একান্ত আমার : কল্পনা মিত্র


 

করোনার চুলচেরা আক্রমনে সকলেই তটস্থ, রোগ যে কখন কি ভাবে , কোন  সুযোগে কাকে কাবু করবে কেউ জানেনা।তার উপর লগ ডাউনের কারণে প্লেন চলাচলও স্তব্ধ ফলে ছেলে,মেয়ে অনেকদিনের প্রস্তুতি নিয়েও দেশে ফিরতে পারল না ।  এ বছর দেশে   ছুটিতে আসাকে ঘিরে তাদের অনেক প্ল্যান ছিল। মা হিসেবে  কল্যাণী নিজে ভেঙ্গে পরলেও তা প্রকাশ  না করে সকলকে স্বান্তনা দিয়ে  বলেছে  " সামনের বছর না হয় আবার প্ল্যান করা যাবে ।” অথচ এবারের সব প্ল্যানটাই ছিল তাকে কেন্দ্র করে ।



বছর  দুই আগে মেয়ের বিয়ের সময় বউ আর মেয়ে নিয়ে ছেলে বিদেশ থেকে এসেছিল , বাড়িটা  উৎসবের আনন্দে মশগুল হয়ে উঠেছিল । সুখময়  নাতনিকে বলছিল “ মা তোমার এই বড় ছেলের জন্যে একটা কণে খুজে আনো , আমিও বিয়ে করবো ।” কল্যাণী রসিকতা করেছিল ,  “ বিয়ের জন্যে তোর দাদুকে আর দুটো বছর সবুর করতে বল  ।” মেয়ে কাছে ঘেঁষে প্রশ্ন করেছিল  “ তোমাদের চল্লিশ বছরের বিবাহবার্ষিকী ? ”  বউমা হই হই করে উঠেছিল, “ হ্যাঁ হ্যাঁ ,মায়ের ইচ্ছে ছিল পঞ্চাশের আগে চল্লিশ বছরের বিবাহবার্ষিকী পালন করবেন।” সেই থেকে প্ল্যানের  শুরু। বিয়ের পর মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে আমেরিকা চলে গেল আর ছেলে তার  পরিবার নিয়ে  ইউকে ফিরে গেল । গত বছর  ছুটিতে দেশে এসে ওরা প্ল্যানটাকে আরও মজবুত করেছিল। সারা বছর ধরে বিদেশে বসেই ফোনের মাধ্যমে খাবারের আয়োজন , ডেকরেটারসদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা মায় নিমন্ত্রন পর্যন্ত সেরে ফেলেছিল কিন্তু বাস্তব দুর্যোগ তাদের বাধ্য করলো সমস্ত প্ল্যান বাতিল করতে । আগে থেকেই বউমা অনলাইনে কল্যাণী আর সুখময়ের জন্যে নাত্নির পছন্দে পোশাক কিনে পাঠিয়েছিল। বিবাহবার্ষিকীর দিন ছেলে- মেয়ে আর তাদের পরিবারের বারংবার ভিডিও কলের  অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে   ওরা দুজন বাধ্য হয়ে নতুন কাপড় পরেছে  আর ভালমন্দ রান্না করে খেয়েছে । 


