকে নিয়ে ভাবতে থাকে। দুজনের এই ভাবনা পরিণতি পেলো সন্ধ্যেবেলা দুই বাড়ির মিলিত বেড়ানোর মধ্য দিয়ে। নিজেদের সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতা ওরা এর মধ্যেই করে নিয়েছিল। কিন্তু ওরা সেদিন হয়তো ভাবতেই পারে নি যে , ওদের এই মন বিনিময় সেই খানেই থেমে যাবে , পরিণতি কোনোদিন ই পাবে না ! এইসব আনন্দের রেশ নিয়ে কদিন পুরী তে কাটিয়ে ওরা সবাই কলকাতায় ফিরে এলো। সম্পর্ককে মান্যতা দিয়ে ওদের দুজনের বেশ ভালোই দিন কাটছিল। সেবারের পুজো এবং পুজো পরবর্তী এই সময়টা গীতিকা এবং ইন্দ্রজিৎ এর মনে সারাজীবন রয়ে থাকার মতোই হলো। এর ই মাঝে জিৎ এর ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাওয়ার ডাক এসে গেলো , এই চলে যাওয়াই ওদের দুজনের একসাথে পথ চলার সমাপ্তি বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ জিৎ চলে যেতেই গীতিকার মা মেয়েকে সাবধান করে দিয়ে বলেন যে , এই সম্পর্ক যেনো আর না এগোয় ! " আমি তোমার অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করছি। এই জীবন তুমি ভুলে যাও।" এই কথার সূত্র ধরেই গীতিকা জিৎ এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যোগাযোগ আর হয়ে ওঠেনা। চনমনে গীতিকা এক ঝটকায় নিজেকে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলে। তার চোখের সামনে শুধু পুরীর সেই দিনগুলো ভেসে ওঠে। সে সেই দিনগুলোতেই বারবার ফিরে যেতে চায়।
এত সুন্দর একটা প্রেমের পরিণতি যে এভাবে হবে , সত্যি কেউ কি ভেবে ছিল ? পরবর্তীকালে গীতিকা সংসার করলেও তার মনটা যে ছিল অন্য জায়গায়। অন্যদিকে জিৎ সংসার করলেও ভিড়ের মধ্যে গীতিকাকেই খুঁজে বেড়াতো। দুজনের এই খোঁজাখুঁজির মধ্যেই ওরা অনেক বছর পরে নতুন রূপে , নতুন ভাবে নিজেদের আবিষ্কার করে।এখন তারা দুজনেই পরিণত মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের অধিকারী , অধিকারিণী। অতীত তাদেরকে ডাকলেও তারা যে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। যদিও অতীত ছাড়া বর্তমান হয় না , তবুও! ওরা আসলে ভাগ্যকে মেনে নিয়ে এই জীবনটা অন্যের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছে। তাই তো বাইশ বছর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় জিৎ এর হাতছানিকে উপেক্ষা করেও পরে তা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল গীতিকা। আজ ওদের আবার দেখা হওয়া , ঘুরে বেড়ানো ফোনে গল্প করা সবকিছু বজায় থাকলেও সেই স্বাধীনতা তো আর নেই ! যা ওরা একটা সময় ভোগ করেছে!
বাড়ির ছেলেকে বা মেয়েকে নিজেদের মতো করে চালাতে চাইলে একেবারে শিশু বয়স থেকেই বাড়ির নিয়ম - কানুন , বাবা - মা র ইচ্ছে - অনিচ্ছে সবকিছুই সেই শিশুটিকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিৎ শুধু নয় , বাড়ির সবার সাথে বাচ্চাটির খোলামেলা আলাপ - আলোচনার পরিবেশও বজায় রাখা উচিৎ। তাহলে সেই বাচ্চাটি বড় হওয়ার সাথে সাথে বাড়ির প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি হয়।যা কিনা বাচ্চাটির ভবিষৎ জীবনকে উদ্বুদ্ধ করে। আসলে ছোট পরিবারের যুগে একটি বা দুটি বাচ্চার প্রতি অতিরিক্ত নজর দিতে গিয়ে আসলে সেই বাচ্চাটির জীবনের স্বপ্ন , আশা - আকাঙ্ক্ষা সব কিছুকে আমরা অভিভাবক বৃন্দ গলা টিপে মেরে ফেলছি। এতে সেই ছেলেটি বা মেয়েটির চোখে আমরা অভিভাবকরা কতটা ছোট হয়ে যাচ্ছি ! এটা ভেবে দেখার মনে হয় সময় এসে গেছে।