    সোনালি রঙের মুগাপারের লাল চেক চেক বেগমপুরি  সাড়িটা ভাঁজ করতে করতে কল্যাণী মনে  মনে ঠিক করল আর পরবেনা সাড়িটা।   চল্লিশ বছর ধরে শুধুমাত্র একটি বিশেষ কারণে এই নিয়ে মাত্র চল্লিশ দিন  পরেছে  সাড়িটা । সেকালে বাবা-মায়ের মুখের ওপর “ এখন বিয়ে করব না ” এ কথা বলার সাহস অনেক মেয়েরই ছিল না । বাবা-মায়ের  প্রধান  দায়িত্ব ছিল মেয়ে সন্তানকে সঠিক বয়সে  পাত্রস্থ করা । সুতরাং বিএ পরীক্ষা মাথায় নিয়ে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও  কল্যাণীও বিয়ের পিড়িতে বসেছিল । বর সিঁথিতে সিন্দুর দেওয়া মাত্র  মাথা ঘুরে  শরীর খারাপ লাগাতে বিয়ে শেষ হতেই  সকলে ওকে ঘরে এনে শুইয়ে দিয়েছিল। পরেরদিন জীবনে প্রথম চেনা ঘরবাড়ি চেনা মানুষজনের থেকে দূরে এক নতুন পরিবারে  নতুন মায়ের সাথে শুয়ে  বারংবার মেয়ে হওয়ার অপরাধে নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছিল কল্যাণী । বৌদিরাও তো অন্য বাড়ি থেকে এসেছে , তবে  তাদেরও যে তার মতই কষ্ট হয়েছিল হাবে ভাবে তেমনটা মনে হয়নি বরং  দাদারা বউদিদের নিয়ে  বহাল তবিয়তে নিজেদের বাড়িতেই  রয়ে গেছে। এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে শেষ রাত্রে  বিছানাতেই উঠে বসেছিল  । শাশুড়ি মায়ের  ঘুম ভাঙ্গতে কল্যাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন “মায়ের জন্যে মন খারাপ করছে ?  আমরাও একদিন বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলাম তোমার মা -ও এসেছিলেন তোমার বাবার কাছে ।” সারাদিনটা কেটে গিয়েছিল নানান আচার অনুষ্ঠানের হই চই নিয়ে ।সব অনুষ্ঠানের  কেন্দ্রে ছিল কল্যাণী আর তার বর । যে ঘরে তাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল সেই ঘরের নতুন খাটটা যখন ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল আত্মিয়স্বজনেরা  তাকে খাটটা দেখিয়ে   নানারকম   রসিকতা করছিলেন। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে  রাগে আর ঘৃণায় তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল ।   সকলে মনে করছিল সে  বুঝিবা লজ্জা পাচ্ছে । তার অঙ্গের নানান অলঙ্কার  পরস্পরের  ছোঁয়ায় বার বার শব্দ্ করছিল , একজন বললেন “ আজ রাত্রে কিন্তু এই ঘরের সব  রকম শব্দ আমরা কান পেতে শুনবো এটা খেয়াল রেখো ।” সেই থেকে  এই অলঙ্কারের ঝঙ্কার বন্ধ করার  উপায়ের চিন্তাটা কল্যাণীর মাথায়  ঘুরপাক খাচ্ছিল । রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষে কিছুক্ষণের জন্যে সে তার নতুন ঘরে একলা হওয়ার সুযোগ  পেতেই হাতের ফুলের অলঙ্কার  ছিঁড়ে তার থেকে সরু তার  সংগ্রহ করে হাতের চুরি  বালা গুলোকে একত্র করে  বেঁধে নিয়েছিল।  



নানান নিয়ম আচার শেষে ননদ -বউদির দল তাদের ঘরের দরজা ভেজিয়ে বলেছিল “ নে সময়  এবার মন প্রান ভরে তোরা সুখের রাত কাটা ,তোদের যুগলের জীবন যেন সুখের জোয়ারে ভাসে।”   ভেজানো দরজার বাইরে খিলখিল হাসির শব্দে ভরে উঠেছিল ।কল্যাণীর নিজেকে খুব বেচারা  মনে হচ্ছিল , অসহায়ের মতন সে এক মাথা ঘোমটা দিয়ে খাটের এক ধারে বসেছিল। দরজায় ছিটকিনি দেওয়ার শব্দে কম্পিত বুকে ঘোমটার তলা দিয়ে  ঘরের মানুষটার ঘর আর ঝুল বারান্দায় হেটে বেড়ানো চঞ্চল পাদুটো দেখতে পাচ্ছিল, একসময় সেই পা জোড়া তার সামনে এসে থেমেছিল । আচমকা  কল্যাণীর ডান হাতের  কনিষ্ঠ আঙ্গুলে একটা  আংটি  পরিয়ে দিয়েই মানুষটা ঝুল বারান্দার দিকে চলে গিয়েছিল ।  ঘটনার আকস্মিকতায় কল্যাণী একটু বিচলিত হলেও সর্ব কনিষ্ঠ আঙ্গুলে ঢলঢল করা আংটিটাকে  তাড়াতাড়ি অন্য আঙ্গুলে পরতে পরতে ভাবছিল  স্বামী আংটি পরালে সেটা নাকি কোনদিন খুলতে নেই ! মানুষটা আলো নেভানো মাত্র কল্যাণী তড়িঘড়ি সড়ে গিয়ে জানলার দিকে ফিরে  শুয়ে পরেছিল । ফুলের  মশারীর ফাঁক দিয়ে জানালার বাইরের আকাশে   উজ্জ্বল পূর্ণিমার চাঁদকে তার মনে হয়েছিল  সে যেন  এক অপরিচিত পুরুষের ঘরে বন্দিনি রাজকন্যা আর দ্বারে প্রহরারত চাঁদ ।  অনেক্ষন পর মানু্ষটা নীরবতা ভেঙ্গেছিল  “ওই যে পুকুর পারের গাছটা ওটা  সেওরা গাছ । জানতো ওতে কারা থাকে !”  কল্যাণী    দূরের পুকুর  পারের চাঁদের আলো ছড়ানো একটা ঝাঁকড়া গাছ দেখে বলে উঠেছিল “ আমি কিন্তু ভিতু নই , সেওরা গাছে পেত্নি থাকলেও ভয় পাই না ...আমাকে আগে পেত্নি দেখাতে হবে ।” মানুষটা বলেছিল “সে তো ওই গাছ থেকে নেমে এসে আমার পাশে শুয়ে আছে ।”  কাল্যানি ঝট করে ওর দিকে ফিরে বলেছিল   “তাই ভাবছিলাম কোন বেম্ভদত্যি ওই শাকচুন্নির সরু আঙ্গুলে ধেরে আংটি পরাল !” উত্তর শুনে সুখময় ওর বাঁ দিকের গালটা আলতো করে টিপে ধরতেই  কল্যানি হঠাৎ লজ্জা পেয়ে আবার জানলামুখি হয়ে শুয়েছিল। -  “ আজ পূর্ণিমা,  সাদা কাপড় পরে পেত্নি আর বেম্ভ নাচ করবে ,বলতো, ওরা কি গান গাইবে ?”  সুখময় প্রশ্ন করেছিল । কল্যাণীর উত্তর ছিল “ চাঁদের হাঁসির  বাঁধ ভেঙ্গেছে -  আর গান শুনে সাদা পেঁচায় চেপে মা লক্ষ্মী আমায় আশীর্বাদ করতে আসবেন । ” খানিক নীরবতার পর  দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমে উঠেছিল ।কয়েক মুহূর্ত আগে  দুজনেই যে দুজনার কাছে অপরিচিত ছিল তা ভুলে ওরা দুই পরিবারের মানুষজন আর  ছেলেবেলার নানান  গল্পে মশগুল হয়েছিল। মায়ের নির্দেশ অনুযায়ী কল্যাণী ভোর হতেই বিছানা থেকে উঠতে গেলে সুখময় কল্যাণীকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে  ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল “সুপ্রভাত ।” এর পর সুখময় কে ছেড়ে থাকার কথা কোনদিন ভাবতেই পারে নি কল্যাণী।   

 

 

   বর্তমান   মহামারি পরিস্থিতিতে পৃথিবী তোলপাড় । মানুষের জীবন ধারাকে এক্কেবারে বিপরিত মুখি করে তুলেছে  । সংক্রমণের ভয় মানুষ একে অপরের সঙ্গে মায় প্রতিবেশীর সঙ্গেও নাকে মুখে কাপড় বেঁধে দুরত্ব বজায় রাখছে অপরদিকে  প্রানের ওপর কারো ভরশা না থাকলেও স্বাভাবিক নিয়মে জীবিকার উপযুক্ত কাজ কর্ম বন্ধ থাকায় জীবন ধারনের  জন্যে অন্ন সংস্থানের চিন্তায় মুষড়ে পরেছে । পৃথিবী জুড়ে লগডাউনের কারণে মানুষের জীবন স্তব্ধ হয়ে গেছে, ঘরছাড়া মানুষগুলো দীর্ঘদিন ঘরছাড়া হয়ে আছেন ।  যেকোনো মুহূর্তে এই মারণ রোগ কাকে আক্রমণ করবে সেই নিয়ে মানুষ তটস্থ হয়েও কিচ্ছু করতে পারছে না ।সুখময় রিটায়ার্ডের পর এক  বন্ধুর অনুরোধে অর্থের প্রয়োজনে না হলেও সময় কাটানোর তাগিদে তাদের  অফিসে গিয়ে বসতো  । লগডাউনের কারণে  অন্য  অফিসগুলোর মতন এই অফিসও বন্ধ।  এমনিতেই শান্ত স্বভাবের  স্বল্পভাষী মানুষটা  টিভি ,  বই আর  মোবাইল নিয়ে সময় কাটাচ্ছে , সুযোগ পেলে দুর্গত মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে । কল্যাণীর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা  দৈনন্দিন জীবনের  কিন্তু কোনই পরিবর্তন ঘটেনি বরং কাজের  লোক না আসার ফলে তার কাজ আরও বেড়েছে তবে সুখময়ের বাড়ীতে থাকায় সারাদিন  একলা থাকা থেকে সে যেন মুক্তি পেয়েছে। 


 কল্যানির খুব সাধ ছিল বিবাহিত জীবনের ৪০ বছরপূর্তিতে দুজনে  নতুন করে  ফুলশয্যার ঘরে পুরনো সেই দিনটির  স্মৃতি চারন করবে । গতকাল তাই সে সকালেই স্মৃতিতে রাঙ্গানো এই  লাল সাড়িটা পরেছিল , পায়ে দিয়েছিল আলতা । বিশেষ কোন দিন মনে রাখা বা উপহার দেওয়ার ব্যাপারে সুখময় চিরকালই উদাসীন । প্রতিবছর এই দিনটিতে কল্যাণীর  অনুরোধে সুখময় একটা লাল গোলাপ কিনে আনত,এবার সে উপায় না থাকায় বারান্দার টবে  ফোটা ছোট্ট গোলাপটা তুলে এনে পেন্সিল ফুলদানিতে  রেখেছিল ,ভেবেছিল  এহেন বেশে কল্যাণীকে দেখে সুখময়ের অবশ্যই  সেই দিনটির কথা মনে পরবে।  ।  রাত্রে সেই দিনটির মতনই  পূর্ণিমার চাঁদ  বিস্তীর্ণ আকাশ ও ধরনীতে তার  উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে  আবাক চোখে  স্বমহিমা নিরীক্ষণ করলেও পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তৈরি হওয়ার ফলে কল্যাণী জানলা দিয়ে সেই আলোকোজ্জ্বল রজনীকে উপভোগ করতে পারেনি ।  অন্যদিনের মতই সুখময়  যথারিতি  ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিল ! স্বামির সঙ্গে চল্লিশ বছর আগের সেই সুখস্মৃতি রোমন্থন করার  জায়গায় ঘুমন্ত স্বামীর কপালে চুম্বন  এঁকে কল্যাণী  পূর্ণচন্দ্রের প্রহরায় নিদ্রাহীন রাত্রি যাপন করল। 

 


বিছানার অপর রাখা ফোনটা বেজে উঠতেই সাড়ি হাতে ফোনটা তুলে নিল কল্যাণী । ওপাশে মামাশ্বশুরের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর “ শোন বউমা কাল সময় কে বলতে গেলাম ও শুনলো না, জানোতো আমরা সন্তানহারা  ,তোমরাই ভরসা , তোমার মামি কিছু বলবেন “ এর পর মামীশাশুড়ীর ব্যাগ্র কণ্ঠস্বর “ বউমা আমাদের কারও একজনের যদি ওই মারণ রোগ ধরে তাহলে আমরা দুজনেই  আক্রান্ত হব তাই তোমাকে বলে রাখছি, আমদের ড্রয়িংরুমের দেওয়াল আলমারির নিচের তাকে বাঁদিকে সাদা কাপড়ের বটুয়াতে আমাদের শোওয়ার ঘরের স্টিল আলমারির চাবি আছে , ৭ নম্বর  চাবি  দিয়ে ওটা খুলে  ওপরের তাকের ডানদিকের কাপড়গুলোর নিচে লকারের চাবি পাবে, ,লকারের মধ্যে ক্যাশ টাকা ,বাঙ্কের ক্যাশবই দলিলপত্র সব পাবে……... সময়ের চাইতে আমি মাত্র এক বছরের বড় ,ওর মনেও হয়তো আমাদের মতনই আশঙ্কা তাই গতকাল শুনতে চাইল না …………...।” ফোনটা বিছানাতে রাখতে গিয়ে কল্যাণী দেখল এক হাতে ওষুধ অপর হাতে দুধ  কর্ণফ্লেক্সের বাটি হাতে দাঁড়িয়ে সুখময় । লগডাউনের সময় থেকে সুখময় কল্যানিকে জলখাবারের আগের আর পরের ওষুধ  খাওয়ানোর জন্যে এই   নির্ঝঞ্ঝাট  জলখাবারের দায়িত্বটা নিজের কাধে তুলে নিয়েছে ।ওর চোখে মুখেও কি সঙ্গী হারানোর আশঙ্কা ! কল্যাণী অর্ধেক ভাঁজ করা সাড়িটাকে সস্নেহে আলনাতে রাখতে রাখতে ভাবল “ যে কটা বছর বাঁচবো সে কয়টা  বছর এই সাড়িটা  অবশ্যই পরবো। ”

1 Comments

Previous Post Next Post